বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের একটি জেলা দিনাজপুর। দিনাজপুর বেশ বড় একটি জেলা। তাতে রয়েছে অনেক দর্শনীয় স্থান। এবার শীতে দুই দিনের জন্য দিনাজপুর ভ্রমণে গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে সকাল দশটার ট্রেনে উঠেছিলাম। টানা নয় ঘণ্টা জার্নি শেষে সন্ধ্যা সাতটায় নেমেছিলাম ফুলবাড়ি স্টেশনে। সেখানে থাকার জন্য আবাসিক হোটেল থাকলেও আত্মীয়বাড়ি থাকার সুবাদে আর হোটেলে উঠতে হয়নি। উত্তরবঙ্গের শীত গায়ে মেখে প্রথম রাতটা গল্প করতে করতেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম।
পরের দিন সকালে যখন ঘুম থেকে উঠলাম, তখন চারপাশে ঘন কুয়াশা। নাস্তা সেরে তৈরি হয়ে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম ঘোরাঘুরির জন্য। দিনাজপুরের সবচেয়ে জনপ্রিয় পরিবহন হচ্ছে ভ্যান। ভ্যানে চড়ে দূরদূরান্তে চলে যাওয়া যায় খুব কম ভাড়ায়। এত ভ্যানের আনাগোনা এখন আর কোনো জেলায় চোখে পড়ে না বোধ হয়। আমরা একটি ভ্যান নিয়ে রওনা দিলাম আশুরার বিলের উদ্দেশ্যে।
আশুরার বিল দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। আশুরার বিলের আয়তন ২৫১.৭৮ হেক্টর। আশুরার বিলের কোল ঘেঁষে আছে নবাবগঞ্জ জাতীয় উদ্যান। তাই একসঙ্গে দুটো জায়গাই দেখা হয়ে যায় সহজে। এই বিলের উৎপত্তি নিয়ে আছে নানান কাহিনি। কথিত আছে, এই বিলের চারপাশ থেকে ৮০ টি নালা চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেছে বলে এর নামকরণ হয়েছে আশুরার বিল। বিলের মাঝে কিছু স্থান পাতিলদহ, বুড়িদহ, পালাদহ, মুনির থান, মুনির আইল, কাজলাদহ, পীরদহ ইত্যাদি নামে পরিচিত।
একসময় এই বিলে অনেক মাছ পাওয়া যেত। এই বিলের বোয়াল এবং পাবদা মাছ খুবই জনপ্রিয়। এছাড়া মাগুর, কই, পুঁটি, চিংড়ি, আইরমাছ, শোল, টেংরা ইত্যাদি নানান জাতের মাছ পাওয়া যায়। বর্ষা মৌসুমে এই বিল লাল ও সাদা শাপলা ফুলে আরো নান্দনিক হয়ে ওঠে। এই বিলে প্রচুর বোরো ধানের চাষ হয়। সারা বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এসে এই বিলের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়। আমরাও খুব মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মূল পথ পেরিয়ে বনের ভেতর দিয়ে যখন আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম, একটা অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছিলো। চাইলে সেখানে পার্কিং চার্জ দিয়ে গাড়ি রেখেও দেয়া যায়। তবে আমরা আমাদের ভ্যানগাড়িটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। সেখানে ভ্যান পেতে অসুবিধা হয় না। আমরা ইচ্ছেখুশিমতো ঘুরেছিলাম।
আশুরার বিলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা হচ্ছে কাঠের সাঁকো। দর্শনার্থীনের সৌন্দর্য উপভোগ করার ও বিলের এপার ওপাড় হওয়ার জন্যই সাঁকোটা তৈরি করা হয়েছে। আমরা সাঁকো পার হয়ে অন্য পারে গেলাম। সেখানে কিছু দোকানপাট আছে। তাতে বাহারি ধরনের পণ্য পাওয়া যায়। যার যার পছন্দমতো কিনে নিতে পারে সুলভ মূল্যে। বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে আমরা আবার মূল প্রবেশমুখে ফিরে এলাম বের হওয়ার জন্য। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য সীতারকোট বিহার।
সীতারকোট বিহারে যাওয়ার জন্য আমরা আশুরার বিল থেকে ভ্যান নিয়ে নিলাম। সেখান থেকে সীতারকোট বিহারের দূরত্ব আনুমানিক ১৬ কিলোমিটার। এটা খুব উল্লেখযোগ্য সুন্দর জায়গা নয়। তবে যারা ইতিহাস কিংবা প্রত্নতত্ত্বকে ছুঁয়ে দেখতে ভালোবাসে, তাদের অবশ্যই জায়গাটা ঘুরে দেখা উচিত। শীতের দিন ছিল বিধায় সেখানের ঘাসগুলো রুক্ষ হয়ে ছিল। বর্ষাদিনে গেলে পুরো বিহার চত্বর সবুজ ঘাসে ঢেকে থাকে। তখন দেখতে তুলনামূলক বেশি ভালোলাগে। সীতারকোট বা সীতাকোট বিহারটি মূলত একটি বৌদ্ধ বিহার, যা দেখতে প্রায় বর্গাকৃতির। বিহারটির পরিমাপ পূর্ব-পশ্চিমে ৬৫.২৩ মিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে ৬৪.১১ মিটার।
সীতারকোট বিহার সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায় ইন্টারনেটের বদৌলতে। যেমন, বিহারের ভেতরের দিকে ২.৫৯ মিটার প্রশস্ত একটি অভ্যন্তরীণ টানা বারান্দা ছিল। ১.৬৮ মিটার লম্বা এবং ১.০৭ মিটার প্রশস্ত দরজার মাধ্যমে বিহারের কক্ষগুলো সেই বারান্দার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। একটি ১.২২ মিটার পুরু এবং ০.৭৬ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট দেয়াল সমগ্র বারান্দাকে আঙিনা থেকে আড়াল করে রাখতো। প্রতিটি কেন্দ্রীয় কক্ষে ছিলো একটি করে ইটের বেদি, যেখানে পূজার মূর্তি রাখা হতো। আকার আয়তনের দিক থেকে সীতাকোট বিহারের সাথে বগুড়ার ভাসু বিহারের অনেক মিল রয়েছে। ব্রোঞ্জনির্মিত একটি বোধিসত্ত্ব পদ্মপাণি এবং বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রী মূর্তি সীতাকোট বিহার থেকে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। মূর্তি দুটির গঠনশৈলী থেকে অনুমান করা যায় যে, এগুলো সাত-আট শতকে তৈরি। সীতারকোট বিহার ঘুরে দেখতে বেশি সময় লাগলো না আমাদের। তারপর আমরা সেই ভ্যানে করেই স্বপ্নপুরির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
দুপাশে ফসলের মাঠ আর তার মাঝখানে রাস্তা, মাঝেমাঝে অনেকটা পথ কেবল মাঠ আর মাঠ, কোনো জনবসতি চোখে পড়ে না, এমন মধুময় দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা প্রায় বিকেলের দিকে পৌঁছে গেলাম স্বপ্নপুরী। স্বপ্নপুরীর মূল প্রবেশপথের কাছেই আছে খাবার দোকান। আমরা সেখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। খাবারের মান মোটামুটি ছিল। খাওয়া শেষে আমরা টিকেট কেটে স্বপ্নপুরীতে প্রবেশ করলাম। টিকেট মূল্য নিল ১০০ টাকা। ভেতরে প্রবেশ করেই মুগ্ধ হতে শুরু করলাম। স্বপ্নপুরী বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা হয়ে যায়, তবু যেন শেষ হয় না। স্বপ্নপুরী দিনাজপুর শহর থেকে ৫২ কিলোমিটার দক্ষিণে নবাবগঞ্জ উপজেলার আফতাবগঞ্জে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যেগে প্রায় ১৫০ একর জমির ওপর তৈরি করা হয়েছে। এটা কিছুটা প্রাকৃতিক ও কৃত্রিমতার মিশেলে একটি বিনোদনকেন্দ্র বা পার্ক।
এতে যেমন অনেক গাছপালা আছে, তেমনই বিভিন্ন পশু-পাখির ভাস্কর্য, কৃত্রিম পাহাড় ঝর্ণা, চিড়িয়াখানা, বিভিন্ন ধরণের রাইড সবকিছু রয়েছে। এর ভেতরে আছে ঝিল, দেবদারু বৃক্ষের সারি, অনেক বাগানবিলাসের সমারোহ। আরো আছে বিভিন্ন ধরণের জলযানে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ। আছে থাকার জন্য রেস্টহাউস, ডাকবাংলো, কেনাকাটা করার জন্য অনেক দোকানপাট। কী নেই তাতে? স্বপ্নপুরী যেন প্রকৃত অর্থেই স্বপ্নপুরী। স্বপ্নপুরী রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। আমরা সন্ধ্যা অবধি ঘুরে বেড়িয়ে পড়লাম। তারপর আবার ভ্যানে চড়ে ফুলবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মাঠঘাট পেরিয়ে ফুলবাড়িতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল। সেখানে পৌঁছে পথের ধারে বসে গরম গরম ভাপা আর চিতই পিঠা খেয়ে সেদিনের মতো ভ্রমণ সমাপ্ত করলাম।
দ্বিতীয় দিন সকালে কুয়াশা ছিল অনেক বেশি। তাই তৈরি হয়েও বের হতে দেরি হলো। বের হওয়ার আগে আমরা বাড়ির সামনে দিয়ে ফেরি করে যাওয়া একজন বিক্রেতার কাছ থেকে রস কিনে খেলাম। কী অপূর্ব সেই স্বাদ! তারপর আমরা বড়পুকুরিয়া ঘুরতে গেলাম। কয়লা উত্তোলনের জন্য সেখানে অনেকখানি এলাকা মাটির নিচে দেবে গিয়েছিলো। সেখানকার জনবসতি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এখন সেখানে কোনো মনুষ্যবসতি নেই, কেবল রাস্তার দুধারে বিস্তীর্ণ মাঠ। আমরা ভ্যানগাড়ি নিয়েই গিয়েছিলাম সেখানে। বিশাল মাঠের মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে ভ্যানে চড়ে যেতে অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে।
তবে ওখানকার মানুষগুলোর দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে খারাপও লেগেছিল খুব। সেখান থেকে আমরা চলে যাই বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দেখতে। এটি পার্বতীপুর উপজেলায় অবস্থিত। ১৯৮৫ সালে এই কয়লাখনিটি আবিষ্কৃত হয়। যার আয়তন ৬.৬৮ বর্গ কিলোমিটার। সর্বসাধারণরে জন্য প্রবেশ নিষিদ্ধ বিধায় আমরা ভেতরে প্রবেশ করতে পারিনি। কয়লাখনির কাছেই বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। সেখানেও সবাই প্রবেশ করতে পারে না, তবু আমরা বাইরে থেকে দেখতে গিয়েছিলাম। ২০০৬ সালে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হয়। কেন্দ্রটিতে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির কয়লা ব্যবহার করা হয়। এটি পরিচালনা করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এসব দেখার মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের ভ্রমণ সমাপ্ত করেছিলাম।
দিনাজপুরে আরো যা যা দেখার আছে
দিনাজপুর সদর উপজেলায় রয়েছে দিনাজপুর রাজবাড়ি, ঘুঘুডাঙা জমিদার বাড়ি, রামসাগর, রামসাগর জাতীয় উদ্যান ও মন্দির, পঞ্চরত্ন মন্দির, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বিরল উপজেলায় আছে কড়ই বিল, ধর্মপুর শালবন, দীপশিখা মেটিস্কুল। বোচাগঞ্জ উপজেলায় আছে সাগুনী শালবন। কাহারোল উপজেলায় আছে কান্তজীর মন্দির, কান্তজীর মন্দির জাদুঘর, নয়াবাদ মসজিদ, কাঞ্চন বিল, প্রাচীন বিষ্ণু মন্দির। বীরগঞ্জ উপজেলায় আছে সিংড়া শালবন ও জাতীয় উদ্যান। ঘোড়াঘাট উপজেলায় আছে ঘোড়াঘাট দুর্গ, সুরা মসজিদ। বিরামপুর উপজেলায় আছে রখুনিকান্ত জমিদার বাড়ি, আশুরার বিল। নবাবগঞ্জ উপজেলায় আছে সোনাভানের ধাপ। খানসামা উপজেলায় আছে আওকরা মসজিদ, খানসামা জমিদার বাড়ি। পার্বতীপুর জেলায় আছে পার্বতীপুর জংশন।
দিনাজপুরের বিখ্যাত খাবার
লিচু, চিড়া, পাপড়, কাটারিভোগ চাল, আজুবা টি স্টল এর চা, সরিষাফুল দিয়ে ডিমভাজি, রুস্তম হোটেলের কলিজা ও মগজ ভুনা, শচীনদার এক টাকার সিঙ্গারা এবং পাবনা সুইটসের কালোজাম।
আবাসিক হোটেল
হোটেল ইউনিক রেসিডেন্সিয়াল, হোটেল ডায়মন্ড বি, হোটেল আল রশিদ, হোটেল এসএম রেসিডেন্সিয়াল, দিনাজপুর পর্যটন কর্পোরেশন মোটেল ইত্যাদি।
ঢাকা থেকে দিনাজপুর যাতায়াত ব্যবস্থা
রেলপথে একতা এক্সপ্রেস, দ্রুতযান এক্সপ্রেস, পঞ্চগড় এক্সপ্রেস এ পথে চলাচল করে। ভাড়া সাধারণত ৩৯০-১৩৯০ টাকা পর্যন্ত। সড়কপথে নাবিল, হানিফ, এসআর ট্রাভেলস এ পথে চলাচল করে। কল্যাণপুর ও গাবতলী থেকে উঠতে হয়। ভাড়া সাধারণত ৫০০-৬০০ টাকা। আকাশপথে গেলে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে নামতে হয়।