পদ্মা সেতু ঘিরে তৈরি হয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। স্বপ্নের এই সেতু চালুর আগেই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিনই আসছে অসংখ্য মানুষ। ভ্রমণপিপাসু এসব মানুষের চাহিদা মেটাতে পদ্মার দুই পাড়ের মানুষের যেন আন্তরিকতার কমতি নেই। আতিথেয়তার সবটুকু দরদ দিয়েই পর্যটকদের সেবা দিচ্ছেন তারা। আদি পেশা বদল করে মাওয়া-জাজিরার অনেকেই এখন পর্যটনকেন্দ্রিক নতুন ব্যবসা কিংবা অন্য পেশায় আত্মনিয়োগ করছেন। এ দিকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের পর্যটনের উদ্যোক্তারাও নতুন সেবা দেয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। আশা করা যায়, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২২ সালে বহু কাক্সিক্ষত পদ্মা সেতু চালু হলে শুধু যোগাযোগই নয়, পর্যটনের পাশাপাশি শিল্প-বাণিজ্যেও অনেক দূর এগিয়ে যাবে এই এলাকার মানুষ। দেশী-বিদেশী পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের স্পটে পরিণত হবে পদ্মা সেতু।
গত শনিবার পদ্মা সেতু ও দুই পাড়ের উন্নয়ন সরেজমিন দেখতে গিয়ে লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল, পদ্মা সেতু ঘিরে দিনকে দিন বাড়ছে পর্যটনের অমিত সম্ভাবনা। বিশেষ করে গত মাসে দেশের সবচেয়ে বৃহৎ সেতুটি মাথা তুলে দাঁড়ানোর পর থেকেই প্রতিদিনই সেতুটি দেখতে ভিড় করছেন অসংখ্য মানুষ। সবার মধ্যেই একটি ইতিবাচক মনোভাবও তৈরি হয়েছে। তবে তাক লাগানো সেতুটির পর্যটন গুরুত্ব কাজে লাগাতে পরিকল্পিত উদ্যোগের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারই পরিপ্রেক্ষিতে পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্য বেশ কিছু পরিকল্পনাও নিয়েছে সেতু বিভাগ।
সেতু দেখতে আসা লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল- পদ্মা পাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য আকৃষ্ট করছে সব বয়সের মানুষকেই। মাওয়া-জাজিরায় সেতুর পুরো কাঠামো দাঁড়ানোর পর এসব এলাকার আকর্ষণ বেড়ে গেছে বহু গুণ।
আগতরা জানান, নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণে সফলতা আমাদের গর্বের। বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রতীকÑ এই সেতু দেখতে প্রতিদিনই ভিড় করছেন পর্যটকরা। পদ্মার পাড় ও সেতুর আশপাশে নৌ-যানে চড়ে মন ভরে দেখছেন স্বপ্নের সেতু। পদ্মার পূর্ব পাড়ে মুন্সীঞ্জের লৌহজংয়ের অনেক স্থানেই গড়ে উঠেছে পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। স্থানীয় অনেক লোকজনই এখন নতুন নানা পেশার সাথে জড়িত হয়েছেন। ট্রলার ভাড়া দেয়ার ব্যবসা এখানে বেশ জমজমাট। দৈনিক আয়রোজগার বেশ। আবার অনেকে গড়েছেন রেস্টুরেন্ট। বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত পর্যটকদের খাবারের জোগান দিতে অনেকে আদি পেশা ছেড়ে হোটেল ও মাছের ব্যবসা ধরেছেন।
শিমুলিয়া ঘাটের গোল চত্বর ঘিরে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক খাবার হোটেল ও কার পার্কিং। পারিবারিক পুরনো ব্যবসা বাদ দিয়ে এখানে হোটেল দিয়েছেন লিটন মিয়া। নাম নিরিবিলি বিক্রমপুর হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। পর্যটকদের চাহিদা মতো খাবার পরিবেশন করতে ১০-১২ জন লোকবলও নিয়োগ করেছেন তিনি। জানালেন, পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর কয়েক মাস পর থেকেই তার এই হোটেল ব্যবসা বেশ জমে উঠেছে। প্রতিদিন কয়েক হাজার লোক এখানে আসছে। লিটন মিয়ার মতো আরো অনেকেই বাপ-দাদার পুরনো পেশা বাদ দিয়ে দর্শনার্থীদের সেবামূলক ব্যবসা গড়েছেন এখানে।
আগতদের অনেকেই জানালেন, যেহেতু একটি বড় প্রজেক্ট পদ্মা সেতু এখানে হয়ে যাচ্ছে, পাশাপাশি অনেক রিসোর্টও গড়ে উঠেছে। অনেকে পরিবার নিয়েও আসছে পদ্মা সেতু দেখার জন্য। তাই এখানে থাকার ব্যবস্থাটা যদি ভালো হয় আশা করি সামনে এটি দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে।
সেতু বিভাগের কর্মকর্তারাও বলছেন, পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক পর্যটনের ভাবনা তাদেরও আছে। সেতু নির্মাণের সাথে সাথেই পদ্মার দুই পাড়ের তিনটি সার্ভিস এরিয়ায় আবাসন ও সাইট অফিস স্থাপন করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সেতুর কাজ শেষ হলে পর্যটনের কাজে এগুলো ব্যবহার করার পরিকল্পনা আছে কর্তৃপক্ষের।
সেতু বিভাগের সচিব বেলায়েত হোসেন বলেন, আমরা মনে করি পদ্মা সেতুতে দেশের মধ্যে পর্যটনের বিরাট সম্ভাবনাময় একটি ক্ষেত্র তৈরি হবে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আয় করারও সুযোগ তৈরি হবে। ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টুয়াব) প্রেসিডেন্ট মো: রাফিউজ্জামান গতকাল বৃহস্পতিবার নয়া দিগন্তকে বলেন, পদ্মা সেতু ঘিরে পর্যটনের বড় একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্য যে পর্যটন স্পটগুলো রয়েছে সেগুলোর জন্যও নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে। কেননা যোগাযোগের কারণে সুন্দরবন, বাগেরহাট ও কুয়াকাটায় যে হারে পর্যটকরা আগে যেত এখন পদ্মা সেতু হওয়ার ফলে আরো বেশি সহজে কম খরচে ও কম সময়ে ওই সব স্পটে পর্যটকরা যেতে পারবে। পাশাপাশি পদ্মার দুই পাড়েও নতুন নতুন স্পট তৈরি হবে। এখানকার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও পদ্মা সেতু বড় একটি ভূমিকা রাখবে।
পদ্মা সেতু চালুর আগেই দুই পাড়ের সংযোগ সড়কের উভয় পাশেই শুরু হয়েছে পর্যটকদের জন্য নানা বিনোদনের আয়োজন। স্থানে স্থানে কার পার্কিং, চা-কফির দোকান, খাবার হোটেল, বিশ্রামাগার, সুদৃশ্য যাত্রী ছাউনি নির্মাণও করা হচ্ছে। ফরিদপুরের ভাঙ্গার চার রাস্তা মোড়ে গোল চত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় কয়েকটি স্পট। আরো রয়েছে উন্নয়নের নানা চোখ ধাঁধানো কর্মযজ্ঞ। একই সাথে ঢাকা-বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের দুই পাশে এখন কেবলই দেখা যায় অবকাঠামোগত উন্নয়নকাজ। বিশেষ করে দপদপিয়া, বিমানবন্দর, গড়িয়ার পাড়, শিকারপুর এলাকায় মহাসড়কের দু’পাশে বেসরকারি খাতে অবকাঠামো উন্নয়ন চলছে একের পর এক। আর এসবই হচ্ছে পদ্মা সেতুকে টার্গেট করে।
পদ্মা সেতুর পর্যটনের সম্ভাবনা নিয়ে কথা হয় পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক (পিডি) শফিকুল ইসলামের সাথে। তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, পদ্মা সেতুর মূল কাজের সাথে পর্যটন-সংশ্লিষ্ট কোনো কাজের সম্পর্ক নেই। এ ছাড়া সেতু নির্মাণ ছাড়া পর্যটন খাতের জন্য আলাদা কোনো অর্থ বরাদ্দও নেই। তবে এই সেতু ঘিরে পর্যটনের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সেখানে বেসরকারি পর্যায়ে অনেক উদ্যোক্তাই হয়তো এগিয়ে আসবেন। আর এ ক্ষেত্রে সরকার পর্যটক ও উদ্যোক্তাদের নিরাপত্তায় সহযোগিতা দেবে।