নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম, দেশের বৃহত্তম ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতার শৈশব কেটেছে দারিদ্রে
আপডেট সময়
সোমবার, ৩১ জুলাই, ২০২৩
কর্মজীবন থেকে অবসরের পরেও বিশ্রাম নেননি। বরং আরও এক দফা কাজে নেমে পড়েছিলেন হাসমুখ তারকদাস পারেখ। এ বার নিজের সঞ্চয় ভাঙিয়ে তার একাংশ ঢেলেছিলেন গৃহঋণ প্রদানকারী সংস্থা গড়তে। যাতে সহজ শর্তে স্বপ্নের নীড় গড়তে পারেন মধ্যবিত্তেরা।
সত্তরের দশকের শেষ ভাগে নিজের সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন হাসমুখ। সম্প্রতি যেটি একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। শেয়ার বাজারে মূলধনের নিরিখে এই ব্যাঙ্কের ঝুলিতে রয়েছে ৪ লক্ষ ১৪ কোটি টাকা।
দুই সংস্থার মেলবন্ধনের জেরে ব্যাঙ্কের মুকুটে আরও এক সাফল্যের পালক জুড়েছে। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ব্যাঙ্কের তকমা জুটে গিয়েছে এই সংস্থাটির। বর্তমানে দেশেরও বৃহত্ত্ম বেসরকারি ব্যাঙ্ক এটি
বেসরকারি ওই ব্যাঙ্কের কীর্তি নিয়ে আলোচনা চললেই হাসমুখভাইয়ের নাম উঠে আসে। ১৯৭৭ সালে এই ব্যাঙ্কের মূল সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা যে তিনিই!
হাসমুখের গোড়ার জীবন এতটা মসৃণ ছিল না। তাতে নানা নাটকীয় উপাদানের পাশাপাশি রক্ত জল করা পরিশ্রমের উদাহরণও খুঁজে পাওয়া যায়।
১৯১১ সালের ১০ মার্চ সুরাতের এক জৈন পরিবারে জন্ম হয়েছিল হাসমুখের। তখনও গুজরাতের অঙ্গ হয়নি সে শহর। ব্রিটিশশাসিত দেশে তা বম্বে প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত ছিল। সেখানকার একটি নিম্নমধ্যবিত্তদের আবাসনে সপরিবার থাকতেন হাসমুখের বাবা ঠাকুরদাস পারেখ।
ঠাকুরদাসের সংসারকে কোনও ভাবেই সচ্ছল বলা যায় না। তবে পূর্বপুরুষদের ব্যবসায়িক বুদ্ধি জন্মগত ছিল কষ্টের সংসারে বড় হওয়া হাসমুখের। বারো ঘর এক উঠোনে বড় হওয়া হাসমুখ এক সময় সংসার টানতে আংশিক সময়ের চাকরি করেছেন। সেই সঙ্গে অর্থনীতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন।
তৎকালীন বম্বে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক হওয়ার পর বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষার স্বপ্নপূরণ করেন হাসমুখ। লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকস থেকে ব্যাঙ্কিং অ্যান্ড ফাইনান্স ডিগ্রি হাসিল করেন তিনি।
১৯৩৬ সালে ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফিরে আসেন তিনি। এর পর শেয়ার বাজারের খুঁটিনাটি শিখতে শুরু করেন হাসমুখ।
সে সময় দেশের প্রথম সারির স্টক ব্রোকিং সংস্থা ‘হরকিসানদাস লক্ষ্মীদাস’-এ যোগ দিয়েছিলেন তিনি। পাশাপাশি, তৎকালীন বম্বের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অর্থনীতির লেকচারার হিসাবেও কাজ করতেন। এ ভাবেই তিন বছর কাটিয়েছিলেন হাসমুখ।
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ানোর সময় হাসমুখ নিজেও পড়ুয়া ছিলেন। বহু দশক পরে তেমনই খোলসা করেছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন, দু’দশক ধরে হাতেকলমে শেয়ার বাজারের খুঁটিনাটি শিখেছিলেন ওই স্টক ব্রোকিং সংস্থায়। যা পরে নিজের সংস্থার ভিত্তি গড়তে কাজে লেগেছিল।
এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাঙ্ক হল আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক। এর মূল সংস্থা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (আইসিআইসিআই)-র উন্নয়নেও অবদান রয়েছে হাসমুখের।
২০০২ সালে মূল সংস্থাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক। আইসিআইসিআইতে কাজের সূত্রেই ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছিলেন হাসমুখ।
১৯৫৬ সালে এই ব্যাঙ্কের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে কাজ শুরু করেন তিনি। ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান হিসাবেও দায়িত্ব সামলেছেন হাসমুখ। পরে ১৯৭২ সালে সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর হন।
১৯৭৬ সালে ওই সংস্থা থেকে অবসর নিলেও পরের দু’বছর ব্যাঙ্কের বোর্ডে ছিলেন হাসমুখ। অবসরের পর আরও এক ক্ষেত্রে নিজের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি।
১৯৭৭ সালে নিজের সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন হাসমুখ। সে সময় ৬৫ বছরের পারেখ সবেমাত্র আইসিআইসিআই থেকে অবসর নিয়েছেন। তাঁর দাবি ছিল, তাঁর গৃহঋণ প্রদানকারী সংস্থার হাত ধরেই বহু মধ্যবিত্তের সাধ্যের মধ্যে এসেছিল নিজের বাড়ি তৈরির স্বপ্ন।
দেশের সর্বপ্রথম রিটেল হাউসিং ফাইনান্স সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা পরে জানিয়েছিলেন, অবসরের পর ব্যাঙ্ক গড়তে সরকারি অর্থসাহায্য নেননি। বরং নিজের সঞ্চয় থেকে টাকা ঢেলেছিলেন।
হাসমুখের নেতৃত্বে আড়েবহরে বৃদ্ধি পেয়েছে সংস্থা। সে জন্য পেশাদারিত্বের সঙ্গে স্বচ্ছতা এবং সততায় ভরসা রেখেছিলেন বলে দাবি ছিল পারেখের। ১৯৭৮ সালে এক গ্রাহককে প্রথম বার গৃহঋণ দিয়েছিল তাঁর সংস্থা। ১৯৮৪ সালের মধ্যে সংস্থাটি বার্ষিক ১০০ কোটি অর্থমূল্যের গৃহঋণে অনুমোদন দিয়েছিল।
১৯৮৩ সালে ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রের বাইরেও পা রেখেছিলেন হাসমুখ। সে বছর দেশের প্রথম বেসরকারি তৈল উত্তোলন সংস্থা গড়েন তিনি।
ছোট শহর এবং গ্রামীণ এলাকায় গৃহঋণ প্রদানের জন্যও একটি সংস্থা তৈরি করেছিলেন হাসমুখ। এ ছাড়া, প্রায় ১৬ বছর ধরে আইএমসি ইকোনমিক রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ফাউন্ডেশন (আইএমসি-ইআরটিএফ)-এর চেয়ারম্যানের পদেও ছিলেন।
নানা ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য ১৯৯২ সালে হাসমুখকে পদ্ম-সম্মানে ভূষিত করে ভারত সরকার। পদ্মভূষণ লাভের বছর দুয়েক পর ১৯৯৪ সালের ১৮ নভেম্বর প্রয়াত হন ৮৩ বছরের এই দূরদর্শী।