লি কুয়ান ইউ ছিলেন সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধান মন্ত্রী। বর্তমান সিঙ্গাপুরের চেহারা বদলে দেয়ার মহানায়ক বলা হয়ে থাকে এই লি কুয়ান ইউকে। কুয়ান ইউ শব্দের অর্থ হলো “উজ্জ্বল আলো”। যে আলোর ছোঁয়ায় বদলে গিয়েছে ছোট একটি দেশ সিঙ্গাপুর।
তিনি যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন তখন সিঙ্গাপুরের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র 500 মার্কিন ডলার। সেখান থেকে লি কুয়ান ইউর প্রধান মন্ত্রিত্বের শেষ বছর তা গিয়ে দাঁড়ায় সাড়ে 14 হাজার মার্কিন ডলার। অর্থাৎ প্রায় 2800 শতাংশ বৃদ্ধি। আর বর্তমানে সিঙ্গাপুরের মাথাপিছু আয় প্রায় 53 হাজার মার্কিন ডলার বা 40 লক্ষ টাকা।
কি! ভাবতে অবাক লাগছে তো? তাহলে চলুন আজ জেনে নেওয়া যাক একটি ভঙ্গুর জায়গা থেকে কিভাবে হয়ে উঠলো আজকের এই সিঙ্গাপুর?
1957 সালে মালয়েশিয়ার সাথে ফেডারেশন গঠন করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে সিঙ্গাপুর। তার ঠিক দুই বছর পরেই নির্বাচনে জিতে সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান লি কুয়ান ইউ। কিন্তু আদর্শিক কারণে 1965 সালে মালয়েশিয়ার সাথে দুঃখজনক বিচ্ছেদের পর লি হাতে পান ভঙ্গুর এক দেশ। সেই থেকে শুরু শক্ত হাতে সবকিছু মোকাবেলা করে সিঙ্গাপুরকে নিয়ে এসেছেন আজকের অবস্থানে।
কিন্তু তার এই পথ চলাটা কিন্তু খুব একটা সহজ ছিল না। একটি দেশ গড়ার কাজে শুরুতে যে জিনিসটি প্রয়োজন তা হলো জাতিগত ঐক্য। কিন্তু সিঙ্গাপুর বিভিন্ন ধর্ম বর্ণ জাতির দেশ। সংখ্যাগরিষ্ঠ চীনা বংশোদ্ভূত দের সাথে বৃহৎ সংখ্যক মালয় এবং ভারতীয়। এদের মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকত। কিন্তু ক্ষমতা নেওয়ার কয়েক বছরের মাথায় এই সমস্যার সমাধান করে ফেলেন তিনি।
যেকোনো রকম অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি কারীদের বিরুদ্ধে নেন কঠোর আইনি ব্যবস্থা। আয়তনে একেবারেই ছোট একটি দেশ। নেই তেমন কোনো প্রাকৃতিক সম্পদও। কিন্তু এইসবের পরেও লির চোখে উচ্চাকাঙ্খার কমতি ছিল না।
ক্ষমতায় এসে প্রত্যেকের জন্য সরকারি আবাসন নিশ্চিত করলেন। কারণ তার ধারণা ছিল এই শহরে যখন কেউ একটি বাড়ির মালিক হবে শহরটির ব্যাপারে তার আরো বেশি দায়িত্ব ও মমত্ববোধ সৃষ্টি হবে। বাড়ি তো হলো এবার প্রয়োজন কর্মসংস্থান। কিন্তু এত ছোট দেশে শিল্প কারখানা স্থাপনের জায়গা কোথায়? তবে এটি যেমন ছিল অসুবিধা তেমনি অন্যদিকে সুবিধাও। সুবিধা এই অর্থে যে ছোট একটি দেশ বলে একে সবুজ পরিপাটি বানিয়ে বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ সহজ হবে। তিনি সেই সুযোগটাই নিলেন। সবুজ ও পরিচ্ছন্ন শহর নির্মাণে দিলেন সর্বোচ্চ গুরুত্ব। রাস্তার ধারে সারিবদ্ধ গাছ তো বটেই, পুরো সিঙ্গাপুরের 10 ভাগ জায়গা জুড়ে রয়েছে কেবল উদ্যান ই।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এতটাই কড়াকড়ি যে দেশটিতে চুইংগাম খাওয়াই নিষিদ্ধ। সিঙ্গাপুর ছোট্ট একটা দেশ। সেখানে লক্ষ লক্ষ প্রাইভেট কার চললে দুই দিনে দেশের রাস্তা অচল হয়ে যাবে। তাই তিনি নিশ্চিত করলেন উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থার।
এখন নিশ্চয়ই মনে প্রশ্ন জাগছে এই উন্নয়নের জন্য সিঙ্গাপুর এত টাকা পেল কোথায়? যা দিয়ে এমন অভূতপূর্ব উন্নয়ন সম্ভব! এর উত্তর হলো 1973 সালে যখন আমেরিকান ডলারের সাথে স্বর্ন মজুদ ব্যবস্থার বিচ্ছেদ হয় তখন লি কুয়ান ইউ তার চুড়ান্ত ফায়দা নেন।
এশিয়ার ডলারের বাজার তৈরিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয় তার সরকার। এমনকি বিশ্বব্যাপী মুদ্রা বিনিময়ে শীর্ষে উঠে আসে সিঙ্গাপুর। সেই সঙ্গে মার্কিন নীতি এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতি অনুরাগের জন্য মাথার উপর ছিল বিশ্ব ব্যাংক এবং ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড।
অন্যদিকে মন্ত্রী এবং সরকারি চাকুরিজীবি দের বিশাল অঙ্কের বেতন প্রদান শুরু করলেন তিনি। যাতে তারা ঘুষ না খায় এবং আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করে। নিজে ছিলেন প্রচন্ড সৎ এবং কঠোর। তাকে রীতিমত ভয় পেতেন প্রশাসনের সবাই। তাইতো তার চাপে পড়ে সিঙ্গাপুরের অভিধান থেকে মুছে গেল দুর্নীতি নামক শব্দটি।
যখন তিনি প্রথম ক্ষমতায় এলেন তখন সিঙ্গাপুরে ছিল কেবল একটি সমুদ্র বন্দর। তবে এর ভৌগলিক অবস্থান টি যে অর্থনৈতিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ন তা বুঝে ছিলেন তিনি। তাইতো উন্নয়নের বড় হাতিয়ার বানালেন এই বন্দরটিকে। ঢেলে সাজালেন সিঙ্গাপুরের সমুদ্র বন্দর, বিমানবন্দর এবং সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোকে। ফলাফলও এলো হাতেনাতে। অল্প সময়ে সিঙ্গাপুর পরিণত হল এয়ারলাইন্সগুলোর ট্রানজিট রুটে।
এইভাবে আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসেবে শক্ত আবির্ভাবের পর সিঙ্গাপুর পরিণত হয় এশিয়ার সবচেয়ে বাণিজ্যিক হাবে। কারণটা খুবই সোজা সেখানে কোনো রাজনৈতিক গোলযোগ নেই, যোগাযোগ ব্যবস্থাও রয়েছে চমৎকার, কর খুবই অল্প, সরকারও আন্তরিক আর অবকাঠামো ও পরিবেশ তো অতুলনীয়। আর এই জন্যই বর্তমানে গুগল, ফেসবুক, টয়োটা এবং পেপসি সহ এমন কোন বৈদেশিক কোম্পানি নেই যারা সিঙ্গাপুরে আঞ্চলিক সদর দপ্তর খোলেনি।
লি কুয়ান ইউ সবসময় সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্র ক্ষমতায় ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। এর ফলে কখনো তাকে কোনরকম বিদ্রোহের মুখে পড়তে হয়নি। তিনি সব সময় ছিলেন একজন পার্টির সাধারণ সম্পাদক। সবসময় চেয়েছেন দেশ সেবা করতে। এমনকি দেশ সেবার জন্য তিনি নিজের অবসর সময়টুকু পান নি।