শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৫৬ অপরাহ্ন

ভারতে হাজার হাজার নারী ‘ইসলামিক স্টেটে যোগদানের’ গল্প নিয়ে সিনেমা, বিতর্ক তুঙ্গে

  • আপডেট সময় বুধবার, ৩ মে, ২০২৩

ভারতে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নামে মুক্তি পেতে চলা একটি সিনেমার ট্রেলারে দেখানো হয়েছে যে কেরালা রাজ্যের ৩২ হাজার নারীকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করে তাদের তথাকথিত ইসলামিক স্টেট জঙ্গি গোষ্ঠীতে পাঠানো হয়েছে।

ট্রেলারটির সঙ্গে ইউটিউবে যে ডেসক্রিপশন দেওয়া হয়েছে, তাতে দাবি করা হয়েছে, ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ এক “হাড় হিম করা যে সত্য কাহিনী,যা এর আগে কখনও বলা হয়নি।“

কেরালার কমবয়সী তিন নারীর সত্য ঘটনা অবলম্বনে ওই সিনেমাটি তৈরি করা হয়েছে। আবার একই সঙ্গে এটাও লেখা হয়েছে যে হাজার হাজার নির্দোষ নারীকে পরিকল্পনা করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে, তাদের কট্টরপন্থী করে তুলে জীবন ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

ছবিটি হিন্দু, তামিল, তেলুগু এবং মালয়ালাম ভাষায় মুক্তি পাবে ৫ই মে।

'দ্য কেরালা স্টোরি' : ৩২ হাজার নারী কেরালা থেকে ইসলামিক স্টেটে চলে গেছেন বলে দেখানো হয়েছে এই সিনেমায়

ছবির উৎস,SUNSHINE PICTURES/YOUTUBE

ছবির ক্যাপশান,
‘দ্যা কেরালা স্টোরি’ : ৩২ হাজার নারী কেরালা থেকে ইসলামিক স্টেটে চলে গেছেন বলে দেখানো হয়েছে এই সিনেমায়

ট্রেলারটি প্রকাশের পরে তার কাহিনী নিয়ে মাদ্রাজ হাইকোর্টে মঙ্গলবার জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সিনেমায় বর্ণিত কাহিনী যদি সত্য হয়, তাহলে তা ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত শঙ্কার।

কেরালার মুখ্যমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দল সিপিআইএম বলছে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ আসলে ধর্মান্তরকরণ, লাভ জিহাদ ইত্যাদি নিয়ে আরএসএস যে মিথ্যা ভাষ্য প্রচার করে, এই সিনেমায় সেটাকেই দেখানো হয়েছে।

অন্যদিকে বিজেপি বলছে, সংখ্যাটা ৩২ হাজার না ১০ হাজার, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু কেরালা থেকে যে শত শত নারীকে ধর্মান্তরিত করে আইএস জঙ্গি হিসাবে পাঠানো হয়েছে, সেটা সত্যি।

ইউটিউবে আপলোড করার পরে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র ট্রেলারটি মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এক কোটি ৭২ লক্ষ মানুষ দেখেছেন এবং সেখানে কমেন্ট পড়েছে প্রায় এক লাখ।

এর বাইরে টু্‌ইটার, ফেসবুকেও ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে এই সিনেমা নিয়ে।

আই-এস জঙ্গীদের হাতে পণবন্দী থাকা কেরালার ৪৬ জন নার্স দেশে ফিরে আসতে পারেন ২০১৪ সালে

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,
আই-এস জঙ্গীদের হাতে পণবন্দী থাকা কেরালার ৪৬ জন নার্স দেশে ফিরে আসেন ২০১৪ সালে

নারীর সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক

এই চলচ্চিত্রটি বহু সত্য ঘটনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে – এ লেখা দিয়ে ট্রেলারটি শুরু হয়েছে।

সিনেমোর গল্পে বলা হয়েছে, কেরালার একটি গ্রামের এক হিন্দু কলেজ ছাত্রী শালিনী উন্নিকৃষ্ণানকে রীতিমতো টার্গেট করে এক মুসলমান সহপাঠিনী, যার যোগাযোগ আছে ‘মৌলবাদীদের’ সঙ্গে।

তাদের পরিকল্পনায় ওই ছাত্রী এবং এক মুসলমান যুবকের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে, তাদের বিয়ে হয়, এবং তারপরে ওই ছাত্রীটিকে মৌলবাদে দীক্ষিত করা হয়। নাম বদল করে ফাতিমা হয়ে যাওয়া শালিনীকে তারপরে ইসলামিক স্টেটে পাচার করা হয়।

শেষে ওই ছাত্রীটি ধরা পড়ে এবং সেখানেই জেরার মুখে সে জানায়, কেন তথাকথিত ইসলামিক স্টেটে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।

যারা ছবিটি মুক্তি দেওয়ার প্রতিবাদ করছেন, তারা বলছেন, এটাই মূল বিতর্কের জায়গা।

“মঙ্গলবার আমরা মাদ্রাজ হাইকোর্টে যে জনস্বার্থ মামলা করেছি সাংবাদিক সিএইচ অরভিন্দাকশানের তরফে, সেখানে আমরা জোর দিয়েছি যে ৩২ হাজার নারী যে সংখ্যাটা বলা হচ্ছে, সেটা তো বিপুল!”

“এত নারীকে কেরালা থেকে তথাকথিত লাভ জিহাদের মাধ্যমে ধর্মান্তরণ করা হল, তাদের ইসলামিক স্টেটে নিয়ে যাওয়া হল? দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে তো এটা একটা গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।

“এই সিনেমাটা সত্য কাহিনী বলে যা প্রচার করছে, তার ফলে আবার বিশ্বের কাছেও তো ভারতের বদনাম হবে। সবাই তো ভাববে যে সত্যিই ভারত থেকে হাজার হাজার সন্ত্রাসবাদী নারী অন্য দেশে পাঠানো হচ্ছে।”

মি. অরভিন্দাকশানের আইনজীবী আলিম আলবুহারি বলেন, তার মক্কেল নভেম্বর মাস থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, ফিল্ম সেন্সর বোর্ড – সবার কাছে আবেদন করেছেন। কিন্তু কেউ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এমন প্রেক্ষাপটে সিনেমাটি মুক্তি পেতে চলেছে।

এই সিনেমা যাতে মুক্তি দেওয়া না হয়, সেজন্য মঙ্গলবার হাইকোর্টের কাছে আবেদন করা হয়েছে বলে জানান আইনজীবী আলিম আলবুহারি।

সিনেমাটির পরিচালক সুদীপ্ত সেন

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,
সিনেমাটির পরিচালক সুদীপ্ত সেন

এই সংখ্যা কিভাবে এসেছে?

সিনেমার ট্রেলার প্রকাশের পর তৈরি হওয়া বিতর্ক নিয়ে পরিচালক সুদীপ্ত সেন একটি টুইট করেছেন।

তিনি লিখেছেন, “প্রিয় কেরালা, তোমরা সাক্ষরতায় প্রথম। শিক্ষা তো আমাদের শিখিয়েছে ধৈর্যশীল হতে। দয়া করে দ্য কেরালা স্টোরি দেখুন। মতামত তৈরি করার তাড়া কিসের?”

“দেখুন ওটা – যদি আপনাদের খারাপ লাগে, বিতর্ক করব। আমরা কেরালায় সাত বছর ধরে কাজ করেছি এই ফিল্মটির জন্য। আমরা আপনাদেরই অংশ। আমরা সবাই মিলেই ভারতীয়। ভালবাসা,” লিখেছেন মি. সেন।

ওদিকে আইনজীবী আলিম আলবুহারি বলেন, সিনেমার পরিচালক সুদীপ্ত সেন একটা ইউটিউব চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে ৩২ হাজার নারীর এই সংখ্যাটা তিনি পেয়েছেন কেরালার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী উমেন চান্ডির বিধানসভায় পেশ করা এক তথ্য থেকে। সেখানে তিনি বলেছিলেন, প্রতি বছর কেরালায় ২৮০০ থকে ৩২০০ নারী ইসলামে ধর্মান্তরিত হচ্ছেন। তাই দশ বছরে সংখ্যাটা ৩২ হাজার হবে, এমনটাই হিসাব দিয়েছিলেন সিনেমাটির পরিচালক।

“উমেন চান্ডি হিসাব দিয়েছিলেন ধর্মান্তরিত নারীদের, তিনি তো আর বলেন নি যে ধর্মান্তরিত সব নারী মৌলবাদী হয়ে গিয়ে ইসলামিক স্টেটে চলে যাচ্ছেন। তাই সুদীপ্ত সেন যেটাকে সত্য কাহিনী বলে বর্ণনা করছেন, তার কোনও ভিত্তিই নেই,” বলেন মি. আলবুহারি।

আলিম আলবুহারি বলেন, ২০১৭ সালে লোকসভায় এক সংসদ সদস্যের প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জি কিষেন রেড্ডি বলেছিলেন, জাতীয় সন্ত্রাস দমন এজেন্সি এবং রাজ্যস্তরের এজেন্সিগুলি ইসলামিক স্টেট সদস্য বা তাদের মদতদাতা হিসাবে ১০৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ওই তথ্যে মন্ত্রী রাজ্যওয়ারি হিসাবও দিয়েছিলেন, যেখানে দেখা যাচ্ছে কেরালা থেকে মাত্র ১৪ জনের বিরুদ্ধে ওই মামলা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন মি. ।

সুদীপ্ত সেনের ওই সাক্ষাতকার প্রচারিত হওয়ার পরে ভারতের ভুয়া খবর চিহ্নিত করার পোর্টাল ‘অল্ট নিউজ’ খুঁজে বের করেছিল যে কেরালার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ২০১২ সালে বিধানসভায় বলেছিলেন যে ২০০৬ সাল থেকে ২৬৬৭ জন নারী ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছেন।

তবে কেরালা পুলিশের এক কর্মকর্তা বিবিসিকে গতবছর জানিয়েছিলেন, তাদের হিসাবে ১০ থেকে ১৫ জন নারী ২০১৬ সাল থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে তথাকথিত ইসলামিক স্টেটে যোগ দিয়েছিলেন।

আফগানিস্তানে তালিবান ২০২১ সালে ক্ষমতায় আসার পরে ভারতীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন যে সেখানকার জেলে চারজন কেরালার নারী বন্দী আছেন, যারা ইসলামিক স্টেটে যোগ দিয়েছিলেন আগে।

মি. অরভিন্দাকশানের আইনজীবী বলছেন, “যদি এই সিনেমায় কাল্পনিক গল্প কথাটি উল্লেখ করা হতো, তাও মানা যেত। কিন্তু এখানে তো সত্য ঘটনা, যা এতদিন অজানা ছিল, ইত্যাদি শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে। এই সিনেমাটিকে কী করে কেন্দ্রীয় ফিল্ম সেন্সর বোর্ড ছাড়পত্র দিল?”

সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য মঙ্গলবারই এই সিনেমাটির মুক্তি পাওয়ার ওপরে স্থগিতাদেশ চেয়ে দায়ের করা একটি মামলা খারিজ করে দিয়েছে। আবার জামিয়াত উলেমা এ হিন্দও মামলা করেছে একই আর্জি জানিয়ে।

কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারই ভিজয়ন

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারই ভিজয়ন

রাজনৈতিক বিতর্ক

সিনেমাটি মুক্তি দেওয়ার বিরুদ্ধে মামলা হলেও কেরালার ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট ছবিটির প্রদর্শন বন্ধ করার পথে হাঁটতে চাইছে না। তারা রাজনৈতিকভাবে এর বিষয়বস্তুর বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে চায়।

মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই ভিজয়ন ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “আপোষহীনভাবে ধর্মনিরপেক্ষ কেরালাকে সন্ত্রাসীদের মুক্তাঞ্চল বলে সঙ্ঘ পরিবার যে প্রচার চালায়, সিনেমাটির ট্রেলার দেখে মনে হচ্ছে ওই একই প্রচার সেখানেও করা হচ্ছে।“

কংগ্রেস নেতা শশী থারুরও সিনেমাটি নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে। তিনি একটি টুইটে লিখেছেন, “এটা ‘তোমাদের’ কেরালা স্টোরি হতে পারে, এটা ‘আমাদের’কেরালার কাহিনী নয়।“

পরে তিনি ব্যাখ্যা দেন যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে বলেই তাকে কেউ অপব্যবহার করতে পারে না। তবে কেরালার বাসিন্দাদের অধিকার রয়েছে জোরগলায় বলার যে এটা বাস্তবের ভুল উপস্থাপনা।

বামফ্রন্টের বড় শরিক দল সিপিআইএমের পলিটব্যুরো সদস্য ও রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী এম এ বেবি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সিনেমার মাধ্যমে অসত্য কথা দেশজুড়ে প্রচার করার যে পরিকল্পনা আরএসএস নিয়েছে, তারই অংশ ছিল কাশ্মীর ফাইলস। এখন আবারও কেরালা স্টোরি আনা হচ্ছে।

“হিটলারের সময়ে গোয়েবলস যা বলেছিলেন, একটা মিথ্যা কথা শতবার বললে মানুষ সেটাকেই সত্য বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে, এখানেও সেটাই করা হচ্ছে,” বলেন মি. বেবি।

তার মতে, কেরালায় এক দুটো ঘটনা হয়েছে যেখানে ইসলামি মৌলবাদী সংগঠনে যুক্ত হয়েছে কেউ কেউ। পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়ার মতো কিছু মৌলবাদী সংগঠনও যে কাজ করছে না তা নয়। কিন্তু যে প্রচার চালানো হচ্ছে যে কেরালা ইসলামি সন্ত্রাসবাদের নিয়োগ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে, তা সম্পূর্ণভাবে অসত্য প্রচার।

তবে তারা সিনেমাটি নিষিদ্ধ করে দিতে চান না, তার দল চায় হিন্দুত্ববাদীদের অসত্য প্রচারের বিরুদ্ধে মানুষকে একজোট করতে, জানাচ্ছিলেন এম এ বেবি।

বিজেপির কেরালা রাজ্য সভাপতি কে সুরেন্দ্রান বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “এটা তো বামফ্রন্ট এবং সিপিআইএমের দ্বিচারিতা। তারাই তো মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে গলা ফাটায়। তা এখানে একজন একটা সিনেমা বানিয়েছেন, তিনি তার ভাষ্যটা প্রকাশ করেছেন।

“সিনেমায় যে সংখ্যাটার উল্লেখ করা হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, যে সেটা ৩২ হাজার না ২০ হাজার না দশ হাজার। কিন্তু আই-এস যে কেরালা থেকে লাভ জিহাদের মাধ্যমে কয়েক হাজার নারী পুরুষকে ধর্মান্তরিত করে সিরিয়া বা আফগানিস্তানে নিয়ে গেছে সেটা তো সত্যি।” বলছিলেন মি. সুরেন্দ্রান।

ভারতের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছ , ফিল্ম সেন্সর বোর্ড ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ ছবিটিকে মুক্তি দেবার আগে ১০টি দৃশ্য বাদ দিতে বলেছিল। তারপরেই ছবিটি চূড়ান্ত ছাড়পত্র পায়।

বিবিসি বাংলা

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com