কর্পোরেট এলিটদের জীবন নিয়ে তৈরি এমি-পুরস্কার বিজয়ী টিভি নাটক ‘সাকসেশন’ হয়তো অনেকেই দেখেছেন – যার শেষ পর্ব সারা বিশ্বের অসংখ্য দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল। কিন্তু ভারতে এখন যা সংবাদ শিরোনাম হয়ে উঠেছে তার বিষয়বস্তু হচ্ছে বাস্তব জীবনের এক ধনকুবেরের উত্তরাধিকারের পরিকল্পনা – যার সাথে জড়িত শত শত কোটি ডলারের সম্পদ।
বর্তমানে এশিয়ার শীর্ষ ধনী ব্যক্তি হচ্ছেন মুকেশ আম্বানি – যিনি রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের প্রধান। রিটেইল থেকে শুরু করে তেল শোধনাগার পর্যন্ত তার বিশাল বিনিয়োগের সাম্রাজ্যের পরিমাণ ২২,০০০ কোটি ডলার।
এরই পরিচালকমণ্ডলিতে এখন বসবেন মুকেশ আম্বানির তিন সন্তান।
এরা হচ্ছেন দুই যমজ সন্তান ইশা ও আকাশ – যাদের বয়স এখন ৩১ – আর অনন্ত, তার বয়স ২৮। শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন সাপেক্ষে তারা পরিচালকমন্ডলিতে যোগ দেবেন।
মুকেশ আম্বানি সোমবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, এর ফলে রিলায়েন্সে পুরোনো নেতৃত্বের অভিজ্ঞতার সাথে নতুন নেতৃত্বের উচ্চাভিলাষ যোগ হবে।
এর ফলে এই কোম্পানিতে তৃতীয় প্রজন্মের পারিবারিক নেতৃত্বের সূচনা ঘটবে। কর্পোরেট ভারতে সম্ভবত সম্ভবত সবচেয়ে বেশি লোকের মনোযোগ আকৃষ্ট হচ্ছে এই উত্তরাধিকারের পরিকল্পনার দিকে।
রিলায়েন্স এক বিশাল এবং ব্যাপক ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য যাতে আছে তেল, টেলিকম, কেমিক্যালস, প্রযুক্তি, ফ্যাশন থেকে শুরু করে খাদ্যপণ্য পর্যন্ত বহু খাত।
ভারতের অর্থনীতি ও সমাজের প্রায় সর্বক্ষেত্রে আম্বানিদের উপস্থিতি আছে, আর সেজন্য তাদের নিয়ে জনগণের আগ্রহও ব্যাপক।
ফলে, তার সন্তানদের জন্য এটা এক বিরাট দায়িত্ব।
এই গ্রুপ এখন পরিকল্পনা করছে কিছু বৈশ্বিক ফার্মের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সাথারণ বীমা ও স্বাস্থ্য বীমার ব্যবসায় প্রবেশ করার।
তারা আরো পরিকল্পনা করছে ২০ কোটি পরিবারের বাড়িতে ফাইভ-জি অয়্যারলেস ব্রডব্যাণ্ড সুবিধা দেবার, এবং ২০০০ মেগাওয়াট কম্পিউটিং ক্যাপাসিটি তৈরির পরিকল্পনাও করছে – যা কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হবে।
এখানেই শেষ নয়। তাদের একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা আছে বায়ুচালিত বিদ্যুত ব্যবসা এবং সৌর-গিগা ফ্যাক্টরি তৈরির।
এর মধ্যেই ফার্মটির রিটেইল শাখা ১৯৭০এর দশকের একটি জনপ্রিয় কোমল পানীয় ক্যাম্পা কোলাকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। তারা এটিকে বৈশ্বিক স্তরে নিয়ে যাবারও পরিকল্পনা করছে।
সন্দীপ নার্লেকার – যিনি সাকসেশন বা উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান টেরেনটিয়া কন্সালট্যান্টসএর পরিচালক – বলছেন, মি. আম্বানি এবং তার স্ত্রী নীতা অনেক বছর ধরেই তার সন্তানদের এ মুহুর্তটির জন্য তৈরি করছিলেন।
“তারা শুধু মুকেশ আম্বানির সন্তান বলেই উত্তরাধিকারী হচ্ছেন তা নয়, বরং এর পেছনে ভেবেচিন্তে নেয়া কৌশল এবং পরিকল্পনা কাজ করেছে, এবং তারা যেখানে ভালো করবেন তা চিহ্নিত করেই ব্যবসার ক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছে।”
মি. আম্বানিকে বর্ণনা করা হয় ‘সহজে বোঝা যায় না এমন’ একজন ব্যক্তি হিসেবে।
তিনি দরিদ্র অবস্থা থেকে উঠে এসেছেন এবং পাদপ্রদীপের আলো থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করেন। তার ছেলেমেয়েরা চরম বিলাসিতার মধ্যে বড় হয়েছেন, বাস করেছেন প্রাসাদে, ব্যক্তিগত বিমানে ভ্রমণ করেছেন এবং ওঠাবসা করেছেন তারকাদের সাথে ।
মি. আম্বানিকে তার পিতার ব্যবসার হাল ধরার জন্য স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মাঝপথে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। তবে তার সন্তানদের মধ্যে ইশা ও আকাশ যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ও ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন।
বিভিন্ন কর্পোরেট ইভেন্টে এবং ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে তাদের উপস্থিতি দেখা যায়। তাদের বিয়েও হয়েছে অন্য ধনী শিল্পপতিদের পরিবারে। সেসব আড়ম্বরপূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠানে বিয়ন্সের মত বৈশ্বিক তারকারা যোগ দিয়েছেন।
মি. নার্লেকার বলছেন, মুকেশ আম্বানি সহ পুরো পরিবারটিই তাদের বিলাসবহুল জীবন, বিয়ের অনুষ্ঠান ও বাসভবনের জন্য খরচের কারণে মিডিয়ার নজরে থাকেন। এ জন্য তার ছেলেমেয়েদের ওপর মিডিয়ার নজর হয়তো আরো বাড়বে – তবে তারা জানেন তারা কি করছেন এবং তাদের ভালোভাবেই তৈরি করা হয়েছে।
আকাশ আম্বানি কলেজে পড়া শেষ করার পর ২০১৪ সালে এ গ্রুপের টেলিকম ইউনিট রিলায়েন্স জিওর লিডারশিপ টিমে যোগ দেন।
তিনি এখন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের ধনী ক্রিকেট দল মুম্বাই ইন্ডিয়ানস-এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছেন।
এ ছাড়া তিনি ২০২০ সালে মেটা প্ল্যাটফর্ম রিলায়েন্সের একটি ইউনিট ‘জিও প্ল্যাটফর্মে’ যে ৫৭০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে – তার মধ্যস্থতাকারী দলটিতেও ছিলেন।
অন্যদিকে ইশা আম্বানি ইতোমধ্যেই তাদের কোম্পানির রিটেইল, ই-কমার্স ও লাক্সারি সংক্রান্ত পরিকল্পনাগুলোকে সামনে এগিয়ে নেবার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
বলা হয়, ফ্যাশনের ক্ষেত্রে ই-কমার্সের মাধ্যমে এই ফার্মের ক্রম-প্রসারমান উপস্থিতি, শীষস্থানীয় কিছু আন্তর্জাতিক বিলাসদ্রব্যের ব্র্যান্ডের সাথে অংশীদারিত্বের পেছনেও তিনি আছেন।
রিলায়েন্সর প্রধান ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ইশার এ উত্থান গুরুত্বপূর্ণ – কারণ তাকে সিনিয়র নেতৃত্বের ভূমিকা দেয়া হয়েছে – যেখানে এ পরিবারের অন্য নারীরা এতদিন পর্যন্ত এত বড় ভূমিকা পাননি। ২০২১ সালে ফরচুন ম্যাগাজিন তাকে ‘এয়ারেস অন-ডিউটি’ বলে আখ্যায়িত করে এবং ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের মধ্যে ২১ নম্বরে তাকে স্থান দেয়।
মুকেশ আম্বানি এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, অনেক সময়ই তার ব্যবসার ধরন নিয়েও তার মেয়ে প্রশ্ন তোলেন।
মি. আম্বানির ছোট ছেলে অনন্ত জড়িত আছেন রিলায়েন্সের জ্বালানি সংক্রান্ত ব্যবসায়। এর মধ্যে আছে ফসিলজাত জ্বালানি থেকে শুরু করে সৌরশক্তি প্যানেল তৈরির ব্যবসাও।
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট অনন্ত তার মায়ের সাথে রিলায়েন্স চ্যারিটির বোর্ডেও আছেন। আইপিএলে তাদের দলের ক্রিকেট খেলাতেও তাকে গ্যালারিতে দেখা যায়।
মি. আম্বানি এবং তার ভাই অনিল আম্বানির মধ্যে ২০০২ সালে তাদের পিতার মৃত্যুর পর ব্যবসার উত্তরাধিকার নিয়ে যে তিক্ত বিবাদ হয়েছিল তা অনেকেরই হয়তো মনে আছে ।
সম্পদ ভাগাভাগি করার কোন উইল না থাকায় শেষ পর্যন্ত তাদের মায়ের হস্তক্ষেপে এই বিবাদের রফা হয়েছিল।
এমন এক সময় রিলায়েন্স গ্রুপের নেতৃত্বে এসব পরিবর্তন আসছে যখন আম্বানি পরিবারের সাম্রাজ্যের প্রাধান্যের প্রতি হুমকি তৈরি করেছেন গৌতম আদানি – যিনি কয়লা ও অবকাঠামো ক্ষেত্রে একজন ধনকুবের।
মি. আদানি গত বছর সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আম্বানিকে ছাড়িয়ে এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।
তারা এখন ভারতের নবায়নযোগ্য জ্বালানির বাজারে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সরাসরি প্রতিযোগিতা করছেন।
মুকেশ আম্বানি বলছেন, আগামী পাঁচ বছরের জন্য তিনিই গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকবেন, এবং রিলায়েন্সের পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্বকে গড়ে তুলবেন, তার ছেলেমেয়েরা যেন সমন্বিতভাবে নেতৃত্ব দিয়ে গ্রুপকে আরো ওপরে নিয়ে যেতে পারে সেজন্য তাদের তৈরি করবেন।
মি. নার্লেকার বলছেন, এ জন্য মি. আম্বানির হাতে একটি ভালো আছে যারা বহুদিন ধরে তার সাথে কাজ করছে। তবে তার ছেলেমেয়েরা কেমন করবে তা সময়ই বলতে পারে, এবং আগামী কয়েকটি বছর হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
“মি আম্বানি সঠিক নেতাকে চিহ্নিত করার জন্য তার পরিকল্পনাকে কাজে লাগাবেন, তবে তিনি কোন তাড়াহুড়ো করছেন না” বলেন তিনি।
বিবিসি নিউজ