যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা এবং শিক্ষাগ্রহণ শেষে কাজের সুযোগ থাকলেও, তাদের পরিবারের সদস্যদের দেশটিতে আসার অনুমতি আর দেওয়া হবে না। অভিবাসন সীমিত করার পদক্ষেপ হিসেবে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাজ্য সরকার। আগামী বছর থেকে এই সিদ্ধান্তটি কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে।
মঙ্গলবার যুক্তরাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীরা তাদের পরিবারকে যুক্তরাজ্যে আনার অধিকার হারাবেন। গত বছর যুক্তরাজ্যে রেকর্ড সংখ্যক অভিবাসী এসেছেন। অভিবাসনের লাগাম টেনে ধরার অংশ হিসেবেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দেশটির রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের অগ্রাধিকার খাতগুলোর একটি অভিবাসন কমানো। এমনকি নিয়মিত অভিবাসনও কমিয়ে আনতে চান তিনি। গত সপ্তাহে তিনি বলেছেন, আগামী বছর যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনের আগেই নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অভিবাসনের হার নিয়ন্ত্রণ করতে নানা পদক্ষেপের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে।
দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্র্যাভারম্যান বলেছেন, পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত অভিবাসনকে ‘যথেষ্টভাবে’ কমাতে সাহায্য করবে। ব্রিটেনে কাজ খোঁজার জন্য পেছনের দরজা হিসেবে স্টুডেন্ট ভিসা ব্যবহারও বন্ধ হবে।
নতুন নিয়ম অনুযায়ী স্নাতকোত্তর পর্যায়ের যেসব শিক্ষার্থী গবেষণার জন্য মনোনীত হন এবং দুই বছরের বেশি সময় ধরে যুক্তরাজ্যে বসবাস করবেন, তারা অবশ্য আগের মতো পরিবারের সদস্যদের আনার সুযোগ পাবেন।
এক বিবৃতিতে সুয়েলা ব্র্যাভারম্যান আরও বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, শিক্ষার্থীদের পরিবারের সদস্য হিসাবে ভিসা নিয়ে যুক্তরাজ্যে আসা মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা এখানে পড়াশোনা করতে আসার মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। তবুও আমাদের দেশের জনগণের জন্য সরকারি পরিষেবা সুরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে এটি একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত।’
বর্তমান নিয়ম অনুসারে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের কোর্স যদি নয় মাস বা তার দীর্ঘ হয়, তবে তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের নিজের কাছে নিয়ে আসার অনুমতি দেয় যুক্তরাজ্য। কিন্তু সরকার বলছে, শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে ‘স্পাউস ভিসা’ নিয়ে আসা মানুষের সংখ্যা ২০১৯ এর তুলনায় বর্তমানে আট গুণ বেড়েছে। ২০১৯ সালে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্ভরশীল কোটা বা স্পাউস ক্যাটাগরিতে ১৬ হাজার ভিসা দিয়েছিল দেশটি। গত বছর তা এক লাখ ৩৬ হাজারে উন্নীত হয়েছে।
২০১৬ সালের ব্রেক্সিট গণভোটের অন্যতম কারণ ছিল অভিবাসন ইস্যু। কিন্তু তারপরেও অভিবাসন ইস্যুতে কাঙ্ক্ষিত সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি দেশটি। ফলে, নিয়মিত অভিবাসন, অনিয়মিত অভিবাসনের হার বেড়ে যাওয়া, জনসেবার ওপর চাপ তৈরি হওয়ার মতো বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে।
সরকারের এই নতুন সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে, পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগে স্টুডেন্টস ভিসাকে কাজে লাগিয়ে চাকরি খোঁজার সুযোগও বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্র্যাভারম্যান।
তবে, পড়াশোনা শেষে শিক্ষার্থী ভিসায় আরও দুই বছর থেকে চাকরি খোঁজার যে সুযোগটি এতদিন ছিল, সেটি ঠিক থাকবে। সেখানে পরিবর্তন আনার কোনো পরিকল্পনা নেই বলেও নিশ্চিত করেছে সরকার।
গত বছর নিয়মিত অভিবাসনে ইস্যু করা চার লাখ ৮৬ হাজার ভিসার মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশটি ছিল শিক্ষার্থীদের পরিবারের সদস্যরা৷ ব্রেক্সিটের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানুষের অবাধ চলাচলও বন্ধ করে দিয়েছে ব্রিটেন। কিন্তু গত বছর দেশটিতে রেকর্ড সংখ্যক অভিবাসী এসেছেন।
এদের বেশিরভাগই হলেন ইউক্রেন, হংকং এবং আফগানিস্তানের রাজনৈতিক সংকট থেকে পালিয়ে আসা মানুষ৷ একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিবার অর্থাৎ স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানদের সংখ্যাও বেড়েছে, বিশেষ করে ভারত ও নাইজেরিয়া থেকে প্রচুর সংখ্যক অভিবাসী এসেছেন শিক্ষার্থীদের পরিবারের সদস্য হিসেবে৷
আন্তর্জাতিক অঙ্গণে ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা ইউনিভার্সিটিজ ইউকে ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক জেমি অ্যারোস্মিথ অবশ্য সরকারের এমন সিদ্ধান্তে খুব একটা সন্তুষ্ট নন। এই সিদ্ধান্ত অভিবাসনের মাত্রাকে কতোটা হ্রাস করবে, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন তিনি।
বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা তাদের পরিবারকে সঙ্গে আনেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তাই এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশকে খুব একটা প্রভাবিত করবে না।’
তবে একেবারে প্রভাব থাকবে না এমনটাও মনে করছেন না তিনি। বলেন, ‘অবশ্যই কিছু প্রভাব থাকবে, না হলে তো সরকার এমন পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো না।’
তবে অভিবাসনের প্রভাবটি কমাতে বিশ্ববিদ্যালয় খাতের সঙ্গে পরামর্শের আহ্বান জানিয়েছেন জেমি অ্যারোস্মিথ।
২০১৮ সাল থেকে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে অসংখ্য অভিবাসী আসছেন যুক্তরাজ্যে। তারা এসেই আশ্রয় আবেদন করছেন। ফলে অভিবাসীদের তৃতীয় দেশে স্থানান্তরে আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডার সঙ্গে একটি চুক্তিও করেছে দেশটির সরকার। কিন্তু আইনি জটিলতায় সেই প্রকল্পটি এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
শিক্ষাবিদদের প্রতিনিধিত্বকারী বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জো গ্র্যাডি সরকারের এমন সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘এটি অভিবাসীদের ওপর এক ধরনের আক্রমণ এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অবমূল্যায়নে সরকারের একটি বাজে সিদ্ধান্ত এবং আরেকটি গভীর লজ্জাজনক মুহূর্ত।’