বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০১ অপরাহ্ন

হজে গিয়ে জেদ্দা যেমন দেখলাম

  • আপডেট সময় সোমবার, ৩১ জুলাই, ২০২৩

এই তো সেদিনের কথা। তখনও রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের সুবাদে মেঘের উপরের রাস্তাঘাটের তেমন সম্প্রসারণ ঘটেনি। সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেবরা যখন আরব সাগর, লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে সুয়েজ খাল ভেদ করে ভূমধ‍্যসাগরের উপর দিয়ে বিলেত যাত্রা করতেন, তখন পথে জাহাজগুলো বেশ খানিকটা সময় ধরে এই জেদ্দা ঘাটে নোঙর ফেলে থাকত।

সেসময় এই ঘাট থেকে জাহাজের গা বেয়ে পিপীলিকার মতো মুচি-মজুর থেকে শুরু করে ক্ষৌরকার, চর্মকার সবাই উঠে পড়ত। উদ্দেশ্য জাহাজের যাত্রীদের কাছ থেকে টু-পাইস কামানো। এমনকি শোনা যায় কাপড়ের গাট্টিগুট্টি মাথায় করে দর্জিরা পর্যন্ত উঠে পড়ত। বিস্তর দরকষাকষি আর দরদাম করে যাত্রীদের পছন্দসই কাপড় দিয়ে পোশাক বানিয়ে একদম গায়ে গতরে পরিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে তারপর নেমে পড়ত।

আজ এই জেদ্দা শহর দেখে সেদিনের কথা ভাবতে সেরকম বুকের পাটা থাকতে হয়। মাত্র আড়াই-তিন হাজার বছর আগে এটা ছিল লোহিত সাগরের পাড়ে একটা সাধারণ জেলেপল্লী। তখন সম্পদ বলতে ছিল মাত্র কয়েকটি খেজুরগাছ, হজে আসা হজযাত্রীদের কাছ থেকে কিছু বাণিজ্য আয় আর লোহিত সাগরের মাছ ধরা।

তারপর যখন সুয়েজ খাল চালু হলো তখন থেকেই এই জেদ্দা পোর্টের ফুলেফেঁপে উঠার ইতিহাস। তারপর সৌদি অর্থনীতি যখন যথেষ্ট তৈলাক্ত হয়ে উঠলো তারপর থেকে পেট্রো ডলারের দাপটে এই জেদ্দাসহ সমগ্র সৌদি আরবের মারমার কাটকাট উন্নয়নের ফলশ্রুতিতে জেদ্দা নগরীর আজ এই ঝকমকে রূপ। বর্তমানে এ শহর সৌদি আরবের দ্বিতীয় বড় নগরী, শিল্পনগরী এবং প্রধান সমুদ্রবন্দর। দেশের অর্থনৈতিক রাজধানীও এই জেদ্দা। দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম ও ব্যস্ততম বিমানবন্দর এ জেদ্দায়। এখন এখানে প্রায় অর্ধকোটি লোকের বসবাস। পাহাড়, সমুদ্র আর মরুভূমিবেষ্টিত একটি শহরে এতো লোকের বাস, ভাবা যায়!

কথিত আছে, জেদ্দা নামের উৎস মা হাওয়া থেকে। ‘জাদ্দা’ আরবি শব্দ। এর অর্থ দাদিমা। হযরত হাওয়াকে (আ.) পুরো দুনিয়ার ‘দাদিমা’ হিসেবেও গণ্য করা হয়, সে হিসেবে মা হাওয়ার শহরকে ‘জেদ্দা’ নামকরণ করা হয়।

আমরা তিন নব‍্য হাজী- মুকিত ভাই, আমি এবং সগীর ভাই, সকাল সকাল মক্কা থেকে মুকিত ভাইয়ের বন্ধু ফরহাদ ভাইয়ের গাড়িতে জেদ্দা রওনা দিই। আমাদের হজমেট মুকিত হাসান খান মানে আমাদের মুকিত ভাইয়ের ঈর্ষণীয় বন্ধুভাগ‍্য। তরুণ পরহেজগার মুসল্লি মুকিত ভাই পুলিশ বাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বর্তমানে পিরোজপুর জেলায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত। উনার সৌদিপ্রবাসী বন্ধু আরমান ভাই এবং ফরহাদ ভাইয়ের আতিথেয়তা আর ফ্রি গাড়ি সার্ভিসে সৌদি আরবের মক্কা, তায়েফ এবং জেদ্দা ভ্রমণে শুষ্ক মরুর বুকে আমাদের সুশীতল ঝর্ণাধারার সুখ দিয়েছে।

<div class="paragraphs"><p>জেদ্দা শহরে লেখকের তোলা কিছু ছবি</p></div>

জেদ্দা শহরে লেখকের তোলা কিছু ছবি

তায়েফ নগরীতে আস্ত খাসি সহযোগে স্পেশাল ডিস ‘লাহা মেন্দি’ এবং জেদ্দায় বসে ঘাসপাতা সহযোগে লেবানিজ  স্পেশাল ডিস ‘মুসকান’ আহার করার স্মৃতি সম্ভবত আজীবনের জন্য  মানসপটে স্থায়ী হয়ে থাকল। প্রশস্ত মক্কা-জেদ্দা সড়ক ধরে তুমুল গতিতে এগিয়ে চলল গাড়ি। দুইপাশ থেকে শুষ্ক পাহাড়, মরুভূমি, বালিয়ারি, কচিৎ মরুদ‍্যান, মরু জাহাজের পাল আর পেট্রো ডলারের দাপুটে উন্নয়ন কর্মজজ্ঞের দৃশ্যকে পেছনে ফেলে একসময় সুরম‍্য অট্টালিকা শোভিত জেদ্দা শহরে প্রবেশ করি।

শহরে ঢুকতেই সামনে পড়ল সুদৃশ্য ‘গলাকাটা মসজিদ’। পাশেই নয়নাভিরাম লেক। গলাকাটা মসজিদ এজন্য যে এখনেই একসময় প্রকাশ‍্যে শিরোচ্ছেদ করা হতো। বর্তমানে মানবাধিকারের ডামাডোলে প্রক্রিয়াটি স্তিমিত হয়ে আসছে। তারপর শহরে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে কিছু কেনাকাটার জন্য বালাদ মার্কেটে আসি। এখানে সারি সারি জুয়েলারি দোকানসহ রকমারি জিনিসের পসরা সাজিয়ে দোকানিরা বসে। রাস্তায় তেমন লোকজন নেই, কিন্তু জুয়েলারি দোকানে উপচে পড়া ভিড়। সবই প্রায় উপমহাদেশীয় খরিদ্দার। কেনাকাটা শেষে লেবানিজ ফ্রুটস অ্যান্ড জুস রেস্টুরেন্টে আরমান ভাইয়ের সৌজন্যে লাঞ্চ সেরে নিই।

তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে জোহরের নামাজ সেরে আবার বেরিয়ে পড়ি। আরমান ভাইয়ের সৌজন্যে পাওয়া গাড়িতে লোহিত সাগরের পাড় ঘেঁষে নান্দনিকভাবে স্থাপিত সড়কগুলো ধরে লং ড্রাইভের মতো বেশ করে ঘুরে বেড়ালাম। মাঝখানে পশ্চিমা পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ‘ইয়ট ক্লাবের’ পাশে লোহিত সাগরের পানির উপর আধুনিক স্থাপত্যকলায় নির্মিত দৃষ্টিনন্দন ‘মসজিদুল রহমায়’ আসরের নামাজ পড়ি। শ্বেতপাথরের মসজিদটি সৌন্দর্য পূজারি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

সি পোর্ট ধরে সামনে এগোতে থাকলে অনেকদূর থেকেই ‘কিং ফাহাদ ফাউন্টেন’ দেখা যায়। কিং ফাহাদ ফাউন্টেনকে ভাবা হয় বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ঝরনা। এটি ৮৫৩ ফুট উচ্চতায় পানি ছুড়তে সক্ষম। রাতের বেলা প্রায় পাঁচশ স্পটলাইটের আয়োজন করা হয় এখানে। এভাবে চলতে চলতেই আমরা লোহিত সাগরের পাড়ে জেদ্দা পোর্ট লাইটহাউজ ও ল‍্যান্ড পার্ক পর্যবেক্ষণ করে ফেলি।

একসময় দিনমান অনল বিচ্ছুরণের ক্লান্তিতে সমুদ্রঢেউয়ের চূড়ায় চূড়ায় সান্ধ্য আবীর ছড়িয়ে দিয়ে সূর্যটা পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়ল। সারাদিনের ভ্রমণ শেষে ক্লান্তমান দেহে বুকভরা অবিস্মরণীয় স্মৃতি নিয়ে পবিত্র মক্কা নগরীতে ফিরে আসি।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com