কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর সাথে বিয়ে বা রোমান্টিক সম্পর্ক নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এবং প্রতিষ্ঠানে নানা ধরণের নিয়ম-কানুন রয়েছে। তবে অনেক সময় সম্পর্ক নিয়ে সরাসরি লিখিত কোন আইন না থাকলেও এ ধরণের ঘটনায় পরিস্থিতি বিবেচনা করে ব্যবস্থা নেয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানা সময় সময় সহর্কমীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়। সেটা বাংলাদেশে যেমন ঘটে, তেমনি পৃথিবীর নানা দেশেও হয়।
এ ধরণের পরিস্থিতির যাতে উদ্ভব না হয় সেজন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে কিছু বিধি-নিষেধ বা নিয়ম-কানুন রয়েছে।
সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বিবিসি বাংলাকে বলেন, বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তাদের বিয়ে বা প্রেমের সম্পর্কের বিষয়ে সরকারি কর্মচারীদের আচরণ বিধিমালায় কোন কিছু বলা নেই।
তিনি জানান, বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ধর্মীয় এবং দেশের আইন অনুযায়ী বিয়ের যে বিধি-বিধান আছে তা অনুসরণ করে ঊর্ধ্বতন বা অধস্তন যে কোনো সহকর্মীকে বিয়ে করতে পারেন। এর জন্য অনুমোদন দরকার হয় না।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, বিয়ে বা প্রেমের সম্পর্কের বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের জন্য আলাদা কোন নিয়ম নেই।
তিনি জানান, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ১৯৭৯ সালের একটি আচরণ বিধিমালা আছে। যেখানে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না তা বলা আছে। কিন্তু বৈবাহিক সম্পর্কের বিষয়ে কিছু বলা নাই।
তবে নৈতিকতা পরিপন্থী যদি কোন কাজ কেউ করে তাহলে সেটি অপরাধ সমতুল্য হবে এবং তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
“এছাড়া বিবাহ, প্রণয়- এগুলো বিষয়ে কিছু বলা নাই। এখন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী একটা মেয়েকে ভালোবাসতে পারে, সেটা আপত্তি নাই, কিন্তু আরেক জনের ওয়াইফকে উনি ভালোবাসবেন-এটা তো নৈতিকতা পরিপন্থী।”
এছাড়া কারো সাথে কোন ধরণের আশ্বাস দিয়ে সম্পর্ক তৈরি করা এবং পরে তা পূরণ না করে সম্পর্ক থেকে সরে যাওয়ার মতো ঘটনাও প্রতারণা এবং নৈতিকতা পরিপন্থী। একইভাবে স্ত্রী থাকা অবস্থায় অধস্তন কর্মকর্তার সাথে সম্পর্ক তৈরি করাটাও নৈতিকতার পরিপন্থী। বাংলাদেশের
এ ধরণের ঘটনা অনেক সময় সামনে আসে জানিয়ে সাবেক এই পুলিশ প্রধান বলেন, একজন কর্মকর্তার অধীনে থাকা কোন কর্মকর্তার সাথে যদি তার সম্পর্ক তৈরি হয় এবং সে বিবাহিত হলে তার স্ত্রী এ বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করলে তার তদন্ত করা হয়।
“অভিযোগের সত্যতা পাইলে ওই নৈতিকতার অবক্ষয়ের জন্য তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়।”
আর অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি তার পরকীয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং তার স্ত্রী যদি তার অভিযোগ তুলে নেয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে নেয়া পদক্ষেপ তুলে নেয়া হয়।
“তার শাস্তি নিয়ে হয়তো আমরা আর আগাই না, কিন্তু তাকে ওয়ার্নিং দিয়ে রাখি যে, যদি ভবিষ্যতেও এ ধরণের কিছু হয় তাহলে সেটা অমার্জনীয় অপরাধ হবে,” বলেন শহিদুল হক।
“আর যদি অভিযোগ না পাওয়া যায়, তাইলে তো হয় না, আমরা কিছু করতে পারি না।”
তবে সহকর্মী ছাড়াও বাইরের কোন নারীও যদি কোন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন তাহলেও একই নিয়ম অনুযায়ী তার তদন্ত করা ও ব্যবস্থা নেয়া হয় বলেও জানান পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক।
বাংলাদেশে বেসরকারি সংস্থাগুলোতে সহকর্মীদের মধ্যে বিয়ে বা প্রণয়ের সম্পর্কের বিষয়ে তেমন কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক মোঃ. আক্কাস আলী।
তিনি বলেন, অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে বা বই-পুস্তকে এ ধরণের কোন বিধি বা চর্চার বিষয়ে আলোচনা নেই। তবে একেকটি প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী এ ধরণের পরিস্থিতির মোকাবেলা করে থাকে।
উদাহরণ হিসেবে তিনি শিক্ষকতা পেশার বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, এই পেশায় কোন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের সাথে রোমান্টিক সম্পর্কে জড়ানোর নিয়ম নেই। তবে সেটি যদি উভয়পক্ষের সম্মতিতে ঘটে তাহলে সেখানে বাঁধা দেয়ারও কিছু নেই।
এই পেশায় বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের বিষয়ে মি. আক্কাস বলেন, এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোন নিয়ম নেই। তবে এ ধরণের সম্পর্কে সব সময়ই নিরুৎসাহিত করা হয়।
যারা এই সম্পর্কে জড়িত তাদের স্বামী বা স্ত্রী যদি কোন ধরণের অভিযোগ করেন তাহলে সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়া হয় বলে জানান তিনি।
“প্রতিষ্ঠান না করতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ কমপ্লেইন করে। অন্তত একজনকে তো কমপ্লেইন করতে হবে,” বলেন মি. আক্কাস।
বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে সম্মানহানির ভয়ে অনেক সময় কেউ অভিযোগ করতে এগিয়ে আসে না বলেও মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।
বাংলাদেশের একটি বেসরকারি ব্যাংক সিটি ব্যাংকের হেড অব এইচআর অপারেশন্স হাসান এমডি লাভলু বলেন, সাধারণভাবে এই প্রতিষ্ঠানে সহকর্মীদের মধ্যে বিয়ের অনুমোদন রয়েছে। এনিয়ে নিষেধাজ্ঞা নেই।
মি. লাভলু বলেন, তবে বিয়ের আগে যদি তারা এমন কোন কর্মকাণ্ড করেন যাতে প্রতিষ্ঠানের সুনামের উপর আঘাত আসে তাহলে সেটিকে বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরণের পদক্ষেপ নেয়া হয়।
“কারো পার্সোনাল ম্যাটারে সিটি ব্যাংক কখনোই কোন ইন্টারফেয়ার করে না। যতক্ষণ পর্যন্ত ডিরেক্টলি সিটি ব্যাংকের সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়, এমন কোন কাজ না করে,” বলেন মি. লাভলু।
এক্ষেত্রে যদি জড়িত ব্যক্তিদের স্বামী-স্ত্রীরা এ বিষয়ে অভিযোগ করে তাহলে প্রাথমিকভাবে তাদেরকে সতর্ক করা হয়। এরপরও যদি একই ধরণের ঘটনা ঘটে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।
গুগলের একজন মুখপাত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে অন্টারপ্রেনার ডট কম নামে একটি ওয়েবসাইটে বলা হয়, গুগল সহকর্মীদের মধ্যে রোম্যান্টিক সম্পর্ক গড়ে তোলাটা কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করে। বিশেষ করে যার কাছে কাজের জবাবদিহিতা করতে হয় এমন কর্মীর সাথে তার অধস্তন কর্মীর সম্পর্ককে নিরুৎসাহিত করা হয়।
সবশেষ ২০১৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, গুগল তার সব ভাইস প্রেসিডেন্ট বা এর চেয়ে উচ্চ পদমর্যাদার কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছে তারা যাতে অফিসের মধ্যে কোন সম্পর্ক গড়ে উঠলে তা যদি স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি করে তাহলে সে বিষয়ে কোম্পানির জেনারেল কাউন্সেল বিভাগ বা পিপলস অর্গানাইজেশন বিভাগকে অবহিত করে।
বিশ্বের সুপরিচিত ই-কমার্স কোম্পানি অ্যামাজন অফিসে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি না হলে সহকর্মীদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়ে কোন শক্ত রীতি অনুসরণ করে না।
যেমন, ম্যানেজার যদি তার অধীনস্থ কোন কর্মচারীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তাহলে সেটি তাকে প্রকাশ করতে হবে। তবে কোম্পানিটির মধ্যে অনেক কর্মীই নিজেদের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন বলেও জানা যায়।
ফেসবুকের নিয়মের মধ্যে রয়েছে, একজন কর্মচারী তার সহকর্মীকে একবার মাত্র সম্পর্ক গড়ার প্রস্তাব দিতে পারবে। এর বেশি নয়। মূলত কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধে পদক্ষেপের অংশ হিসেবে এমন নিয়ম করার কথা জানানো হয়।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে সাধারণত বিয়ের বিষয়টি বিভিন্ন ধর্মে তাদের নিজস্ব আইন অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। কিন্তু সরকারি চাকরীর ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন পরিস্থিতি উদ্ভূত হওয়ার পর সেটি ওই রাজ্যের নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৫ সালে ভারতের উত্তরপ্রদেশের একটি ঘটনার কথা। ভারতের ইকনোমিকটাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তার এক রায়ে উল্লেখ করেছিলো যে, উত্তর প্রদেশ সরকারের বিধান অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে প্রথম স্ত্রী থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় বিয়ে করতে হলে আগে থেকে সরকারের অনুমতি নিতে হবে।
উত্তর প্রদেশের কৃষি বিভাগের এক কর্মকর্তা অনুমতি না নিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করার কারণে তাকে চাকরীচ্যুত করার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় এলাহাবাদ হাইকোর্ট “প্রমাণিত অসদাচরণের” কারণে তার চাকরীচ্যুতর সিদ্ধান্তের পক্ষে রায় দেয়। পরে সেই মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ালে সর্বোচ্চ আদালতও তার বিরুদ্ধে রায় দেয়।
দ্য ট্রিবিউন নামে ভারতের একটি সংবাদ মাধ্যমের ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় ধর্মীয় কারণে একাধিক বিয়ের অনুমোদন রয়েছে। এর জেরে সরকারি অফিসে একাধিক বিয়ে করেছেন এমন কর্মকর্তাদের প্রথম স্ত্রীরা সন্তানদের নিয়ে অফিসে এসে অভিযোগ করার ঘটনাও বাড়তে থাকে।
এমন অবস্থায় ২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীর সরকার একটি সার্কুলার জারি করে। যেখানে উল্লেখ করা হয় যে, প্রশাসন বা সরকারের কোন কর্মচারী সরকারি অনুমোদন ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে না। আর এ ধরণের ঘটনা যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়। এমনকি নারী কর্মীরাও আগের স্ত্রী রয়েছে এমন কোন পুরুষ সহকর্মীকে সরকারের অনুমোদন ছাড়া বিয়ে করতে পারবে না।
এছাড়া জম্মু ও কাশ্মীরের সরকারি চাকরি বিধির ২২ ধারা অনুযায়ী, কোন সরকারি কর্মকর্তা যার স্ত্রী জীবিত আছেন তিনি সরকারের অনুমোদন ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে না। আর সরকারের অনুমোদন পেতে হলে তাকে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি দেখানোর নিয়ম রয়েছে।
হিন্দুস্তান টাইমসের ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সেবছর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তার এক রায়ে বলে যে, কোন মুসলিম সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী তার প্রথম স্ত্রীকে তালাক দেয়া ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে না। এমনটা করলে সে তার চাকরীর শর্ত ভেঙ্গেছে বলে গণ্য হবে এবং এই অপরাধে তাকে চাকরীচ্যুত পর্যন্ত করা যেতে পারে।
একই সময়ে দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, একজন সরকারি কর্মচারী এক সাথে দুই স্ত্রী রাখতে পারবেন না যদি তার চাকরীর শর্তে এ ধরণের অনুমোদন না থাকে। এমনকি ওই ব্যক্তি মুসলিম হলেও নয়।
এছাড়া ভারতে হিন্দুদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিয়ে করাটা আইনত দণ্ডনীয়।
বিবিসি বাংলা