বেড়াতে কে না ভালবাসে! আমরাও তার ব্যতিক্রম নই। কিন্তু বেড়াতে যাব বললেই তো হবে না— তার তো একটা প্রস্তুতিপর্ব আছে, আছে নানারকম ব্যবস্থাপনা। আর এসব ব্যাপারে আমরা খুবই কুঁড়ে। নিউজ়িল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্বন্ধে অনেকের কাছ থেকে অনেক চিত্রই পেয়েছি। মনে একটি সুপ্ত বাসনাও ছিল দেশটি দেখার। সেটা যে হঠাৎ করে এমন বাস্তবায়িত হবে, ভাবিনি কখনও। তবে এর সবটুকু কৃতিত্ব আমাদের খুব কাছের বন্ধু এক বাংলাদেশি দম্পতির। মোকাদ্দেমভাই ও তার স্ত্রী ইসমতের উদ্যোগ ছাড়া আমাদের দু’জনের পক্ষে নিউজ়িল্যান্ড ভ্রমণ কখনও সম্ভব হত না। কর্মসূত্রে মোকাদ্দেমভাইকে প্রায়ই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যেতে হত। তাই কোথায় কী আছে এবং কী ভাবে কী পরিকল্পনা করতে হবে, সবটাই তার নখদর্পণে। মানচিত্র দেখে আমাদের ভ্রমণপর্বটা কোথা থেকে শুরু হবে, কোথায় শেষ হবে— মোকাদ্দেমভাই তার একটা খসড়া করে নিল। তারপর হোটেল বুকিং, ‘Rent-A-Car’ থেকে গাড়ির ব্যবস্থা— সবই ঠিকঠাক করা হল। আমরা শুধু তিনসপ্তাহের জন্য নিউজ়িল্যান্ডের ভিসাটা করিয়ে নিলাম।
প্রথমে ব্রিসবেন গেলাম। সেখান থেকে ফ্লাইটে নিউজ়িল্যান্ড। এয়ারপোর্টে নেমেই চাবিসমেত একখানা ঝাঁ চকচকে গাড়ি পেয়ে গেলাম— ওরা দু’জন পালা করে ড্রাইভ করবে। এখন আমরা যাব অকল্যান্ডের এক হোটেলে— ‘ডাচেস মোটর লজ’। মাউন্ট ওয়েলিংটন হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি চলতে শুরু করল— কী যে অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য! রাস্তার দু’ধারে পাহাড়ের সারি। পাহাড়ের ঢাল নেমে এসেছে বিস্তীর্ণ উপত্যকায়। সবটাই যেন সবুজ কার্পেটে ঢাকা। দু’চোখ জুড়িয়ে যায়, পাহাড়ের গায়ে সাদা ভেড়ার পাল ঘুরে বেড়াচ্ছে। দূর থেকে মনে হয় যেন কেউ পাহাড়ের গায়ে পেঁজা তুলো আটকে রেখেছে। ভাবছিলাম, দেবরাজ ইন্দ্রের মতো কেন সহস্রাক্ষ হতে পারিনি! এত সৌন্দর্য কী দু’ চোখে ধরে! মাঝেমাঝেই গাড়ির গতি কমাতে হচ্ছে। হুট করে দলছুট ভেড়া সামনে এসে পড়তে পারে। দেখলাম ভেড়ার পাল নিয়ে রাস্তা পার হবে বলে হাত দেখাচ্ছে ওদের রক্ষক। সঙ্গে আছে একটি শিপডগ। আশ্চর্য মুনশিয়ানায় ইতস্ততঃ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভেড়াগুলিকে ও একটা জায়গায় জড়ো করছে।
লাঞ্চের আগেই আমরা হোটেলে পৌঁছে গেলাম। খাওয়া-দাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম করে নিলাম।আমাদের পরের গন্তব্য ‘রোটেরুয়া’। সেটা অনেক দূর বলে একটা রাত এখানে কাটাতে হল। রোটেরুয়া এখান থেকে ৭০০/৮০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে। সকালে গাড়িতে পেট্রোল বোঝাই করে সেই সঙ্গে কিছু স্ন্যাকসও কিনে নিলাম। প্রায় চারঘণ্টা ড্রাইভ করে আমরা রোটেরুয়ার হোটেলে পৌঁছালাম। বিকেলেই হোটেলের কাছেই রোটেরুয়া লেক দেখতে গেলাম। বহুকাল আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে তোপচাঁচি বেড়াতে গিয়েছিলাম। পাহাড়ে ঘেরা শান্ত সেই লেকটির কথা আজ হঠাৎ-ই মনে পড়ল। এই লেকটিও উঁচু পাহাড়ে ঘেরা। ঘড়িতে সাড়ে সাতটা বাজে। কিন্তু সূর্য অস্ত যেতে রাত ন’টা বাজবে। লেকের কাছে খুব ঠান্ডা, জোরে হাওয়া দিচ্ছিল। তার উপর সোনালি সূর্যের আলো পড়ে মনে হচ্ছিল যেন একটা সোনার পাত ভেঙে-ভেঙে যাচ্ছে।
কালো রাজহাঁসের দল রাজকীয় ভঙ্গিমায় গ্রীবা বাঁকিয়ে ভেসে যাচ্ছে। কী মসৃণ চকচকে তাদের কালো ডানা! তারই পাশে রয়েছে দুধ সাদা সি-গালের ঝাঁক। সাদার পাশে কালো, যেমন আলোর পাশে আঁধার। পরের দিন সকাল সাড়ে আটটায় বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য ‘হেলস গেট’— জিয়োথার্মাল এরিয়া। ‘হেল্স গেট’— নরকের দ্বার। এখানে ঢুকতে গেলে বাইরে গাড়ি রেখে তবে ঢুকতে হয়। আমরা একজন গাইড নিয়ে নিলাম। কড়া সালফারের গন্ধ নাকে আসছে। চোখের সামনে এখন সজীব আগ্নেয়গিরি দেখছি। লেখা আছে, ‘Most active geothermal area’— বেশ ভয় লাগছিল। ভাবছিলাম প্রকৃতি বড় খেয়ালী। হঠাৎ যদি বিস্ফোরণ হয় কী হবে? চারদিকে মাডপুলগুলি সশব্দে টগবগ করে ফুটছে। এই পুলগুলির তাপমান ৯৩º সেলসিয়াস। হাঁড়িতে জলের মধ্যে চাল ফেলে দিয়ে পুলগুলির বেশ উপরে ঝুলিয়ে দিলে খুব তাড়াতাড়ি চাল সেদ্ধ হয়ে যায়।
কোনও-কোনও জায়গায় এত বেশি ধোঁয়া যে চারদিক ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। সালফারের গন্ধ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। মাডপুলগুলির বেশ খানিকটা দূরত্বে যদিও বা কিছু লতাগুল্ম জন্মায় তা এই তাপে ছাই হয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ এবং বিস্ময়কর পরিবেশ। আমাদের মতো আরও অনেক ভিজ়িটার আছেন আমাদের চারপাশে। না হলে এ জায়গাটাকে মৃত্যুপুরী বলে মনে হত।গাইডের কাছ থেকে জানা গেল ‘হেল্স গেট’ নামটি বার্নাড শ-র দেওয়া। একবার উনিশ শতকে তিনি এখানে আসেন। ঘোরতর নাস্তিক ছিলেন তিনি। তাঁর কোনও এক ঈশ্বরবাদী বন্ধু তাঁকে বলেছিলেন যে এই নাস্তিকতার জন্য তাঁকে নরকদর্শন করতেই হবে। এখানে এসে বার্নাড শ-র মনে হয়েছিল জায়গাটি নরকের মতোই ভয়ঙ্কর।
তাই তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ‘Hell’s gate’। আসলে এর প্রকৃত মাওরি নাম ছিল ‘টিকিটেরে’ (Tikitere)। এই নামকরণের পিছনে এক দুঃখজনক ইতিহাস আছে। মাওরিদের এক ধনী পরিবারের কিশোরী গৃহবধূ স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে এই ফুটন্ত কাদার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। পরের দিন এই কাদার মধ্যে তার ঝলসানো দেহ ভেসে ওঠে। মেয়েটির হতভাগিনী মা বিলাপ করে বলেন, “Ane teri nei tiki”— যার ইংরেজি অনুবাদ “Here lies my precious one”। মায়ের সেই করুণ কান্নার কথা মনে করে এই জায়গার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘Tikitere’।
হেল্স গেট এরিয়ার মধ্যে আমরা এর অদ্ভূত জিনিস দেখলাম। সেটা হচ্ছে ল্যান্ড কোরাল। এতদিন জেনে এসেছি প্রবালের জন্ম সাগরে। এক ধরণের পোকার ফসিল জমে সাগরের বুকে প্রবালদ্বীপের সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই জিওথার্মাল এরিয়াতে একধরণের ব্যাকটেরিয়া জমে প্রবালের মতোই শক্ত হয়ে বাড়তে থাকে। তাকেই বলে ল্যান্ড কোরাল।
এই হেল্স গেটের কাছাকাছি একটা গিজ়ার (geyser) ছিল। একে উষ্ণ প্রস্রবণ না বলে তপ্ত প্রস্রবণ বলাই ভাল। বেশ খানিকটা দূর থেকেই এর তাপটা অনুভূত হচ্ছিল। এর চারপাশে অনেকটা জায়গা ছেড়ে রেলিং দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। যাতে কেউ কাছে যেতে না পারে। এই প্রস্রবণ কোন অতল ভূগর্ভ থেকে উত্থিত হয়ে যেন আকাশকে ছুঁতে চাইছে। এর উচ্চতা ১০০ ফুটেরও বেশি।
এবারে লাঞ্চ সেরে আমরা গেলাম মাওরি কনসার্ট দেখতে। অনেক-অনেক বছর আগে মাওরি জাতি এদেশে এসে বসবাস করতে শুরু করে। বর্তমানে নিউজ়িল্যান্ডের জনসংখ্যার প্রায় চোদ্দ শতাংশ এই মাওরি। ওরা ওদের পূর্বপুরুষের ধারা বজায় রেখে নিউজ়িল্যান্ডের বর্তমান সভ্যতা সংস্কৃতির সঙ্গে একটি সুন্দর সমন্বয় গঠন করেছে। ওরা এখন এদেশেরই মানুষ। কনসার্টে ওরা গান করল স্প্যানিশ গিটার বাজিয়ে। গানের ভাষা মাওরি। মেয়েদের পরনে ছিল হাঁটু অবধি স্কার্ট, তার সঙ্গে স্ট্র্যাপলেস টপ নানা রংয়ের সুতোয় কাজ করা। মাথায় রঙীন ব্যান্ড তার মধ্যে পাখির পালক গোঁজা। ছেলেরাও এই একই ধরণের স্কার্ট পরেছে। কিন্তু ওদের খালি গা। খুব ভাল লেগেছিল এই মাওরি অনুষ্ঠান।
এবারে একটা মজার ঘটনা বলি। কনসার্ট শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমরা চারজন গ্রিনরুমে ঢুকে পড়লাম পরিচালকের সঙ্গে আলাপ করব বলে। ভদ্রলোক এগিয়ে এসে যথারীতি আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন। এ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু আমার মুখের কাছে হঠাৎ যখন উনি মুখ নামিয়ে আনলেন, ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম সবার মাঝখানে কী কাণ্ড করতে চলেছেন উনি! আমাকে হতবাক করে দিয়ে উনি ওঁর নাক দিয়ে আমার নাকটাতে একটু চাপ দিলেন। তারপর হেসে বললেন যে, এটা ওঁদের মাওরি রীতি। একে বলে ‘Hongi’। এই আচমকা এবং অদ্ভুত অভ্যর্থনা করবার রীতিতে আমি বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তারপর উনি আর ওঁর স্ত্রী যখন ওঁদের সঙ্গেও একইভাবে নাসিকামর্দন করলেন তখন স্বস্তি পেলাম।
রোটোরুয়াকে বিদায় জানিয়ে আমরা চলেছি ওয়েলিংটন সিটিতে। অনেক লম্বা পথ। হোটেল ছেড়ে আধঘণ্টার মধ্যেই আমরা এসে পড়লাম লেক টপোতে। বিশাল এই হ্রদ— আয়তনে যে-কোনও একটা ছোটখাট দেশের সমান। প্রায় দু’হাজার বছর আগে এক আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের ফলে জন্ম এই হ্রদের। আগ্নেয়গিরির বিরাট মুখগহ্বরে কোথা থেকে কীভাবে এই পরিস্রুত জল এসে জমেছে তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। টপোর গাঢ় নীল জলে দূরে-দূরে ভেসে যাচ্ছে সাদা পাল তোলা বোট। আমরা দাঁড়িয়ে আছি লেকের ধারে একটা ‘মল’-এ— বাক্যহীন নিঃশব্দ। শুধু দু’চোখ দিয়ে পান করে যাচ্ছি এর সৌন্দর্যসুধা। ওপারে পাহাড়ের সারি। তার মধ্যে একই উচ্চতাবিশিষ্ট দু’টি পাহাড় চূড়া, যাকে বলা হয় টুইন পিক্স। সত্যিই ওরা দু’টি যেন যমজ ভাই।একজন গা ঢেকে আছে সাদা বরফে, আর একজন রয়েছে আদুড় গায়ে।
নিউজ়িল্যান্ডের দীর্ঘতম নদী ওয়াইকাটো (Waikato),টপো লেক থেকে বেরিয়েছে। এই নদী আগ্নেয়গিরিজাত সংকীর্ণ পাহাড়ি পথ বেয়ে ‘হুকা’-এ এসে অমিতবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নীচে। কী তার গর্জন! কেনই বা সে হঠাৎ এমন ফুলে-ফেঁপে উঠল কে জানে! যেমন সুন্দর, তেমনই ভয়ংকর। আমরা হুকা ফলসের উপরে একটা সেতু থেকে দেখছি বেপরোয়া শ্বেতাঙ্গ টুরিস্টের দল মাথায় হেলমেট বাঁধা ক্যানু (Canoe)-তে করে এই দুর্বার স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলছে। ওরাই জানে কী করে জীবনকে উপভোগ করতে হয়।
ওয়েলিংটন অবধি দু’ধারের দৃশ্য অতি মনোরম। ছবির মতো সুন্দর-সুন্দর বাড়ি। প্রত্যেকটি বাড়ির সামনেই সুদৃশ্য ফুলের বাগান। এত ঝকঝকে গাছের পাতা, মনে হয় কে যেন অতি যত্নে পাতাগুলি ধুয়ে মুছে রেখেছে। কোথাও-কোথাও ফার্ম হাউস চোখে পড়ে। ফারম হাউজ়ের মালিকেরা বেশিরভাগই কৃষিজীবী— কোটি-কোটি টাকার মালিক। ভাবছিলাম কী সুখেই আছে এরা! আর আমাদের দেশে চাষীদের দু’বেলা দু’মুঠো ভাতও জোটে না। এক-একটা ফার্ম হাউজ় বিরাট এরিয়া নিয়ে। সেখানে ঘোড়া আছে, গরু, ভেড়া আছে— তারা সবাই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। এত যে গৃহপালিত পশু ফার্ম ইয়ার্ডে, সেখানেও পরিচ্ছন্নতার কোনও অভাব নেই। যেতে-যেতে চোখে পড়ছে নদী, কোথাও বা সমুদ্রের ধার ঘেঁষে চলেছি। কোথাও বা দেখা যায় পাইন বনের মধ্যে আধো আলো আধো ছায়া। পেরিয়ে গেলাম ফক্সটন, লেভিজ় ও ওটাকি নামের ছোট-ছোট টাউন— একেবারে সাজানো গোছানো এবং পরিচ্ছন্ন। বিকেল পাঁচটায় ওয়েলিংটনের হোটেলে পৌঁছলাম দীর্ঘ পথ পেরিয়ে।
সাড়ে সাতটায় হোটেলে ডিনার সেরে শহর দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। আজ কিন্তু হাড়কাঁপানো শীত। যথেষ্ট গরম পোশাক থাকা সত্বেও শীতের দাপট টের পাচ্ছিলাম, কেননা সময়টা ছিল জানুয়ারি। তবুও ভাল লাগছিল খুব। উইকএন্ড ছিল বলে প্রচুর লোকজন ছিল রাস্তায়। তা ছাড়া ওরা আমাদের মতো শীতে কাবু হয় না। দোকানপাট খোলা, চারদিকে আলোর রোশনাই। কোথাও ছেলেরা স্প্যানিশ গিটার বাজিয়ে দিব্যি গান ধরেছে। তাদের ঘিরে কয়েকজন আবার নেচে চলেছে। কোথাও বা জাগলার দু’হাতে গোটা দশেক বল নিয়ে অতি স্বচ্ছন্দে লোফালুফি করছে। একটা বলও মাটিতে পড়ছে না। ট্যাটুর সাজসরঞ্জাম নিয়ে রাস্তার উপরে বেশ কয়েকজন বসে। যেমন মেহেন্দি পরাবার জন্য আমাদের দেশে মেহেন্দিওয়ালারা বসে থাকে। খদ্দেরদের পছন্দমতো ডিজ়াইনে ট্যাটু করা হচ্ছে তাদের হাতে, পিঠে। মনে হচ্ছিল যেন এক মেলায় এসেছি।
পরের দিন হোটেল ছেড়ে দিয়ে একটা নাগাদ ফেরিঘাটে পৌঁছলাম। এবারের যাত্রা স্টিমারে। এর নাম ‘দ্য লিংক্স’— মস্ত বড় জাহাজের ছোটখাটো সংস্করণ বলা যেতে পারে। ‘লিংক্স’ ছাড়ল বেলা দেড়টায়। নিউজ়িল্যান্ডের উত্তরদিক ছেড়ে আমরা চলেছি দক্ষিণে। এতদিন ধরে একটানা গাড়িতে ঘুরেছি। ওরা দু’জনে ড্রাইভ করে ক্লান্ত। আজ এই জলযাত্রার পরিবর্তনটুকু ভাল লাগছিল সবারই। স্টিমারে মনোরঞ্জনের নানা ব্যবস্থা ছিল। দুপুরের খাওয়াটা হল জমিয়ে। আসলে ‘ভ্রমণ’-এর সঙ্গে সঙ্গে ‘ভোজন’ না হলে মজাটা যেন অপূর্ণ রয়ে যায়। সমুদ্রের নীল দেখে-দেখে সাড়ে তিনটে নাগাদ পৌঁছালাম পিকটনে। সেখান থেকে আবার গাড়ি। ব্লেনহেমের শ্যাটু ম্যালবোরো (Chateau Malborough) হোটেলে বিকেল-বিকেল পৌঁছে গেলাম।
ডেভিড নামে এক ভদ্রলোক সকালে তাঁর ওয়াগন নিয়ে হোটেলে এলেন আমাদের নিয়ে যেতে। ‘গ্লেন রোজ় গার্ডেন’ এখানকার খুব নামী এক গোলাপ বাগান। ডেভিড ওখানকার কর্মকর্তাদের একজন। মোকাদ্দেম ভাই আগেই ওঁকে বলে ব্যবস্থা করে রেখেছিল। ওই গাড়িতেই আমরা সেদিনের বেড়ানো সেরে হোটেলে ফিরব। মেঘ করে আছে। অবারিত প্রান্তরের দূর সীমানাকে ছুঁয়ে আছে অবনত আকাশ। একই সবুজ কিন্তু তার কত রকমফের— কোথাও ঘন, কোথাও কচিকলাপাতার রং, কোথাও বেশ হালকা শেড আবার কোথাও হলদেটে সবুজ। যেন এক রং মেশাবার প্যালেট— যিনি সবার ব়ড় চিত্রকর তিনি তাঁর খেয়াল খুশিতে যখন-তখন রঙে ভরে নিচ্ছেন তাঁর তুলি।
রোজ় গার্ডেনে ঢুকে পড়লাম। একজন ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন, হাতে তার ছোট-ছোট বাস্কেট— পিচ আর চেরিতে ভরা। বললেন ‘বাগান দেখে নিয়ে খেতে-খেতে যেও’। ডেভিড আমাদের নিয়ে সমস্ত বাগানটা ঘুরে-ঘুরে দেখালেন। শুধু ফুল আর ফুল— কতরকমের গোলাপ। গোলাপের সঙ্গে রয়েছে অন্য ফুলও— হোলি হক, ম্যাগনোলিয়া, পিটুনিয়া, ক্রিসামথেমাম।
রোজ় গার্ডেন দেখিয়ে ডেভিড আমাদের নিয়ে এলেন ‘অ্যানিস অর্চার্ড’-এ। অ্যান নামে এর মহিলা বহু বছর আগে এই ব্যবসা শুরু করেন। ফলের থেকে পাল্প বার করে তাকে মেশিনের সাহায্যে শুকিয়ে নিয়ে বিভিন্ন ফলের লেদার তৈরি করে তিনি বাজারে ছাড়েন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই ফ্রুট লেদার অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং তাঁর নামেই এই ব্র্যান্ডের নামকরণ হয় ‘অ্যানিস’।
‘অ্যানিস অর্চার্ড ট্রিট’-এর ভিতরে ঢুকে প্রথমেই পেলাম নানা তাজা ফলের সুন্দর গন্ধ। কলা, স্ট্রবেরি, আপেল, পিচ এবং নিউজ়িল্যান্ডের বিশেষ কিউই (Kiwi) ফলের পাল্প তৈরি হচ্ছে। সেই পাল্পগুলি মেশিন থেকে বেরিয়ে জমা হচ্ছে এক জায়গায় তারপর সেটা শুকিয়ে লেদারের মতো করে প্রেস করা হচ্ছে। শুধু লেদার নয়— আচার জ্যাম জেলিও তৈরি হচ্ছে। এ যেন এক মহাযজ্ঞ। বোতলে বোতলে অতি সুশৃঙ্খল ভাবে জ্যাম জেলি ভর্তি হচ্ছিল। আর এক জায়গায় সেগুলোতে ঢাকা পরানো হচ্ছিল এবং সিল হয়ে বেরিয়ে আসছিল। কাউকে হাত লাগাতে হল না অথচ সবটাই কেমন নির্বিঘ্নে হয়ে গেল। যন্ত্রের এমনই মহিমা। বাড়ির কথা ভেবে আমরা সেদিন ওখান থেকে জ্যাম, জেলি ও অনেকরকমের ফ্রুট লেদার কিনে নিয়েছিলাম।
নিউজ়িল্যান্ডের ‘মন্টানা ওয়াইনারি’ বিশ্ববিখ্যাত। জানতাম আঙুর থেকে মদ তৈরি হয়। কীভাবে হয় সেটা এবার স্বচক্ষে দেখলাম।
মোকাদ্দেম ভাই আর ইসমত খুব মজা করে এটা ওটা টেস্ট করে যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এবারে কিন্তু এক যাত্রায় পৃথক ফল হ’ল। আমরা একেবারেই অভ্যস্ত নয় বলে টেস্টিং এর ব্যপারে ওদের সঙ্গ দিতে পারিনি। আমি উৎসুক হয়েছিলাম আঙুরের ক্ষেত দেখব বলে।
একটা উঁচু টিলার ওপর উঠে পুরো ক্ষেতটা দেখছিলাম। যতদূর দৃষ্টি চলে একরের পর একর সবুজ আঙুর ক্ষেত। সরু তার লাইন বরাদ্দে চলে গিয়েছে বেড়ার মতো। তার সঙ্গে আঙুর লতাগুলি আটকানো। তার সঙ্গে জলের সরু পাইপ ফিট করা আছে। পাম্পিংস্টেশন থেকে চাবি ঘুরিয়ে দিলে সর্বত্র সমানভাবে জল পাবে গাছগুলি। পুরো ওয়াইনারি ঘুরে দেখতে অনেক সময় লেগে গেল।
ফিরে এলাম হোটেলে। কোনওরকমে দুপুরের খাওয়া সেরে তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে উঠলাম। মার্লবোরো ছেড়ে আমরা যাব কাইকোরা। ওয়েদার খুব খারাপ। আমাদের সারথিদ্বয় চিন্তায় পড়েছে। যেমন করেই হোক এই বাজে ওয়েদারের মধ্যে দিয়ে পৌঁছে যেতে হবে হোটেলে বিকেলের মধ্যে। প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। মোকাদ্দেমভাই ভাই গাড়ি চালাচ্ছে। সামনে সব ঝাপসা, দৃষ্টি চলে না। শহরের বাইরে চলে এসেছি। সরু পিচ্ছিল রাস্তা—ডানদিকে খাড়া পাহাড়, বাঁদিকে উত্তাল সমুদ্র। একটু এদিক ওদিক হলেই বা চালক অন্যমনস্ক হলেই আর রক্ষা নেই। পাহাড়ের উপরকার গাছগুলি ঝোড়ো হাওয়ায় পাগলের মতো মাথা নাড়ছে। আমি আর ইসমত পিছনে একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে আছি। মুখে কথা নেই। খানিকটা যাবার পর দেখতে পেলাম সমুদ্রের ধারে বড় বড় পাথরের ওপর কারা যেন বসে আছে—একটা বোর্ডে লেখা ‘scal colony’। বৃষ্টির তোড়ে খুব ভাল দেখা যায় না। গাড়িটা স্লোডাউন করতে দেখা গেল সমুদ্রের পাড়ে বড় বড় পাথরের ওপর শ’য়ে শ’য়ে বিশালাকৃতি সীল বসে আছে।
‘নরফোক’ হোটেলে যখন পৌঁছালাম বৃষ্টি কমে এসেছে। একেবারে সমুদ্রের ধারে সুন্দর মোটেল। দেখা যাচ্ছে বালির চর সমুদ্রের ভিতরে অনেকটা চলে গিয়েছে। সেখানেও বসে আছে সীলেরা, মায়ের কোল ঘেঁষে নিশ্চিন্তে রয়েছে শিশু সীল। আমি আর ইস্মত্ সমুদ্রের ধারে বেড়াতে বেড়াতে বালির চরের দিকে এগোতে লাগলাম। আসলে বালির চরটি সমুদ্রের তীরের সঙ্গে সংযুক্ত, বিচ্ছিন্ন নয়। তাই সমুদ্রে না নেমেই যাওয়া যায়। বালির চরেও সীলেদের উপনিবেশ। একটু দূরত্ব রেখেই দেখছিলাম। পরের দিন মোটেলের মালিক রিচার্ড নামে এক ফার্মারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
রিচার্ড আমাদের নিয়ে গেলেন তাঁর ফার্ম দেখাবার জন্য। ৬০০ হেক্টর জমির ওপর তাঁর ফার্ম। সেই ফার্মে হরিণ আছে, ছাগল, ভেড়াও আছে। নিউজিল্যান্ডে এসে ভেড়ার ফার্ম না দেখে যাবার কোনও মানে হয় না। কী করে ভেড়ার লোম কাটা হয় ও পশম তৈরি হয় সেটা দেখার খুব আগ্রহ ছিল আমার। কিন্তু রিচার্ডের কাছে জানলাম এই ফার্মে শুধু সিয়ারিং হয়। লোমগুলি রোল করে এবং প্যাক করে অন্যত্র পাঠানো হয় প্রসেসিং-এর জন্য। যে সব ভেড়া সিয়ারিং-এর উপযুক্ত তাদের আলাদা করে রাখা হয়। আমাদের দেখাবার জন্য রির্চাড ওদের একটাকে খাঁচা থেকে বার করে আনলেন। ভেড়া স্বভাবতঃই ভীরু প্রকৃতির তাই আসতে চাইছিল না। ভেড়াটাকে দু-পায়ের মধ্যে চেপে ধরে ক্লিপ দিয়ে লোম কাটতে লাগলেন। ভেড়াটা দক্ষ হাতে পড়ে বিশেষ ঝামেলা করল না।
এবারে আমাদের ভ্রমণের একেবারে শেষপর্ব। কাইকোরা থেকে ক্রাইস্টচার্চ। ল্যান্ডস্কেপের কোনও তুলনা নেই। ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। শুধু চোখ দিয়ে দেখা আর মনের মণিকোঠায় এর ছবিগুলি সযত্নে রেখে দেওয়া।
ক্রাইস্টচার্চে অনেক কিছু দেখার ছিল। কিন্তু ছিল না আমাদের হাতে খুব বেশি সময়। পাঁচটি প্রধান দর্শনীয় বস্তু ছিল ক্রাইস্টচার্চে— ক্যাটারপিলার গার্ডেন, বেলুন অ্যাডভেঞ্চার, উইলো ব্যাঙ্ক ওয়াইল্ড লাইফ রিসার্ভ, ক্যুইজ়, এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টারটিকা সেন্টার। আমরা শেষেরটি বেছে নিলাম। কেননা অ্যান্টারটিকা জানা কোনওদিন সম্ভব হবে না জেনে দুধের স্বাদ ঘোলেই মেটানোর পথটা বেছে নিলাম। টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। কৃত্রিম অ্যান্টারটিকা। তাই মনের মধ্যে ঔৎসুক্য থাকলেও উত্তেজনা ছিলনা। তাপমাত্রা যথেষ্ট নিচের দিকে। ভাবতে চেষ্টা করছি আমরা এখন মেরুপ্রদেশে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সত্যিই কি সেই হিমশীতলতা আছে এখানে? যাঁরা মেরুপ্রদেশে ঘুরে এসেছেন তাঁরা এখানে এলে বুঝবেন মানুষকে কত সহজে ভোলানো যায়। চারদিকে বড়বড় বরফের চাঁই। স্নো নিয়ে খেলছে শিশুরা।
হঠাৎ এই মেরুপ্রদেশে উঠল প্রবল ঝড়। আলোকসম্পাত ও শব্দসংযোজনায় ঝড়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা হল। সত্যিই চেষ্টার কোনও ত্রুটি নেই ট্যুরিস্ট বিভাগের। কিন্তু শিশুরা ভয় পেল না, ছুটে এল না মায়ের কোলে। বড়রা নির্ভাবনায় এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে থাকল। আসল আর নকলের ব্যবধানটা বুঝে নিয়ে আমার বেয়াড়া মনটা মুখ ফিরিয়ে থাকল। ওয়াইল্ড লাইফ রিজ়ার্ভে যাওয়া ভাল ছিল এর চেয়ে। এ ক’দিন এদেশে যা দেখেছি, যা উপভোগ করেছি তা ছিল একশো ভাগ সত্যি। তবে আজ কেন এই কৃত্রিম মেরুপ্রদেশে দেখবার সাধ জাগল? কল্পনায় না হয় বাঁচিয়ে রাখতাম সেই অদেখা দুর্গম মেরুপ্রদেশকে।
হোটেলে ফিরে এলাম — অদ্যই শেষরজনী। কাল সকালের ফ্লাইটেই ব্রিসবেন। ব্রিসবেন থেকে কলকাতা। এবারে মন গৃহাভিমুখী।
বিদায় নিউজ়িল্যান্ড। আর কোনওদিন হয়তো দেখা হবে না আমাদের। হয়তো কোনও অলস মধ্যাহ্নে বা কোনও বর্ষাবিহ্বল সন্ধ্যায় মনে পড়বে তোমাকে। তোমার এই অপরূপ বিচিত্র রূপরাশি কি ভোলবার? কখনও তুমি আগ্নেয়গিরির অগ্নিতেজে দর্পিতা, কখনও তুমি কল্লোলময়ী প্রগলভা ঝর্ণাধারায় পর্বতের পাষাণবক্ষে দোলা জাগাও। কখনও বা স্নেহময়ী জননীর মতো সবুজ আঁচল বিছিয়ে রেখেছ পাহাড়ে, প্রান্তরে। ফুলে-ফলে সমৃদ্ধ করে রেখেছ ধরিত্রীকে। তোমার কাছে চিরঋণী হয়ে রইলাম— হে বন্ধু বিদায়।