সাহস করে সঠিক উদ্দেশ্যে পথে নামলে বন্ধু মেলে, লোকে সাহায্যের হাত বাড়ায়, স্বজনেরা এগিয়ে আসে; এমনকি অচেনা মানুষও যেন আকাশ থেকে পড়ে এবং পথ দেখায়। নানা রকমের ‘ম্যাজিক’ই ঘটে।
কোক স্টুডিও বাংলার কাজ শুরু করতে গিয়ে আমাদের সঙ্গে এমন অনেক ম্যাজিক হয়েছে। এই ম্যাজিকগুলো না ঘটলে আসলে আজকের কোক স্টুডিও বাংলা হয়তো করাই হয়ে উঠত না। অথচ লিখতে বসে সব কেমন যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে!
আমাদের অফিসের ঠিক উল্টো দিকে অর্ণবের বাড়ি। কোক স্টুডিও বাংলা প্রথম সিজনের একদম শুরুর দিককার সময়। অর্ণব রোজ দুপুর বারোটা থেকে সাড়ে বারোটায় আমাদের অফিসে চলে আসত। এরপর শুরু হতো আমাদের ম্যারাথন আড্ডা। কোন গান করব, কেন করব, কী ধরনের ফিউশন করলে ইন্টারেস্টিং হবে—এমন নানান আলাপ। যা আজ পছন্দ হলো, কাল তা এক্কেবারে বাদ, তা নিয়ে আবার তুমুল ঝগড়া! এমন অযথা আলাপে কেটেছে আমাদের প্রায় দুই মাস। তবে আজ বুঝি, ওই দুই মাসের অপ্রয়োজনীয় আলাপগুলো কত প্রয়োজনীয় ছিল!
সব ঠিক। ‘হেই সামালো’ গানের রেকর্ডিং আর শুটিং দিয়ে কোক স্টুডিও বাংলার প্রথম সিজন শুরু হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজও শুরু হলো। নির্দিষ্ট হলো শুটিংয়ের তারিখ।
কিন্তু বিধি বলল, একটু দাঁড়া। ঠিক শুটিংয়ের দিন কোভিড পজিটিভ রিপোর্ট এল অর্ণবের। ফলে প্রথম দিনই বাতিল হলো শুটিং। ব্যস, সব পরিকল্পনা আবার নতুন করে করো।
মজার ব্যাপার হলো, প্রথম সিজনের প্রথম দুই গানের রেকর্ডিং ও শুটিংয়ে অর্ণব আমাদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিল অনলাইনে। আর যে ‘হেই সামালো’ দিয়ে সিজনটি শুরু হওয়ার কথা ছিল, তার শুটিং হলো সবার শেষে। প্রথমে চলে এল ‘নাসেক নাসেক’।
‘নাসেক নাসেক’ নিয়েও কত কাণ্ড! গানের প্রাথমিক ভার্সনে অনিমেষের সঙ্গে ‘দোল দোল দুলুনি’ গেয়েছিল আমাদের শায়ন। টিমের বাকি সবাই শায়নে রাজি, কিন্তু আমার আর অর্ণবের শুধু মনে হচ্ছিল, পান্থ কানাইকে দিয়ে একবার গাইয়ে দেখা উচিত।
পরে অর্ণব যখন পান্থকে দিয়ে গানটা গাওয়াল, তখন গানের চেহারাই গেল পাল্টে! আর এই গানের মধ্য দিয়েই তো রকস্টার হয়ে উঠল ‘অচেনা’ অনিমেষ। তবে কি জানেন, মঞ্চ থেকে নামার পর অনিমেষকে চিনতেই পারবেন না আপনারা—একদম যেন লাজুকলতা, ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। কিন্তু মঞ্চে উঠলেই কোথা থেকে কী যেন হয়ে যায় ওর, একদমই বদলে যায়। ‘নাসেক নাসেক’–এর অনিমেষ মঞ্চে উঠে যে শুধু নিজেকেই বদলে ফেলে বা বদলায়নি, তা নয়, কোক স্টুডিও বাংলার প্রথম সিজনের এই প্রথম গান আমাদের ভাগ্যও বদলে দিয়েছিল।
অথচ বাকি আরও অনেক কিছুর মতো প্রথম গান কোনটা হবে, তা নিয়ে অনেক দ্বিধা ছিল আমাদের। তবে ওই যে বলে, ভাগ্য সব সময় সাহসীদের পক্ষে থাকে। তাই ‘নাসেক নাসেক’কে প্রথম গান হিসেবে রিলিজ করার সাহসী সিদ্ধান্ত আমাদের নিরাশ করেনি।
যেদিন প্রথম শুভ আমাদের লাতিন ধুনে ‘বুলবুলি’ শুনিয়েছিল, পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। ধরেই নিয়েছিলাম শুভই গাইবে বুলবুলি। কিন্তু পরে মনে হলো, যতই ফিউশন করি না কেন, রাগসংগীত জানা কাউকে দিয়েই ঠিক সুরে গানটা করাতে হবে। শেষ পর্যন্ত তাই বুলবুলি গাইল ঋতুরাজ আর নন্দিতা। আমি নন্দিতার অংশের সুরটুকু করার সময় অর্ণবের ম্যাজিক দেখেছি। আমাদের অফিসে বসে গিটারে হুট করেই সুরটা তৈরি করেছিল অর্ণব। আর আমি সেই উত্তেজনায় ওখানে বসেই ওই সুরের ওপর নন্দিতার অংশটুকু লিখে ফেলেছিলাম। আসলে মুহূর্তটা ছিল জাদুর মতো।
‘ভবের পাগল’–এর র্যাপ অংশের আলোচনার জন্য প্রথম যেদিন ‘জালালি সেট’ আমাদের অফিসে এল, সেদিন র্যাপার সাফায়েত কি কাপড় পরে এসেছিল বলতে পারবেন কেউ?
টাক–ইন করা শার্ট আর ফরমাল প্যান্ট, গলায় টাই। ভাবা যায়! আমি বললাম, ‘কী ব্যাপার?’ সাফায়েতের উত্তর, ‘অফিস থেইকা আসছি, ভাই। কী করুম?’
‘জালালি সেট’–এর রিদম প্যাটার্ন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অর্ণবের প্রথম খুব স্ট্রাগল করতে হয়েছিল। মেহেদিরও র্যাপের কিছু অংশ লিখতে বেশ কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু শেষ অব্দি ‘ভবের পাগল’—‘পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না’ প্রথম সিজনের সবচেয়ে হিট গান হলো।
পাগল ছাড়া আসলেই দুনিয়া চলে না! অনেক ‘পাগল’ একসঙ্গে হয়েই না কোক স্টুডিও বাংলা!
‘চিলতে রোদে’ গানটা নিয়েও পাগলামি কম হয়নি। এই গানের কথা অর্ণব কোথায় খুঁজে পেয়েছিল, জানেন?
শান্তিনিকেতনে তাঁর এক বড় ভাইয়ের প্রেমপত্র থেকে। চুরি করে সেই প্রেমপত্র পড়ার পর টুকিলিফাই করে তা রেখে দিয়েছিল নিজের কাছে। ওই একচিলতে প্রেমপত্র থেকেই তৈরি হলো ‘চিলতে রোদে’। এই গানের প্রার্থনা অংশের জন্য সুদূর রাজস্থান থেকে খরতাল বাজনদার নিয়ে এসেছিলাম। মনে হয়েছিল, মরুভূমির মানুষগুলো নিশ্চয়ই পানির জন্য আমাদের চেয়ে বেশি হাহাকার করে। তাই বুঝি খরতালের আওয়াজ অমন তৃষ্ণার্ত। তিন দিন ধরে ক্লান্ত হয়ে রাজস্থান থেকে যারা এল, তারাই আবার ১৪ দিনের জন্য আটকে গেল ঢাকায়, করোনার চক্করে।
মনে আছে, ‘চিলতে রোদে’–এর সময় সবার সে কী টেনশন! ভাওয়াইয়া গাওয়ার মানুষ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, ঢাকায় কোনো ভাওয়াইয়াশিল্পী নেই। এ অবস্থায় অর্ণবের তো মাথায় হাত। এর দুদিন পর হঠাৎ ফোন দিল সে, গলায় উত্তেজনা, ‘অফিসে আছেন?’
বললাম, ‘আছি।’
এরপর ‘আসছি’ বলেই ফোন রেখে দিল অর্ণব। খানিক বাদে চলে এল অফিসে। অর্ণব আসার পরই সেই প্রথম ওর ফোনে রেকর্ড করা বগার (বগা তালেব) দরাজ গলায় শরীর হিম করা ভাওয়াইয়া শুনলাম। উফ…কী সব সময়!
সুখস্মৃতির মতো করে কোক স্টুডিও বাংলার কত গল্পই তো বলে ফেলা যায় আজ! আপনাদের ভালোবাসায় কোক স্টুডিও বাংলা এখন অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। এই ভালোবাসাটুকু না থাকলে স্মৃতিগুলোই হয়ে যেত দুঃস্বপ্নের মতো দুঃসহ।
হ্যাঁ, দুঃস্বপ্নের ভয় আমরা কোক স্টুডিও বাংলার কনসার্টের সময়ও পেয়েছিলাম। সকাল থেকে বৃষ্টি, থামার নাম নেই। ওদিকে বিকেল থেকেই মাথায় বৃষ্টি নিয়ে ১০ হাজার দর্শক বসে আছেন গ্যালারিতে। কী টেনশন আমাদের! এত টেনশন অনেক দিন করিনি। কিন্তু আবারও সেই ম্যাজিক ঘটল। রাত আটটা বাজতে না বাজতেই কেমন করে যেন আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল আকাশ, মাথার ওপরে চাঁদ। মনে হলো, এ যেন ঈদের চাঁদ।
স্মৃতির ঝাঁপি একবার খুললে তা বন্ধ করা বড্ড মুশকিল। অনেকের কথাই তো বলা হলো না। আবীর রাজবীনকে যন্ত্রণা দেওয়ার কথা, বুনোকে ‘ক্যাপ্টেইন কেভম্যান’ নাম দেওয়ার পেছনের গল্প, শুটিংয়ের ফাঁকে ক্রিকেট খেলার গল্প, কলকাতা এয়ারপোর্টে মধুবন্তীর কোভিড পজিটিভ রিপোর্টের কারণে আটকে যাওয়ার গল্প—এমন অজস্র গল্প না বলাই থেকে গেল।
তা থাক। গল্পগুলো তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। অন্য কোনো সময়, অন্য কোনোখানে নিশ্চয় এসব গল্প বলা হবে। শেষ পর্যন্ত আসলে গল্পই থেকে যায়। আমি জানি, কোক স্টুডিও বাংলার এমন অনেক অনেক গল্প লোকের মুখে মুখে ফিরবে একদিন। তখন আমি থাকব না, অর্ণব থাকবে না; কিন্তু কোক স্টুডিও বাংলার গান আর গল্পগুলো ঠিকই রয়ে যাবে।
শেষ করব আমাদের কোকাকোলার ক্লায়েন্ট অজয় বাথিজার একটা কথা দিয়ে, যে কথা কোক স্টুডিও বাংলার ক্রিয়েটিভ প্রডিউসার হিসেবে কখনো ভুলিনি আমি। ও বলেছিল, ‘শাওন ভাই, কখনো হিট গান তৈরি করার চেষ্টা করো না; বরং যে গান তোমাদের সবচেয়ে ভালো লাগে, অমন গান তৈরি করো। দেখবে, ওই গানই মানুষের ভালো লাগবে।’
বাংলা গানের জয় হোক।