রেস্তোরাঁটি আকারে একেবারেই ছোট। রেস্তোরাঁর বাইরের ও ভেতরে জ্বলতে থাকা মোমবাতি আপনাকে আকৃষ্ট করবে। রুপার একটি ঘণ্টা আছে ওয়েটারকে ডাকার জন্য। এখানকার সুস্বাদু ইতালিয়ান খাবার তৃপ্তি মেটাবে আপনার। তবে সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, এতে কেবল একটি টেবিল রুচিসম্মতভাবে সাজানো থাকে, আর সেখানে কেবল দুজন খাবার খেতে পারেন।
ইতালির এই রেস্তোরাঁটির নাম সলো পের দ্যুয়ে। এর অর্থই কিন্তু ‘কেবল দুজনের জন্য’। আর এখানে খাওয়াটা কিন্তু বেশ খরুচে। এখানে দুজনের এক বেলা খাবারের জন্য খরচ হবে ৫০০ ডলার বা প্রায় ৫৪ হাজার টাকা। মালিকদের দাবি, শুধু ইতালি নয়, গোটা পৃথিবীর বিলাসবহুল রেস্তোরাঁগুলোর মধ্যে আকারে সবচেয়ে ছোট।
চমৎকার, রোমান্টিক পরিবেশে খাবার খাওয়ার জন্য রেস্তোরাঁটির জুড়ি মেলা ভার। বছরজুড়েই এখানে লাঞ্চ ও ডিনারের ব্যবস্থা থাকে। তবে আশ্চর্যজনক হলেও এই রেস্তোরাঁর কোনো নির্দিষ্ট মেনু থাকে না। এখানে যাঁরা খাবার খাওয়ার জন্য বুকিং দেন, তাঁদের পছন্দ ও রুচি অনুযায়ী খাবার বানান শেফ। শুধু তা-ই নয়, খাওয়ার সময় কী ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজবে এবং কী ধরনের ফুল দিয়ে কীভাবে সাজানো হবে তাও আপনি বাছাই করে দিতে পারবেন।
রোমের উত্তরে ভাকোনি গ্রামের ধারে বিশ শতকের একটি পাথরের ম্যানসনের অংশ ৫০০ বর্গফুটের কম জায়গার ছোট্ট ডাইনিং রুমটি। এখানে বুকিং করতে হয় ফোনে, আর খেতে আসার অন্তত দশ দিন আগে নিশ্চিত করতে হবে এটা। কী খাবেন সেটাও তখন জানিয়ে দিতে হবে। অবশ্য একবারে কেবল দুজন খেতে পারার কারণে সাধারণত কয়েক মাস আগেই বুকিং না দিয়ে রাখলে এখানে একটি ডিনার বা লাঞ্চ করার কোনো আশা নেই আপনার।
কিছু নিয়ম কঠোরভাবে মানা হয়। রিজার্ভেশনের আগে রেস্তোরাঁটির ভেতরে দেখার নিয়ম নেই। শেষ মুহূর্তে কোনো খাবার পরিবর্তন করা যাবে না। মালিকদের সঙ্গে কথা বলে যে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে তখনই আসতে হবে অতিথিদের।
রেস্তোরাঁয় আসার সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। এখানে পৌঁছার ৩০ মিনিট আগে ফোনে জানাতে হবে অতিথিকে। বেশি আগেও আসা যাবে না। তাহলে রেস্তোরাঁর দুয়ার বন্ধ পাবেন, কেউ অভিবাদন জানাতেও থাকবেন না।
৩৩ বছর ধরে সলো পার দ্যু পরিচালনা করে আসছেন স্থানীয় তিন উদ্যোক্তা। এখানে খাবারের জন্য বুকিং দেওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁদের নাম জানতে পারবেন না।
‘এটা কেবলই একটি রেস্তোরাঁ নয়, অনন্য ও অন্তরঙ্গ একটি অভিজ্ঞতা উপহার দিই আমরা, এটাই আমাদের যুগ যুগ ধরে চলে আসা খ্যাতির মূলে আছে। কাজেই আমরা কে এটা বড় ব্যাপার নয়, আমরা ছায়ার মতো থাকি।’ নিজেকে মি. রেমো নামে পরিচয় করিয়ে দেওয়া মালিকদের একজন বলেন।
‘যেসব মানুষ এখানে আসেন তাঁরা অতিথি, যাঁদের আমরা সর্বোচ্চ যত্ন নিই। বিশেষ এই সময়টা তাঁরা যেমন চেয়েছিলেন, সেভাবেই যেন কাটে তা নিশ্চিত করি আমরা। তাঁদের চাহিদা অনুসারেই সবকিছু তৈরি করা হয় এখানে।’ বলেন তিনি।
মজার ঘটনা, কাছে-ধারেই একজন ওয়েটার থাকেন। তবে এমনিতে দেখা দেবেন না। ছোট্ট রুপার ঘণ্টাটা বাজালেই তিনি হাজির হয়ে যাবেন।
জায়গাটির অবস্থান কিন্তু চমৎকার। সলো পের দ্যুয়েতে ঘিরে আছে বিরল প্রজাতির বিভিন্ন গাছের এক বাগান। বিশেষ করে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে পামগাছের বিভিন্ন জাত শোভা বাড়াচ্ছে এর। পাশেই আছে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা। ম্যানসনটা যে এস্টেটের মধ্যে সেখানে আগে ছিল একটি রোমান ভিলা। পরিত্যক্ত ভিলাটা ঘুরে দেখতে পারেন অতিথিরা। অতিথিদের স্বাগত জানাতে বাগান ও রেস্তোরাঁর প্রবেশপথে জ্বলতে থাকা মোমবাতি।
বুকিং কনফার্মের পর অতিথিরা নানা পদের মেনু নির্বাচন করেন। এর মধ্যে থাকে মাছ কিংবা মাংস, ডেজার্ট, পানীয়। নানা ধরনের ইতালিয় খাবার বেছে নিতে পারেন অতিথিরা। হার্ট আকৃতির যে কেকটি পরিবেশন করা হয়, সেটায় লেখা থাকে আগত দুই অতিথির নাম।
এমন একটি রেস্তোরাঁ স্থাপনের পেছনের আছে আশ্চর্য এক কারণ। রেমো জানান, লোকজনে ভরপুর রেস্তোরাঁ দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। পাশাপাশি অতিথিদের সঙ্গে যেমন আচরণ করা হয় এবং যেভাবে বসানো হয় সেটাও তাকে হতাশ করে।
‘এটা মেনে নেওয়া যাচ্ছিল না। প্রতিবারই আমি এবং আমার ছেলে ডিনারে গেলে আমাদের ভাগ্যে জুটত রান্নাঘর কিংবা বাথরুমের কাছের ছোট্ট একটি টেবিল। বদ গন্ধ নাকে এসে লাগত সব সময়। এর কারণ আমরা কেবল দুজন ছিলাম’ বলেন রেমো।
আর তাই ভাবতে থাকেন এমন একটা কিছু করার যেখানে কোনো এক যুগল অসাধারণ এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে পারবেন। আর এর বাস্তব রূপ এই রেস্তোরাঁ।
এটা কোনো ব্যবসায়িক আলাপের জায়গা নয়। প্রেমিক-প্রেমিকা ও দম্পতিরা এখানে বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিনসহ নানা বিষয় উদ্যাপনে উপস্থিত হন। নিজেদের মতো রাজকীয়, আনন্দময় এক সময় কাটান। এখানকার পরিবেশও যেন রূপকথার পাতা থেকে ওঠে আসা কিছু। রাতে ভেতরের বাতি থাকে নেভানো, জ্বলে মোমবাতি।
হৃৎপিণ্ড আকৃতির রাভিয়োলি, ঝিনুক, মাংসের কারপাচ্চিয়ো, হার্ট আকৃতির সাদা চকলেটসহ কারপাচিও সাধারণত বেশি অর্ডার দেন এখানকার অতিথিরা। ডাইনিংয়ের ও রেস্তোরাঁর বাগানের পরিবেশও মুগ্ধ করবে আপনাকে। লাল কিংবা সোনালি টবিলক্লথ, রুপার ছুরি-চামচ, পুরোনো পেইন্টিং, ঐতিহাসিক সব চরিত্রের আবক্ষ মূর্তি, সোনালি ফ্রেমের আয়না আর সব জায়গায় ফুলের ছড়াছড়ি—সব মিলিয়ে রীতিমতো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়বেন। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত ফায়ারপ্লেস আর একটি পিয়ানোও মনোযোগ আকর্ষণ করবে।
গ্রীষ্মে আপনি এই রেস্তোরাঁর বাগানের স্ট্রবেরির সুগন্ধি লতায় ঢাকা ছাউনিতে দাঁড়িয়ে দেখবেন জলপাই বাগান ও আঙুর লতায় ঢেকে থাকা উপত্যকার সৌন্দর্য। এদিকে বর্ষায় খাওয়ার আগে ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে উপভোগ করতে পারবেন সময়টা।
খাওয়া শেষে যুগলেরা বুক অব থটস নামে একটি বইয়ে নিজেদের নানা স্মৃতি এখানকার অভিজ্ঞতা নিয়ে দুই–চার প্যারা লিখতে পারেন। অতিথিরা চাইলে তাঁদের আনার জন্য গাড়ির ব্যবস্থাও করা হয়। বাগানে আলাদা আলোকসজ্জারও ব্যবস্থা হয়। এমনকি এখানকার পরিবেশ দেখে যদি মুগ্ধ হোন তবে আশপাশে কোথায় চমৎকার পরিবেশে থাকতে পারবেন সে ব্যাপারেও সুপরামর্শ দেবে রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ।