বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২৯ অপরাহ্ন

গোয়া ভ্রমণ

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৪ জুলাই, ২০২৩
গোয়া পৌঁছাতে বারটা থেকে বেশি বেজে গেছে, রাত আড়াইটা। আমাদের সহযাত্রী অনেক ফরেনার। তখন নিজেকেও একটু ট্রাভেলার ট্রাভেলার মনে হচ্ছে। এয়ারপোর্টেই দেখি অমুক ক্যাসিনো তমুক ক্যাসিনোর বিজ্ঞাপন। চোখ সরিয়ে নিলাম, ভুলেও তাকানো যাবে না ঐদিকে। আলমের গাব্বু মার্কা ব্যাগটা সে চাইলেই সাথে করে নিতে পারে, তাও সে প্রত্যেকবার ব্যাগ ড্রপে দিয়ে দিবে। ব্যাগে বিভিন্ন এয়ারপোর্টের ল্যাবেল লাগানো থাকবে এটা তার খুব ভাল্লাগে। আমি একবার তার ব্যাগ থেকে দুই একটা ল্যাবেল ছিঁড়ে ফেলি। ব্যাগ আসবে তিন নাম্বার বেল্টে। দাঁড়িয়ে আছি কখন আসবে ল্যাবেল লাগানো ব্যাগ।
আমাদের পাশে এক পিচ্চি তার মায়ের সাথে দাঁড়ানো। সেই পিচ্চি যে ব্যাগই আসে সেটাই আমাদের ব্যাগ, আমাদের ব্যাগ বলে লাফিয়ে পড়ে। পারলে বেল্টের উপরে উঠে যায়। আমি তার দিকে তাকাই, হেলো বলছি এরকম একটা লুক দেয়ার চেষ্টা করি। এসব ক্ষেত্রে তিন ধরণের পিচ্চি দেখা যায়। এক, লাজুক পিচ্চি; তার দিকে তাকিয়ে হাই বললে সে বাপ-মার প্যান্ট শাড়ি ধরে লুকানোর চেষ্টা করে। দুই, ফ্রেন্ডলি পিচ্চি; সেও হাই বলবে, খুব মজা পাবে। তিন, ত্যাঁদড় পিচ্চি; হাই বলবে না, সম্ভব হলে হাত তুলে মারবে এরকম ভাব নিবে। তবে এই বেল্টের উপর লাফিয়ে পড়া পিচ্চি ছিল চার নাম্বার ধরণের, কোন রি-একশন নাই, হাই বলেছিস তো আমার কি, আমি গোয়া আসছি, দুই বোতল হুইস্কি খেয়ে বিচে শুয়ে থাকব।
এর মধ্যে ক্রেডিট কার্ড, টাকা পয়সা হারিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যত সাশ্রয়ী উপায়ে ট্যুর শেষ করা যায়। হোটেল বুক না করে আমরা Air bnb তে রুম বুক করেছি। নিজেদের হাতে টাকা রাখার জন্য মুম্বাই আর কলকাতায় হোটেল বুক করেছি MakemyTrip দিয়ে। দেশে থেকে আমাদের ফ্রেন্ড ফারাবী ক্রেডিট কার্ডে পে করেছে। অজন্তা-ইলোরা যাবার প্ল্যান ছিল সেটা বাদ দিয়ে গোয়াতে একদিন বেশী থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ক্যাসিনো, বার এগুলারতো প্রশ্নই আসে না।
এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের হোটেল ৭ কিলোমিটার দূরে। ট্যাক্সিতে ভাড়া খুব বেশী হবার কথা না। কিন্তু এয়ারপোর্টে সব ট্যাক্সি বসে থাকে বাঁশ দেয়ার জন্য। চারশ রুপির নিচে কেউ যাবে না। এর মাঝে এক মাতাল ট্যাক্সি ড্রাইভার পিছু ছাড়বে না। সে আমাদের তার গাড়িতে করেই নিয়ে যাবে। কেউ যাচ্ছে না দেখে আমরা সামনে আগাতে থাকলাম, দেখি এয়ারপোর্টের বাইরে কিছু পাওয়া যায় নাকি। কিন্তু এই এয়ারপোর্টের আশেপাশে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কিছু পাওয়া যায় না। আমরা রণে ভঙ্গ দিয়ে আবার পিছনে যাই ট্যাক্সি ঠিক করতে। আবার সেই মাতাল ড্রাইভার, সে ৩৭০ রুপিতে আমাদের নিয়ে যাবে। আমরা ৩০০ তে গেলে চলেন, নইলে ফুটেন বলে সামনে আগালাম। সে আবার পিছন থেকে ডাকে, নিশ্চয়ই ৩০০ তে রাজি হয়েছে। আমরা আবার তার কাছে গেলে সে মোটামোটি আবদার করে বলে ৩৭০ রুপি মে চলো না, বহত রাত হো গেয়া। আলম বলে, তুই ৩০০ রুপিতে নিয়ে গেলেও যাব না। অবশেষে ৩৫০ রুপিতে অন্য এক ট্যাক্সি করে গেলাম।
গোয়াতে মনে হয় হোটেল বিজনেস করে না এমন কোন ফ্যামিলি নেই। প্রত্যেক বাসায় হয় একটা ফ্লোর অথবা বিল্ডিং Air bnb তে দিয়ে রেখেছে। আমাদের রেস্ট হাউজের নাম All Seasons Guest House। ভদ্রলোকের নাম ফ্র্যানসিসকো, তার বাসার ভেতর দুইটা বিল্ডিং এর একটায় তার ফ্যামিলি থাকে, আরেকটা গেস্ট হাউজ। আমাদের রুম ছিল নিচ তলায় ডান পাশে। একটা বেডরুম, একটা কিচেন, আর একটা বাথরুম। বিছানা ছোট, ১২০ কেজি আলমের পাশে আমার জায়গা হবে না। কিচেনে দেখলাম একটা এক্সট্রা বেড রাখা আছে। টেনে এনে ফ্লোরে শুয়ে পরলাম। রাতে ঘুমটা ভাল হতে হবে। গেস্ট হাউজে থাকতে পারব ১২ টা পর্যন্ত, এর পর কোথায় যাব ঠিক নেই, আশেপাশে কোন গেস্ট হাউজ, হোটেল ফাঁকা আছে কিনা তাও জানিনা। ভাবলাম চোখ বন্ধ করি, কি হবে কালকে দেখা যাবে।
সকালে ঘুম থেকে উঠলাম ৮ টার দিকে। প্রথম কাজ হবে সাগরে নামা। মুখে হাতে যথাসম্ভব সানস্ক্রিন লোশন মেখে নিলাম। গেস্ট হাউজ থেকে বের হয়েই এক ধরণের অদ্ভুত ভাল লাগা কাজ করে। বাড়িগুলো অন্যরকম, অনেক নারকেল গাছ, সরু রাস্তা, মাঝে মাঝে দুই একটা শূকর দেখা যাচ্ছে, তবে তার কোনটাই নোংরা না। কয়েকটা বাড়ির সামনে নারকেল কেটে রোদে শুকাতে দেয়া হয়েছে, কি কারণে জানিনা। খুব খিদা তখন পেটে, বিচের পাশে গিয়ে সোজা সাগরে নামতে ইচ্ছা হল। কিন্তু আগে খাওয়া, পরে অন্য কিছু। দুইটা পাউরুটি আর মটরশুঁটি মার্কা কিছু একটা। খেতে খুব একটা ভাল না, কিন্তু সস্তা তাই খুব ভাল লাগছিল।

বগমালো বিচ

পুরো গোয়া জুড়ে একটার পর একটা বিচ। কিন্তু সবগুলোই ছোট ছোট। আমাদের কক্সবাজারের মত বিশাল না। সাগর হবে বিশাল, কূল কিনারা দেখা যাবে না। কিন্তু এই বগমালো বিচে সেই ফিলটা পেলাম না। দুই পাশে পাহাড়, মাঝখানে একটু জায়গা বিচ, সামনে একটু দূরেই একটা দ্বীপের মত কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। পুরো বিচ ফাঁকা। আমরা দুইজন বাদে কয়েকজন সাগর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। নামার কোন ইচ্ছা নেই তাদের। আর কয়েকজন সাদা চামড়ার বুড়োবুড়ি এক পাশে, সাগর পাড়ে যে চেয়ারগুলো পাওয়া যায় সেখানে শুয়ে শুয়ে সানবাথ করছে। খুব একটা সুখকর দৃশ্য না। পরে জানতে পারি আমরা যে বিচে এসেছি সেটা আসলে ফ্যামিলি নিয়ে আসার জায়গা।
আমাদের মত ইয়াংস্টাররা নাকি বাগা, ক্যালাংগুট যায়। পরে এই আফসোস আরো তীব্র হয়। যাই হোক, আপাতত আমাদের যাই আছে তাই নিয়ে সাগরে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। পানি খুব পরিষ্কার, কিন্তু নীল না, আবার কক্সবাজারের মত না, অনেকটা সেইন্টমার্টিন এর পানির মত। ঢেউ আসে, আর দুইজন মিলে সেই ঢেউ এর উপর ঝাপিয়ে পড়ি। তবে ঢেউগুলো একটু বড় বড়। আরব সাগরের ঢেউ বলে কথা। এর মধ্যে একটা ঢেউ কখন আসল খেয়াল করিনি। আমাকে মোটামোটি দুইবার উল্টেপাল্টে তীরে নিয়ে ফেলল। আমি নাক, কান, মুখ সব কিছু দিয়ে পানি খেয়েছি অনুভব করলাম। আলম আমাকে পানিতে ভেসে থাকা শিখালো। হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকতে হবে। ভুঁড়ি থাকলে শুধু ভুঁড়ি আর নাক-চোখ ভেসে থাকবে। আমি দুই একবার চেষ্টা করে ভেসে থাকতে পেরেছিও পর্যন্ত। টিচার ভাল।
গেস্ট হাউজের হোস্ট ভাল দম্পতি। মহিলা আমাদের কথা শুনলেন, কার্ড হারানো, টাকা হারানোর কথা শুনে সম্ভবত উনার কিছুটা মায়া হল। উনার এক ফ্রেন্ডের নাকি গেস্ট হাউজ আছে, আমাদের সাজেস্ট করে দিলেন। আমরা অল সিজনস এ ১৫০০ রুপি পে করেছি, কিন্তু উনি উনার বন্ধুর ওখানে আমাদের ১২০০ রুপিতে ম্যানেজ করে দিলেন। নোয়েল’স গেস্ট হাউজ, মালিকের নাম রড্রিক্স। রড্রিক্স সাহেব আমাদের নিতে আসলেন গাড়ি দিয়ে। সোজা রাস্তায় না নিয়ে, একটু ঘুরিয়ে নিয়ে গেলেন। খারাপ না, আমরাও নারকেল গাছ দেখতে দেখতে গেলাম। বাড়ি দেখে মহা খুশী। চমৎকার রুম, তাও দুইটা। একটা বেডরুম, একটা ডাইনিং রুম আর বাথরুম। ডাইনিং রুমে ডাইনিং টেবিল, আলনা, ফ্রীজ সহ সাধারণ দরকারি জিনিস সবই আছে। ১২০০ রুপিতে এত ভাল আশা করিনি। গোসল আমরা আগের গেস্ট হাউজেই করেছিলাম। এবার দুপুরে খেতে বের হতে হবে। রড্রিক্স সাহেবকে বললাম আমাদের জন্য একটা স্কুটি ম্যানেজ করতে। এখানে একটা কথা বলা দরকার। আমরা বাংলাদেশ থেকে প্ল্যান করে গিয়েছিলাম গোয়া গিয়ে হার্লে ড্যাভিডসন চালাব, নাহলে অন্তত রয়েল এনফিল্ড তো বটেই। কিন্তু বাজেট আমাদের শেষ পর্যন্ত স্কুটি ভাড়া নেয়ার কথা চিন্তা করায়।
বগমালো বিচে খাবারের দোকান খুঁজে বেড়াই, সবই এক্সপেনসিভ হবে বলে মনে হয়। শেষে সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে ঢুকে গেলাম একটায়। বাটার চিকেন আর নান। রেস্টুরেন্টটা সমুদ্রের পাশেই, খাবারও চমৎকার। সকালে দূরে থাকা দ্বীপ যেটা ভালমত দেখা যাচ্ছিল না, সেটা অনেক পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এখন, কিছু ছোট পাল তোলা নৌকা, সূর্যের আলো রিফ্লেক্ট করছে পানি। এই জিনিস এনজয় করার বদলে মাথায় চিন্তা এখন ড্রাইভিং লাইসেন্স এর। একটু দুই নম্বরি করার চেষ্টা করি। অলক, কনককে ফোন দেই, একটা দেশী ড্রাইভিং লাইসেন্স এ আলমের নাম আর লাইসেন্স নাম্বার এডিট করে লাগিয়ে দিয়ে। প্রিন্টেড কপি দিয়ে যদি কিছু একটা হয়। দুইজনের একজনও ফোন ধরে না। দেশে এসে দুইটারেই বানাব বলে ঠিক করি, এখনো এদের সাথে দেখা হয়নি। রায়হান হেল্প করে, ওর অফিসের গ্রাফিক্স ডিজাইনারকে দিয়ে একটা স্ক্যানড কপির মত দেখতে ড্রাইভিং লাইসেন্স মেইল করে। এই জিনিস দিয়ে আল্টিমেটলি কোন লাভ হয়নি, তাও প্রয়োজনে পাওয়া তো গেছে। রায়হান একটা ট্রিট ডিজার্ভ করে, যেটা বলা পর্যন্তই থাকবে, কখনো বাস্তব হবে না।

গোয়া ইন্ডিয়া Goa India

এখানে খাওয়ার পর থেকে আমি বাটার চিকেনের ফ্যান, গোয়া।

রড্রিক্স সাহেবকে বাইক খুঁজতে বলে আমরা দুইজন রুমে এসে ঘুম দেই। সূর্যাস্ত দেখার প্ল্যান ছিল, ঘুমের কাছে সব মাটি। ঘুম থেকে উঠার পর রড্রিক্স সাহেব জানান যে কোন বাইক ম্যানেজ হয়নি। তবে আমাদের খাবার জায়গার সন্ধান দিলেন একটা, ভিন্সি’স বার এন্ড রেস্টুরেন্ট। রড্রিক্স সাহেব নাকি মাঝে মাঝে সেখানে যান, খাবার বেশ ভাল এবং সস্তা। আমরা আবার বীচের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। গোয়াতে এলকোহল খুবই সস্তা। কিন্তু আমাদের দুইজন মিলে কোথাও গিয়ে তরল খেয়ে পড়ে থাকব এই জিনিস কখনো মাথায় আসেনি। বিয়ার ট্রাই করা যায়, নন-এলকোহলিক অথবা খুব কম পারসেন্টেজ আছে এরকম এলকোহল। Breezer, জ্যামাইকান ফ্লেভার, ১৫০ রুপি। বিয়ার এত টেস্টি হতে পারে আমার জানা ছিল না। বিয়ার হবে তেঁতো, মুখে নিয়ে ওয়াক থু বলে ফেলে দিব। ৫% মাত্র এলকোহল, এই জিনিসে কেউ মাতাল হয় না। আলম এতই মজা পেল যে, গোয়া ট্যুর শেষে দেখা গেল বিয়ারের পেছনে আমার চেয়ে আলমের খরচ হয়েছে বেশী। যে কিনা ঠিক করেছিল, কোন ধরণের এলকোহল ছুঁবে না। Montesberg, Budweiser, Kingfisher – সব ৫% এলকোহল। যথাক্রমে ৬০, ৪০ এবং ৩০ রুপি।
ভিন্সি সাহেব কালো একজন মানুষ। কিন্তু খুব নরম প্রকৃতির। ফিশ থালি অর্ডার করা হল। ম্যাকল ফিশ, পুরো প্লেট ভর্তি ভাত, আঁচার, ডাল, ক্রাঞ্চি একটা রুটি আর সালাদ, ৭০ রুপি। খাবার সময় মনে হচ্ছিল, পৃথিবীতে আজকেই প্রথম ভাত খাচ্ছি। খাবার নষ্ট করি বলে আমার সুনাম আছে, কিন্তু সেবার একটা ভাতের দানাও প্লেটে পড়ে থাকেনি।
খেয়ে দেয়ে আবার বিচে গিয়ে বসে থাকি, বালুর উপর সরাসরি। মোটামোটি ফাঁকা বিচ, ঢেউ এর গর্জন ছাড়া আর কিছু নেই। এরকম মোমেন্টে যার মধ্যে কাব্য আসবে না, সে মানুষ না। প্রেম উথলে উঠায় আলম তার সাবেককে ফোন দেয়। মেয়ে যখন বুঝতে পারে এটা আলম, ব্লক করে দেয় নাম্বার। আমার নাম্বার থেকে কল দেয়। আমার নাম্বারও ব্লক খায়। আমি কোন এক কাল্পনিক ক্লিওপেট্রার প্রেমে মশগুল হয়ে যাই। কাল্পনিক ক্লিওপেট্রা, আমার কাল্পনিক কল ধরে না। আলম জেমসের গান ছাড়ে ফোনে

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com