শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৫ অপরাহ্ন

উত্তমাশার শহর কেপটাউন

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১১ মে, ২০২৩

আটলান্টিক মহাসাগরের সুনীল জলরাশি একের পর এক এসে আছড়ে পড়ছে শহরটির বুকে। চারপাশে দিগন্তজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি ছোটবড় পাহাড়। আর সেই পাহাড়ের কোলেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ছবির মতো সাজানো শহর কেপটাউন। শহরটির এক প্রান্তে ভারত মহাসাগর, অপর প্রান্তে আটলান্টিক। আর এই দুই মহাসাগরের মিলনভূমিতে সদ্যস্নাতা কুমারী কন্যার অমলিন সৌন্দর্য গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছে শহরটি।

কেপটাউনের সেই অফুরান সৌন্দর্যের রসাস্বাদন করতেই মে মাসের এক তাপদগ্ধ দিনে শহর কলকাতার অধিবাসীরা যখন হাঁসফাঁস করছে এমনই এক রৌদ্রঝরা অপরাহ্নে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে দুবাই হয়ে কেপটাউনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম  আমরা। বিমান ছাড়ল রাত সাড়ে আটটায়। ভারতবর্ষের বুকের উপর দিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে একের পর এক বহু জনপদ ও লোকালয়কে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলল বিমান। তারপর একসময় ভারতবর্ষের সীমানা পেরিয়ে পাকিস্তানের করাচি বন্দরটির খুব কাছ দিয়ে উড়তে উড়তে আরবসাগর পার হয়ে বিমানটি যখন দুবাইয়ের মাটি স্পর্শ করল, আমাদের ঘড়িতে তখন সময় রাত সাড়ে বারোটা।

দুবাই বিমানবন্দরটি আয়তনে যেমন বিশাল, তেমনই ঝাঁ চকচকে। আলোয় আলোয় ঝলমলে দুবাই বিমানবন্দর থেকে অপর একটি বিমানে করে আমরা যখন আফ্রিকা মহাদেশের শেষ প্রান্তে অবস্থিত কেপটাউনের দিকে যাত্রা শুরু করলাম, তখন মাঝরাত পেরিয়ে গিয়েছে। প্রায় সাড়ে ন’ঘণ্টার যাত্রাপথ। সুদীর্ঘ এই আকাশপথে যেতে যেতে একের পর এক পেরিয়ে যেতে থাকলাম সোমালিয়া, কেনিয়া, তানজানিয়ার মতো আফ্রিকা মহাদেশের ছোট-বড় দেশগুলি। বিমানটি  তখন ভূপৃষ্ঠ থেকে ছত্রিশ হাজার ফুট উঁচুতে সাঁতার কেটে চলেছে।

পরদিন সকাল ১১টা ৪৫’এ নামলাম কেপটাউনে। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখি আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে জ্যাক। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা এক হাসিখুশি কৃষ্ণাঙ্গ যুবক। কেপটাউন ভ্রমণে ওই হবে আমাদের গাইড বা পথপ্রদর্শক।

দেখি সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস। জ্যাকের নির্দেশে উঠে বসি বাসে। প্রথমেই আমরা রওনা দিই কেপটাউনের অন্যতম দর্শনীয় স্থান টেবল মাউন্টেনের দিকে। পথের দু-ধারে ছড়িয়ে থাকা আকাশচুম্বী অট্টালিকার সারির মধ্য দিয়ে যেতে যেতে টেবল মাউন্টেনটি সম্পর্কে  বেশ কয়েকটি তথ্যও আমাদের জানিয়ে দেয় জ্যাক। শুনি, টেবল মাউন্টেনের উপরটা অনেকটা  টেবলের মতো। ওখানে বিভিন্ন উপহার সামগ্রীর দোকান তো রয়েছেই, তাছাড়াও রয়েছে চা, কফি  ও অন্যান্য পানীয় দ্রব্যের স্টল। কেবল-কারে চড়ে টেবল মাউন্টেনের উপরে উঠলে পুরো কেপটাউন শহরটির দৃশ্যই বড় অপরূপ দেখায়।

কিন্তু আমরা যখন টেবল মাউন্টেনের দোরগোড়ায় গিয়ে পৌঁছই, তখন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় কেবল-পরিষেবা বন্ধ। খানিক বাদেই শুরু হয় গুঁড়িগুড়িঁ বৃষ্টি। অগত্যা  পরদিন আবার আসব জানিয়ে জ্যাক আমাদের নিয়ে হাজির হয় আটলান্টিকের তীরে। বেশ উঁচু করে বাঁধানো সমুদ্রসৈকত। একের পর এক সুনীল জলরাশি সবেগে এসে আছড়ে পড়ছে তীরে। তীর বরাবর পরপর দাঁড়িয়ে আছে বহুতল অট্টালিকার সারি। পিছনে অনুচ্চ পাহাড়। এককথায় অনির্বচনীয় নৈসর্গিক পরিবেশ।

সামনে মহাসাগরের উত্তাল জলরাশির দিকে তাকালে চোখে পড়ে একটি ছোট্ট দ্বীপ। জ্যাক জানায়, ওই দ্বীপটিই হল রবেন আইল্যান্ড। ওখানেই একটি কারাগারে ১৯৬৪ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ আঠারো বছর বন্দিজীবন কাটিয়েছিলেন আফ্রিকাবাসীদের মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম জননেতা প্রবাদপ্রতিম নেলসন ম্যান্ডেলা। পরে তাঁকে অন্য একটি কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৯০ সালে মুক্তি পাওয়ার আগে পর্যন্ত সেখানেই বন্দি ছিলেন তিনি।

ক্রমে সন্ধে নামে। পতিগৃহে নববধূর প্রথম পা ফেলার মতো লাজুক ছন্দে ছায়া ঘনায় আটলান্টিকের বুকে, পাহাড় চূড়ায়, উঁচু বাড়িগুলির মাথায় মাথায়। সেদিনের মতো ভ্রমণ সাঙ্গ করে আমরা রওনা দিই হোটেলের পথে। ঘরে ঢুকে জানলা খুলে বাইরে তাকাতেই চোখে পড়ে দীপাবলির রাতের মতো আলোর মালায় সাজানো কেপটাউন বন্দরটিকে।

পরদিন সকালে আবার আমরা রওনা দিই টেবল মাউন্টেনের পথে। কিন্তু এদিনও বৃষ্টির জন্য কেবল পরিষেবা বন্ধ থাকায় ফিরে আসি আমরা। টেবল মাউন্টেনে চড়ার স্বপ্ন অধরাই রয়ে যায়। আমাদের মনখারাপ দেখে জ্যাক জানায়, কেবল-কারে চড়ে টেবল মাউন্টেন দেখা হল না ঠিকই, ও আমাদের নিয়ে গেল সিগন্যাল পয়েন্টে। যেখান থেকে টেবল মাউন্টেন খুব কাছ থেকে দেখা যায়।

পৌঁছে দেখি, সত্যিই তাই। প্রায় ঢিলছোঁড়া দূরত্বেই দাঁড়িয়ে রয়েছে টেবল মাউন্টেন। বোঝাই যায়, পাহাড়ের উপর দিকটা প্রায় সমতল। আবার এই পাহাড়েরই একদিকের বেশ কিছুটা  অংশ অবিকল সিংহের মাথার আকৃতি পাওয়ায় নাম দেওয়া হয়েছে লায়নস হেড। একসময় এই সিগন্যাল পয়েন্ট থেকেই শত্রু আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সংকেত পাঠাতেন তদানীন্তন শ্বেতাঙ্গ শাসকরা। সম্ভবত সেজন্যই এমন নাম। তবে জায়গাটির প্রাকৃতিক দৃশ্য অসাধারণ।

বেশ কিছুক্ষণ সিগন্যাল পয়েন্টে কাটিয়ে আমরা রওনা দিই সিল আইল্যান্ডের পথে। পরিচ্ছন্ন রাস্তা ধরে এগিয়ে চলে আমাদের বাস। বেশ কিছুটা পথ চলার পর আমরা এসে পৌঁছই হাউট বে জেটিঘাটে। এখান থেকে পর্যটকদের লঞ্চে করে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয় আটলান্টিকের বুকে অবস্থিত সিল আইল্যান্ডে।

প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার সফর। কিন্তু পাহাড় ঘেরা পরিবেশে উত্তাল মহাসাগরের বুকে  এই ছোট্ট জলভ্রমণটুকুই অসাধারণ হয়ে ওঠে। যেদিকে তাকাই সেদিকেই প্রকৃতির মাতাল করা রূপ আমাদের মন কেড়ে নেয়। প্রকৃতির এই উজাড় করা রূপ দেখতে দেখতেই পৌঁছে যাই সিল দ্বীপে। দেখি ছোট বড় নানা আকারের সিলের ছড়াছড়ি পুরো দ্বীপ জুড়ে। কেউ ভাসছে জলে আবার কেউ বা পরম নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিচ্ছে রুক্ষ পাথরের উপরে।

এখানে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়েই লঞ্চ মুখ ঘোরায় জেটির দিকে। উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে তীরে  পৌঁছে দেখি একদল আফ্রিকান সঙ্গীতশিল্পী রংচঙে পোশাক পরে নেচে গেয়ে মুখর করে তুলেছেন সমগ্র এলাকাটিকে। শুনলাম, প্রতিদিনই এভাবে নাচগান করে পর্যটকদের কাছে দু’চারপয়সা যা-হয় রোজগার করেন ওঁরা। এটাই জীবিকা ওঁদের। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওঁদের নাচগান দেখে রওনা দিই বহু স্বপ্নলালিত কেপ অফ গুড হোপ বা উত্তমাশা অন্তরীপের পথে।

যেতে যেতে পাহাড় ঘেরা এই স্নিগ্ধ শহরটির অনাবিল সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করে তোলে। ঝাঁ-চকচকে রাস্তাঘাট। ধুলোবালি তো দূরের কথা, একটুকরো কাগজও পড়ে নেই কোথাও। মে মাসেও প্রচণ্ড ঠান্ডা এখানে।

দু’খানা সোয়েটার গায়ে দিয়েও কাঁপতে থাকি শীতে। পথের অফুরান সৌন্দর্য দেখতে দেখতে অল্প সময়ের মধ্যেই এসে পড়ি আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের সর্বশেষ  অংশ কেপ অফ গুড হোপ-এ। জল, স্থল আর পাহাড় মিলেমিশে যে কী অনির্বচনীয় সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে তা এখানে না এলে ধারণাই করা যায় না।

কথায় কথায় জ্যাক জানায়, বিশ্বের দুই বিপরীতধর্মী জলের স্রোত, পশ্চিম দিকে ঠান্ডা ও পূর্বদিকে গরম জলের স্রোতে সমৃদ্ধ কেপ অব গুড হোপ আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরের মিলনস্থান। একদিন এখান থেকেই ভাস্কো-দা-গামা এশিয়া মহাদেশের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত কালিকট বন্দরে এসে পৌঁছেছিলেন, যে ঘটনা আজ ইতিহাস। তাকিয়ে  দেখি, মহাসাগরের তীরবর্তী এই এলাকার বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে আপনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছে বেবুন, উটপাখি, হরিণ ও জেব্রার দল। গাইডের কথায় জানতে পারি, শুধু এই অঞ্চলেই নাকি বিশ্বের বৃহত্তম অ্যান্টিলোপের দেখা পাওয়া যায়।

উত্তমাশা অন্তরীপে বেশকিছু সময় কাটিয়ে আমরা রওনা দিই কেপ-পয়েন্টের দিকে। ওখানেই পাহাড় চূড়ায় তৈরি করা হয়েছে সুউচ্চ এক লাইটহাউস। সেই লাইটহাউস লক্ষ্য  করেই এগোতে থাকি আমরা।

উত্তমাশা অন্তরীপ থেকে এক কামরার একটি ছোট্ট ট্রেনে করে উঠতে হয় বেশ কিছুটা পাহাড়ি পথ। সেখান থেকে বেশ কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠলেই লাইটহাউস। সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আমরাও একসময় পৌঁছে যাই লাইটহাউসের কাছে।

পাহাড় শীর্ষে উঠে লাইটহাউসের পাশে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক অসাধারণ দৃশ্য। আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের এই শেষ অংশটি তার সবটুকু সৌন্দর্য নিয়ে আমাদের চোখে ধরা দিল। অনেকক্ষণ ধরে সেই স্বর্গীয় সৌন্দর্যের দিকে আপনমনে তাকিয়ে থাকি বিস্ময়ে।

সম্বিৎ ফেরে গাইডের ডাকে। জ্যাক বলে ওঠে, এবার আমরা যাব পেঙ্গুইন কলোনিতে। কেপ পয়েন্টের খুব কাছেই এই পেঙ্গুইন কলোনি। অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে যাই আমরা। প্রশস্ত তটভূমি। তবে সমুদ্রতীর এখানে খুবই অগভীর। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখি সেই অগভীর সমুদ্রতীরে দু-দিকে ডানা মেলে আপনছন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে অগণিত পেঙ্গুইনের দল। একদল ভাসছে স্বচ্ছ নীল জলের উপর। ওদের সমবেত চিৎকারে মুখর হয়ে উঠেছে সমস্ত এলাকাটি। এ ওদের একান্ত নিজস্ব জগৎ। যেখানে ওরাই সম্রাট।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ওদের কাণ্ড-কারখানা দেখি। তারপর একরাশ তৃপ্তি নিয়ে রওনা দিই হোটেলের দিকে। বাসে করে ফেরার সময় জ্যাক জানিয়ে দেয়,
নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী কেপটাউনে আজই আমাদের শেষ। রাত। পরদিন সকালেই আমরা রওনা দেব দক্ষিণ আফ্রিকার আর-এক সমৃদ্ধ শহর, অস্ট্রিচ রাজধানী বলে  খ্যাত, আউটশোর্ন-এর পথে।


কীভাবে যাবেন

কলকাতা থেকে কেপটাউন যাওয়ার সরাসরি কোনও বিমান নেই। যেতে হয় দুবাই  কিংবা নাইরোবি হয়ে। আকাশপথে কেপটাউন পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় ১২ ঘণ্টা।

কোথায় থাকবেন

কলকাতার বেশ কয়েকটি ভ্রমণসংস্থা দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্রমণের ব্যবস্থা করে। ১০-১২ দিনের প্যাকেজে থাকা, খাওয়া, ঘোরা ও আসা-যাওয়ার বিমান ভাড়া সহ  আনুমানিক প্যাকেজ মূল্য প্রায় দু’লক্ষ টাকার কাছাকাছি।

কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য

দক্ষিণ আফ্রিকার মুদ্রার নাম রান্ড(Rand)। বিনিময় মূল্য জেনে নেবেন যাওয়ার আগে।
ভারতীয় সময় থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার সময় সাড়ে তিন ঘণ্টা পিছিয়ে। অর্থাৎ আমাদের  এখানে সকাল দশটা হল ওদেশের ভোর সাড়ে ছ-টা।

ইংরেজি ভাষাতেও বেশ সাবলীল দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ।

দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্রমণের ভাল সময় এপ্রিল থেকে জুন এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com