শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:০৯ অপরাহ্ন

কানাডায় অভিবাসনঃ স্বপ্নপূরণের প্রথম ধাপ

  • আপডেট সময় বুধবার, ৩ মে, ২০২৩

সব শহরের নাম আমরা বাংলাদেশীরা অনেক পরিচিত প্রবাসীদের কাছ থেকে শুনে থাকি।

শিক্ষাক্ষেত্রেও কানাডা বিশ্বসেরাদের কাতারে। কানাডার মান্ট্রিঅলে অবস্থিত ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি সারা বিশ্বের জ্ঞানপিপাসুদের কাছে সুপরিচিত এবং আদৃত একটি ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়াও এদেশে অবস্থিত বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে আছে ইউনিভার্সিটি অফ টরেন্টো, ইউনিভার্সিটি অফ এলবার্টা, ইউনিভার্সিটি অফ মেনিটোবা, ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ-কলাম্বিয়া সহ আরো অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রী কৃতিত্বের সাথে পড়ালেখা করছে। তাদের অনেকেই বৃত্তি নিয়ে পড়ালেখা করছে, অনেকে পড়ালেখা করছে নিজস্ব অর্থায়নে।

কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সারাবিশ্বে পরিচিত তার উদারপন্থা ও সাম্যনীতির কারণে। রাজনৈতিকভাবে কানাডা অত্যন্ত স্থিতিশীল একটি দেশ। দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে এবং সমৃদ্ধ কানাডা গড়ে তোলার লক্ষে সেদেশের সরকার চলতি বছরগুলোতে অভিবাসনের উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কানাডার সরকারী ওয়েবসাইটে প্রদত্ত ‘ইমিগ্রেশন, রিফিউজি এন্ড সিটিজেনশিপ কানাডা ডিপার্টমেন্টাল প্ল্যান’ নথিতে দেখা যায় কানাডা সরকার ২০১৯ সালে তিন লক্ষ ত্রিশ হাজার মানুষকে এবং ২০২০ সালে তিন লক্ষ চল্লিশ হাজার মানুষকে সে দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ দিতে যাচ্ছে।

সরকারী এই আনুকূল্যের সুবাদে ইতিমধ্যেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে দক্ষ এবং যোগ্য মানুষেরা বিপুল সংখ্যায় কানাডায় অভিবাসী হচ্ছেন কিংবা হওয়ার চেষ্টা করছেন। সে তুলনায় বাংলাদেশ থেকে কানাডায় অভিবাসনের হার তুলনামূলকভাবে কম। এর অন্যতম একটি কারণ হলো ইংলিশ ভাষায় আমাদের দুর্বলতা এবং এ সংক্রান্ত ভীতি।

ইন্টারনেটের সুবাদে বর্তমান পৃথিবীতে অফুরন্ত তথ্যভান্ডার আজ সবার জন্য উন্মুক্ত। কানাডার মতো একটি উন্নত, সভ্য ও মানবিক পরিবেশের দেশে অভিবাসনের মাধ্যমে একজন মানুষ তার নিজের এবং তার পরিবারের সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করার সুযোগ পায়। এ অভিবাসনের জন্য কেবলমাত্র প্রয়োজন নির্ধারিত কিছু যোগ্যতা যথাযথভাবে পূরণ করা এবং সংশ্লিষ্ট সকল নথিপত্র যথাযথভাবে প্রদান করা। এইসব শর্তাবলী এবং নিয়মকানুন সবকিছুই কানাডার সরকারী ও বেসরকারী অনেক ওয়েবসাইটে বিস্তারিত দেয়া আছে। কিন্তু বাংলাদেশীদের অনেকেই তা নিজে জানার ও বুঝার চেষ্টা না করেই তৃতীয় পক্ষের উপর অন্ধভাবে নির্ভর করেন এবং অনেকসময়েই প্রতারণার শিকার হন।

তবে একই সাথে অভিবাসন প্রক্রিয়াকে সহজতর এবং সম্ভবপর করে তুলতে যোগ্য তৃতীয় পক্ষের অবদান অস্বীকার করার মতো কোন বিষয় নয়। এ কারণেই উন্নত বিশ্বের এসব দেশে সরকারীভাবেই ইমিগ্রেশনের কাজে সহায়তা করার জন্য উপযুক্ত যোগ্যতা অর্জন সাপেক্ষে লাইসেন্স দেয়া হয়। সুতরাং আপনি যদি অভিবাসনের জন্য আবেদনের ক্ষেত্রে কোন ইমিগ্রেশন এজেন্টের সহায়তা নিতে যান, তাহলে সে এজেন্ট কিংবা সে সংস্থার যোগ্যতা, লাইসেন্স, ট্র্যাক রেকর্ড এসব আপনাকেই আগে যাচাই বাছাই করে নিতে হবে।

কানাডার সরকারী অভিবাসন নীতিমালা এবং নিয়মকানুন প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। কখনো যোগ হচ্ছে নতুন খাত, কখনো পুরনো কোন নিয়ম বা সুযোগ হয়তো বাদ দিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ কারণে সর্বপ্রথম করণীয় হলো কানাডার সরকারী ওয়েবসাইটের ‘ইমিগ্রেশন এন্ড সিটিজেনশিপ’ সেকশনে গিয়ে চলতি সময়ের নিয়মকানুন এবং সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য জানার চেষ্টা করা। এ ওয়েবসাইটে এমনকি একটি ইন্টারএকটিভ ফরমে তথ্য দিয়ে প্রাথমিকভাবে নিজে নিজেই অভিবাসনের জন্য যোগ্যতা যাচাই করার সুযোগ দেয়া আছে। এটি প্রাথমিক কিছু ধারণা পাওয়ার জন্য উপযুক্ত, তবে চুড়ান্ত আবেদন করার সময় সকল নথিপত্রের উপযুক্ততা এবং যথার্থতা ভালোভাবে যাচাই করা উচিত।

অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর মতো কানাডাতেও ছাত্রছাত্রীরা স্টুডেন্ট ভিসায় পড়ালেখা করতে যেতে পারে। তাছাড়া ফ্যামিলি স্পনসরশীপ প্রোগ্রামের আওতায় অভিবাসীরা তাদের স্বামী বা স্ত্রী সহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকেও যথাযথ শর্তসাপেক্ষে স্পন্সর করে কানাডায় নিয়ে যেতে পারে। কারো যদি জাতীয় পর্যায় সাংস্কৃতিক কিংবা ক্রীড়াক্ষেত্রে অবদান রাখার যোগ্যতা থাকে তাহলে তাদের জন্য এদেশে সেল্ফ-এমপ্লয়েড বা আত্মনির্ভর পেশাজীবি হিসেবে অভিবাসনের সুযোগ আছে।

কোন ধনী ব্যবসায়ী যদি কানাডায় পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ ব্যবসায়ে মুলধন হিসেবে কাজে লাগান তাহলে তার জন্য ‘ইমিগ্র্যান্ট ইনভেস্টর প্রোগ্রাম’ এর আওতায় সেদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ ছিলো। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে এ পদ্ধতি ফেডারেল বা জাতীয় পর্যায়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তার পরিবর্তে বর্তমানে চালু আছে স্টার্ট আপ ভিসা প্রোগ্রাম যার মাধ্যমে অভিবাসী উদ্যোক্তারা নতুন কোন ব্যবসায়িক উদ্যোগ নিয়ে কিংবা স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করার মাধ্যমে কানাডায় অভিবাসী হতে পারেন।

তাছাড়া কেন্দ্রীয়ভাবে বিনিয়োগকারীদের অভিবাসনের পুরনো ঐ প্রোগ্রামের পরিবর্তে বর্তমানে কিউবেক, ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, মেনিটোবা কিংবা সাসকাচুয়ান প্রদেশগুলোতে ব্যবসায়ীরা স্থানীয়ভাবে বিনিয়োগ করার মাধ্যমে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পেতে পারেন। অস্ট্রেলিয়াতে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে রাজ্যগুলোকে অভিহিত করা হয় স্টেট নামে, একইভাবে কানাডায় এসব রাজ্যকে কিংবা প্রদেশকে সরকারীভাবে অভিহিত করা হয় প্রভিন্স নামে।

কানাডায় অভিবাসনের ক্ষেত্রে প্রভিনসিয়াল নমিনি প্রোগ্রাম বা পিএনপি একটি বহুল উচ্চারিত শব্দমালা। এ দেশের প্রদেশগুলো তাদের নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী নির্দিষ্ট পেশার ও দক্ষতাসম্পন্ন অভিবাসীদেরকে কানাডায় নিয়ে আসতে পারে। যদি যথাযথভাবে সব শর্ত পূরণ করা যায় তাহলে অনেক ক্ষেত্রে এটিও হতে পারে একজন মানুষের জন্য কানাডায় অভিবাসনের উপযুক্ত উপায়।

এছাড়াও কানাডায় কেয়ারগিভার কিংবা সেবক/সেবিকা হিসেবে অভিবাসনের জন্য আছে বিশেষ সুযোগ। শিশু, বৃদ্ধ কিংবা অসুস্থ মানুষদের বিশেষায়িত সেবা দেয়ার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, যথাযথ অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা থাকলে শর্তাবলী পূরণ সাপেক্ষে খুব সহজেই কানাডায় অভিবাসী হওয়া যায়। পাশাপাশি ফেডারেল স্কিলড ট্রেডস প্রোগ্রামের আওতায় বিশেষায়িত কর্মজীবিরাও কানাডায় অভিবাসী হওয়ার সুযোগ পায়। যেমন ইলেকট্রিশিয়ান, বুচার, শেফ, হেয়ার ড্রেসার এসব কাজ জানা লোকদের জন্য কানাডার দ্বার অবারিত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো বাংলাদেশের সমাজে যারা এসব কাজে দক্ষ তারা ইংলিশ ভাষায় দুর্বলতা এবং তাদের পেশাসংশ্লিষ্ট বিশেষায়িত শিক্ষার সনদের অভাবে এসব ক্ষেত্রে আবেদন করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন না।

উপরের এসব নানা খাতে কানাডায় আসা যায়। তবে অভিবাসনের মূল যে খাত, সর্বপ্রধান সে প্রোগ্রামের নাম হলো স্কিলড ওয়ার্কার প্রোগ্রাম অথবা ফেডারেল স্কিলড ওয়ার্কার প্রোগ্রাম। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী এ প্রোগ্রামে আবেদন করার উপায়কে বলা হয় ‘এক্সপ্রেস এন্ট্রি’। একজন স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন দক্ষ পেশাজীবি মানুষের জন্য কানাডায় অভিবাসনের জন্য এটিই হলো প্রণিধানযোগ্য উপায়।

এক্সপ্রেস এন্ট্রি পদ্ধতিতে স্কিলড ওয়ার্কার হিসেবে কানাডায় অভিবাসনের জন্য সংশ্লিষ্ট সকল শর্তপূরণের মাধ্যমে নির্ধারিত সংখ্যক পয়েন্ট বা স্কোর অর্জন করতে হয়। এক্ষেত্রে কিছু বিষয় মৌলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রথমতঃ ইংলিশ ভাষায় দক্ষতা, যা আইইএলটিএস পরীক্ষার স্কোর দিয়ে অর্জন করতে হয়। পাশপাশি শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশাগত অভিজ্ঞতা, আবেদনকারীর বয়স, কানাডায় কোন কাজের অফার এবং সেদেশে টিকে থাকার যোগ্যতা কিংবা এডাপ্টিবিলিটি এসব খাতে নানা মাত্রাভেদে নানারকম পয়েন্ট দেয়া হয়। সবগুলো পয়েন্ট মিলে যদি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় তাহলে অতি সহজেই একজন মানুষ কানাডায় অভিবাসনের জন্য আবেদন করতে পারেন।

অভিবাসন নিঃসন্দেহে একজন মানুষের জীবনে অনেক বড় একটি সিদ্ধান্ত। এর সাথে জড়িয়ে থাকে পরিবারের অনেকগুলো মানুষের আশা-আকাঙখা, ভবিষ্যতের স্বপ্ন ইত্যাদি। আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ একটু অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য পরদেশে প্রবাসের জীবন বেছে নেন। যথাযথ যোগ্যতা না থাকাতে এবং অনেক যময় পর্যাপ্ত তথ্যের কিংবা জানার অভাবে তারা অনেকেই এমন দেশে জীবনের বড় একটা অংশ কাটিয়ে দেন যেসব দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ দেয়া হয় না, নাগরিকত্ব দেয়া হয় না। অথচ কর্মজীবনের শুরুতে কিছুটা চেষ্টা এবং সঠিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই হতে পারে একজন মানুষের জীবনে মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার সূচনা।

বর্তমান বিশ্ব খুব দ্রুতই ছোট হয়ে আসছে, যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নতির ফলে ভৌগোলিক সীমানার প্রভাব কমছে। কিন্তু তার পাশাপাশি উন্নত একটি দেশের সুযোগ সুবিধা ও উন্নত সমাজের নিশ্চয়তার প্রয়োজনীয়তা কমেনি বরং বেড়েছে। সুতরাং আপনি যদি অভিবাসনের চিন্তা করেন, যদি পৃথিবীকে ঘুরে দেখার স্বপ্ন দেখেন তাহলে এ মুহুর্ত থেকেই আপনাকে প্রচেষ্টা করতে হবে। ইংলিশ কথোপকথন ও যোগাযোগে সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করাই হতে পারে আপনার অভিবাসনের প্রথম পদক্ষেপ। এর পাশাপাশি অন্যান্য ভাষাতেও দক্ষতা আপনাকে কর্মজীবনে সহায়তা করবে। উদাহরণস্বরুপ কানাডার আরেকটি সরকারী ভাষা হলো ফ্রেঞ্চ যা জানা থাকলে কানাডায় অভিবাসনের জন্য তা সহায়ক হতে পারে।

ভাষাগত দক্ষতার পাশাপাশি গাড়ি চালানো এবং কম্পিউটারের নিত্যপ্রয়োজনীয় সফটওয়ার ব্যবহারে দ্ক্ষতা অর্জনের মতো স্কিলগুলোও অভিবাসী জীবনকে সহজ করে তোলে। একজন আত্মবিশ্বাসী, দক্ষ এবং উম্মুক্ত মানসিকতার মানুষের জন্য বর্তমান পৃথিবীতে প্রকৃতপক্ষে স্বপ্ন দেখার শুরু আছে, কিন্তু শেষের কোন সীমানা নেই। আমাদের প্রিয় দেশটি থেকে যোগ্য মানুষেরা পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ুক, এবং সততা ও দক্ষতার সাথে সবাই যার যার কর্মক্ষেত্রে সফল হয়ে উঠুক আমরা এ প্রত্যাশাই করি।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com