শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৪১ অপরাহ্ন

ভারত-কানাডা উত্তেজনা, বিস্ফোরিত এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট আবারো আলোচনায়

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

কানাডা ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হওয়ার পর এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে ১৯৮৫ সালে বোমা হামলার ঘটনা আবারো সংবাদে উঠে এসেছে।

গত সপ্তাহে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, তার দেশ ব্রিটিশ কলম্বিয়ার এক শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ভারত সরকারের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে ‘বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ’ তদন্ত করে দেখছে। ভারত এই অভিযোগকে ‘অবান্তর’ হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছে।

এরপর থেকে ভারতের অনেক ভাষ্যকার ১৯৮৫ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে বোমা হামলার বিষয়টিকে সামনে এনেছেন, যেটি ‘কনিস্ক বোম্বিং’ নামে পরিচিত।

কী হয়েছিল ১৯৮৫ সালে?

এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইট ১৯৮৫ সালের ২৩শে জুন কানাডা থেকে লন্ডন হয়ে ভারতে যাওয়ার সময় আয়ারল্যান্ডের উপকূলে বিস্ফোরিত হয়। এতে বিমানে থাকা ৩২৯ আরোহীর সবাই নিহত হন।

বিস্ফোরণের কারণ ছিল বিমানে থাকা একটি সুটকেসের ভেতরে রাখা বোমা। সুটকেসটি যে টিকিটের আওতায় বিমানে তোলা হয়েছিল সে ব্যক্তি অবশ্য বিমানে ওঠেনি।

নিহতদের মধ্যে ছিল ২৬৮ জন কানাডার নাগরিক, যাদের বেশিরভাগই ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং ২৪ জন ভারতীয় নাগরিক। মাত্র ১৩১টি মরদেহ সাগর থেকে তোলা সম্ভব হয়েছিল।

বিমানটি যখন আকাশে উড়ছিল তখন টোকিওর নারিতা বিমানবন্দরে আরো একটি বিস্ফোরণ হয়, যাতে বিমানবন্দরের দুই কর্মী নিহত হন।

পরে তদন্তে জানা যায়, ওই বোমাটি ফ্লাইট নম্বর ১৮২ লক্ষ্য করে পেতে রাখা হয়েছিল। ওই ফ্লাইটটি ছিল এয়ার ইন্ডিয়ার যেটি জাপান থেকে ব্যাংককে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বোমাটি আগেই বিস্ফোরিত হয়।

আইরিশ নৌ কর্তৃপক্ষ ১৯৮৫ সালের ২৮শে  জুন বিমানের ধ্বংসাবশেষ সাগর থেকে তীরে নিয়ে আসে।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,আইরিশ নৌ কর্তৃপক্ষ ১৯৮৫ সালের ২৮শে জুন বিমানের ধ্বংসাবশেষ সাগর থেকে তীরে নিয়ে আসে।

হামলার পেছনে কারা ছিলেন?

কানাডার তদন্তকারীরা বলেন, বোমা হামলার পরিকল্পনায় ছিল শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যারা ১৯৮৪ সালে পাঞ্জাবের স্বর্ণমন্দিরে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ভয়ংকর অভিযানের বদলা নিতে চেয়েছিলেন।

হামলার কয়েক সপ্তাহ পরে রয়াল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ তালবিন্দার সিং পারমার নামে একজন শিখ নেতাকে গ্রেফতার করে। তিনি বাব্বার খালসা নামে চরমপন্থি একটি গ্রুপের প্রধান ছিলেন, যেটি এখন ভারত ও কানাডা দুই দেশেই নিষিদ্ধ।

এছাড়া ইন্দারজিৎ সিং রেয়াত নামে আরো একজনকে গ্রেফতার করা হয়, যিনি পেশায় একজন ইলেকট্রিশিয়ান। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের অস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্য রাখা এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়।

কিন্তু পারমারের বিরুদ্ধে মামলাটি বেশ দুর্বল ছিল এবং তাকে মুক্তি দেয়া হয়। তাকে ১৯৮০’র দশকের শুরুর দিকে কানাডা থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় ভারত।

তদন্তকারীরা এখন বিশ্বাস করেন যে ওই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল পারমার। তিনি ১৯৯২ সালে ভারতে পুলিশের হাতে নিহত হন।

এরপর ২০০০ সালে কানাডার ভাঙ্কুভারের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী রিপুদামান সিং মালিক এবং ব্রিটিশ কলম্বিয়ার মিল শ্রমিক আজাইব সিং বাগড়িকে গ্রেফতার করে। তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং গণহত্যাসহ নানা অভিযোগ আনা হয়।

রিপুদামান সিং এবং আজাইব সিং বাগড়ি

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,২০০৪ সালে ভাঙ্কুভারের একটি কারাগারে (বাম থেকে) রিপুদামান সিং এবং আজাইব সিং বাগড়ি

প্রায় দুই বছর ধরে বিচারকাজ চলার পর ২০০৫ সালে এই দুই ব্যক্তিকেই তাদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়। বিচারক বলেন, মামলায় ‘তথ্যগত ত্রুটি’ রয়েছে এবং যে ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে মূল সাক্ষ্য দিয়েছেন তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

বিবিসি তখন নিজস্ব প্রতিবেদনে বলেছিল যে, এই রায়টিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকে এবং আদালতের কক্ষে বসে নিহতদের স্বজনরা কান্নাকাটি করছিল।

বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিমান হামলার এই ঘটনায় শুধু রেয়াত নামের একজন ব্যক্তিকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। জাপানের বোমা হামলায় সংশ্লিষ্টতার কারণে ১৯৯১ সালে যুক্তরাজ্যে তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল।

২০০৩ সালে ফ্লাইট ১৮২-তে বোমা হামলার ঘটনায় কানাডার একটি আদালতে তাকে নরহত্যার দায়ে আরো পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। এছাড়া মালিক ও বাগড়ির মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার দায়ে তাকে আরো কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল।

তদন্ত সমালোচিত হয়েছিল কেন?

কানাডার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে হামলা প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়া এবং সঠিকভাবে তদন্ত পরিচালনায় করতে না পারার অভিযোগ আনা হয়েছিল।

মালিক এবং বাগড়িকে খালাস দেয়ার ঘটনায় নিহতদের স্বজনদের ব্যাপক ক্ষোভের মুখে কানাডার সরকার সুপ্রিম কোর্টের সাবেক এক বিচারককে প্রধান করে ২০০৬ সালে বোমা হামলার বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।

এই তদন্ত কমিটির অনুসন্ধান শেষ হয় ২০১০ সালে। তারা বলেন, “অতিমাত্রায় ধারাবাহিক ভুলের কারণে কানাডার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে।”

তদন্তে পাওয়া যায়, হামলার কয়েক মাস আগে বেনামী এক সাক্ষী কানাডার পুলিশকে সম্ভাব্য বিমান হামলা সম্পর্কে অবহিত করেছিল।

২০০৫ সালে টরেন্টোতে একটি মেমোরিয়ালে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন নিহতদের স্বজনরা।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,২০০৫ সালে টরেন্টোতে একটি মেমোরিয়ালে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন নিহতদের স্বজনরা।

তদন্তে আরো বেরিয়ে আসে যে হামলার কয়েক সপ্তাহ আগে কানাডার গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা পারমার এবং রেয়াতকে অনুসরণ করে ভাঙ্কুভার দ্বীপের একটি জঙ্গলের দিকে গিয়েছিল। সেখানে তারা ‘একটি বড় বিস্ফোরণের শব্দ’ শুনতে পায়। কিন্তু তখন সেটিকে তেমন পাত্তা দেয়া হয়নি।

লন্ডন এবং কানাডায় ১৯৯০’র দশকে আলাদা ঘটনায় দুই শিখ সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছিল, যারা এই বিচারের মূল সাক্ষী হতে পারতেন। এদের মধ্যে একজনকে আগেই একটি গোলাগুলির ঘটনায় আহত হওয়ায় হুইল চেয়ার ব্যবহার করতে হতো।

কানাডার গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা ২০০০ সালে একটি সংবাদপত্রকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, দুই শিখ সন্দেহভাজনের ১৫০ ঘণ্টার টেলিফোনালাপের টেপ পুলিশের কাছে হস্তান্তর না করে তিনি সেটি ধ্বংস করেছিলেন। কারণ এতে তথ্য দাতার পরিচয় ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা ছিল।

এরপর কী হলো?

২০১০ সালে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার নিহতদের স্বজনদের কাছে জনসমক্ষে ক্ষমা চেয়েছিলেন।

তিনি বলেন, বছরের পর বছর ধরে তাদের “জবাব পাওয়ার ন্যায়সম্মত অধিকার এবং সহমর্মিতাকে প্রশাসনিকভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।”

রেয়াতকে ২০১৬ সালে তার নয় বছরের কারাদণ্ডের দুই-তৃতীয়াংশ পার হওয়ার পর কানাডার একটি কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়।

একই সাথে সে কানাডার যে কোন জায়গায় বসবাস করতে পারবে বলেও অনুমোদন দেয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেন বিশেষজ্ঞরা।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পার ২০০৫ সালে টরেন্টোতে একটি মেমোরিয়ালে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পার ২০১৫ সালে টরন্টোতে নিহতদের স্মরণে নির্মাণ করা স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন।

গত বছর ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সারে এলাকায় রিপুদামান সিং মালিককে তার গাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয়। পুলিশ একে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে উল্লেখ করে এবং এ ঘটনায় দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। তাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়।

চলতি বছরের শুরুর দিকে এয়ার ইন্ডিয়ায় বোমা হামলার ৩৮ বছরে অ্যাঙ্গাস রিড ইন্সটিটিউটের একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

যেখানে বলা হয়, এই মর্মান্তিক ঘটনা ‘কানাডার ইতিহাসের তুলনামূলক অজানা একটি অংশ।’ তারা বলে, এই হামলা সম্পর্কে কানাডার প্রতি ১০ জনের মধ্যে নয় জনেরই খুব কম বা একেবারেই কোন ধারণা নেই।

ভারতে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?

এয়ার ইন্ডিয়ায় বোমা হামলার ঘটনা দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের বেদনাদায়ক স্মৃতি হয়ে আছে। কারণ নিহতদের মধ্যে অনেকেই কানাডার নাগরিক হলেও তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ভারতীয় বংশোদ্ভূত ছিল, যাদের স্বজনরা ভারতের বসবাস করতো। তারা মনে করে যে, ভুক্তভোগীরা ন্যায় বিচার পায়নি।

কানাডার আইনজীবী রিচার্ড কুয়ান্স ২০০৬ সালে নিহতদের কিছু স্বজনদের সাথে দেখা করতে ভারতে যান।

তিনি বিবিসিকে বলেন, ভারতে থাকা ভুক্তভোগীদের স্বজনরা মনে করে যে তাদেরকে ‘বিচার ব্যবস্থা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে’ এবং যে প্রক্রিয়ায় মালিক ও বাগড়িকে খালাস দেয়া হয়েছিল সেটি নিয়েও তাদের মনে প্রশ্ন আছে।

সে সময় এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইটে কো-পাইলটের স্ত্রী অমরজিৎ ভিন্দার বিবিসিকে বলেছিলেন, বোমা হামলার ঘটনায় নিঃস্ব হয়ে যাওয়া ভারতীয় পরিবারগুলো নিজেদেরকে ‘অবহেলিত’ মনে করেছে।

দুই দেশের মধ্যে সাম্প্রতিক টানাপোড়েন এই মর্মান্তিক ঘটনাকে আবারো ভারতে আলোচনায় এনেছে।

ভারতের কেন্দ্রীয় একজন মন্ত্রী সম্প্রতি এ ঘটনা টুইট করে বলেছেন, এই বোমা হামলা ভারতের বিরুদ্ধে সবচেয়ে নিন্দনীয় বিমান সন্ত্রাসের মধ্যে একটি। যারা এই ঘটনাকে সহ্য করেছে এবং এমনকি ক্ষমাও করেছে তার সমালোচনা করেন তিনি।

বোমা হামলার আগে ও পরে কানাডার কর্তৃপক্ষের ভুল পদক্ষেপের বিষয়ে একাধিক সংবাদ প্রতিবেদন ও মতামতও প্রকাশিত হয়েছে।

বছরের পর বছর ধরে নিহতদের স্বজনরা তাদের যন্ত্রণার কথা বলে আসছেন।

“এয়ার ইন্ডিয়া বোমা হামলার সাথে যারা কোন না কোনভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন, তাদের সাথে আমি এখনো দেখা করি। আমার কিন্ডারগার্টেনে পড়ুয়া মেয়ের শিক্ষকের সহপাঠী এতে নিহত হয়েছিলেন। এটা অবাক করার মতো যে, বোমা হামলাটা কত ব্যাপকভাবে কানাডিয়ানদের প্রভাবিত করেছিল,” বলছিলেন সুশীল গুপ্ত, মাত্র ১২ বছর বয়সে যার মা মারা গিয়েছিল।

বিবিসি

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com