দুই হাজার চৌদ্দ সালের এক জরিপে এসেছিল, পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশের নাম ফিজি। এত ছোট এক দ্বীপরাষ্ট্র। কিন্তু বেশ ধনী ওই দেশ। জনপ্রতি জিডিপি দশ হাজার ডলার। ফিজিয়ান ডলারের মানও অনেক। এক মার্কিন ডলারে ফিজিয়ান ডলার মাত্র দুই। ইউরোপের দেশ ফিজি। দেশটিতে প্রচুর নির্মাণ শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে। থাকা, খাওয়া ও ভালো বেতনের পাশাপাশি দেশটির আবহাওয়াও চমৎকার। ফলে আমাদের দেশ থেকে বা তুলনামূলক কম সচ্ছল মানুষেরা দালালদের খপ্পরে পড়ে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড যেতে চেয়ে পৌঁছে যেতো এখানেই।
১৯ শতাব্দীর শুরুতেই ইউরোপীয় অধিবাসীরা ফিজি এসেছিল। তারও আগে ১৬৪৩ সালে একজন ডাচ আবেল তাসমান ফিজি আসেন। ১৮৭৪ সালে ফিজি ব্রিটেনের উপনিবেশে পরিণত হয়। ১৯৭০ সালের ১০ অক্টোবর, ফিজি স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৯৮ সালের ২৭ জুন দেশটির নতুন সংবিধান কার্যকর হয়। একই সঙ্গে দেশের নাম ফিজি দ্বীপপুঞ্জ প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়।
ভারতীয়দের যেভাবে এখানে আনা হয়েছিল-সে কাহিনী সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের বর্বর চরিত্রের ঘৃণ্য উপমা। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা যখন এই অঞ্চলে তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে, তখন লক্ষ যে করে এখানকার আদিবাসীরা চাষাবাদে একেবারে অজ্ঞ-অনভিজ্ঞ। ইংরেজ গভর্নর তখন চিন্তা করল- ভারতীয় অভিজ্ঞ চাষীদের এখানে নিয়ে এলে ভালো হবে। ভারতও তখন তাদের সাম্রাজ্যবাদী কলোনী। যেই ভাবনা সেই কাজ। মাদ্রাজ, কেরালা, বাঙ্গাল ও উত্তরপ্রদেশজুড়ে গরিব কৃষকদের মধ্যে শুরু হয় তৎপরতা। ভারতীয় দরিদ্র কৃষকদের অল্প পরিশ্রমে বেশি উপার্জনের প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসা হয় হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত ফিজিতে। অতঃপর তাদের মাথায় পরানো হয় দাসত্বের শিকল। তাদের ওপর চালানো হতো পাশবিক নির্যাতন।
ভারতীয় এসব মানুষের একটা অংশ মুসলমানও ছিল। তাদের মাধ্যমেই এ অঞ্চলে ইসলামের প্রচার ঘটে। সর্বপ্রথম যাঁরা এখানে এসেছিলেন, তাঁরা নামাজ, রোজা প্রভৃতি ধর্মীয় মৌলিক বিষয় মেনে চলত। তাঁরা ইসলামের প্রতীকী বিষয়গুলোর প্রতি যত্নবান ছিল। তারাই এখানে প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন। কিন্তু যেহেতু নতুন প্রজন্মের ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না; তা ছাড়া হিন্দু, খ্রিস্টান ও শিখদের সঙ্গে ছিল সার্বক্ষণিক মেলামেশা-ফলে ধীরে ধীরে দ্বীনের অনুসরণ ও ধর্মীয় আমল-আচরণ ম্লান ও প্রাণহীন হয়ে পড়ে। এরপর সর্বপ্রথম সম্ভবত ১৯৬৭ সালে জাম্বিয়া থেকে একটি তাবলিগ জামাতের আগমন হয়। তারাই ধর্মের প্রতি ফিরে আসার প্রেরণা জাগিয়ে তোলেন। এখানকার অধিবাসীরাও তাদের ধর্মীয় কর্তব্যের কথা জানতে পারে। নতুন নতুন মসজিদ নির্মাণ শুরু হয়। সেখানে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্যে মক্তব প্রতিষ্ঠিত হয়।
দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র ফিজি ৩৩০টিরও বেশি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে ১১০টিতেই জনবসতি নেই। সব দ্বীপ মিলিয়ে মোট আয়তন ১৮ হাজার ২৭৪ বর্গকিলোমিটার। সবচেয়ে দূরবর্তী দ্বীপ ওয়ান-আই-লাও। সবচেয়ে জনবসতি ভিটি লেভু ও ভানুয়া লেভু দ্বীপ। এই দুটি দ্বীপেই বাস করে দেশটির প্রায় ৮৭ শতাংশ মানুষ। দেশটির লোকসংখ্যা ৮ লাখ ৬৮ হাজার। এতে ৫১ শতাংশ হলো ফিজি জাতি। ৪৪ শতাংশ হলো ভারতীয় জাতি।
ফিজির মূল বন্দরটি রাজধানী সুভায় অবস্থিত। নিকটবর্তী প্রতিবেশীরা হলো পশ্চিমে ভানুয়াতু, দক্ষিণ-পশ্চিমে ক্যালাডোনিয়া, দক্ষিণ-পূর্বে নিউজিল্যান্ড, পূর্বে টোঙ্গা, উত্তরে টুভালু ও উত্তর-পূর্বে ফ্রান্স। ওই অঞ্চলের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ ফিজি। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশটির আয়ের মূল উৎস বনভূমি, খনিজ ও মাছ। তবে ইদানীং পর্যটন ও চিনি রপ্তানি থেকেও ভালো আয় হয়।
আধুনিক বহু গবেষণা মতে, সূর্যোদয়ের দেশ হলো ফিজি। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব প্রান্তে ক্ষুদ্র একটি দেশের নাম ফিজি। ইন্টারন্যাশনাল ডেটলাইনে অবস্থিত পৃথিবীর একমাত্র আবাদ অঞ্চল এটি। এ ডেটলাইনের পাশেই রয়েছে একটি মনোরম মসজিদ। এখান থেকেই প্রতিদিন পৃথিবীর সর্বপ্রথম আজান শোনা যায়। এখানেই প্রতিদিন সবার আগে সূর্য ওঠে। তিন শর বেশি ছোট-বড় দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে এই নজরকাড়া দেশ। এর বেশির ভাগ দ্বীপই এখনো আবাদ হয়নি। আয়তনেও দেশটি খুবই ক্ষুদ্র। দুটি দ্বীপ বেশ বড়। ফিজির বেশির ভাগ শহর এ দুটি দ্বীপে অবস্থিত। সবচেয়ে বড় দ্বীপটির নাম হলো ভিতি। রাজধানী সুভা, এখানেই অবস্থিত। দ্বিতীয় দ্বীপ ভেনিয়া। প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে যারা এই ফিজির দ্বীপগুলোতে বসবাস করছে, তাদের ‘কাভেতি’ বলা হয়। প্রচলিত আছে—তারা আফ্রিকার টাঙানেকা থেকে এসে এখানে বসতি গড়েছিল। টাঙানেকাই বর্তমান কেনিয়া। কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, তারা মূলত ইন্দোনেশিয়া থেকে আগত। তবে তাদের অবয়বে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার ছাপ বিদ্যমান।
একনজরে
পুরো নাম : রিপাবলিক অব ফিজি।
রাজধানী ও সর্ববৃহৎ শহর : সুভা।
দাপ্তরিক ভাষা : ইংরেজি, ফিজিয়ান ও হিন্দি।
সরকার পদ্ধতি : ইউনিটারি পার্লামেন্টারি রিপাবলিক।
প্রেসিডেন্ট : জর্জ কনরোট।
প্রধানমন্ত্রী : ফ্রাঙ্ক বাইনিমারামা।
আইনসভা : পার্লামেন্ট।
স্বাধীনতা : ব্রিটেন থেকে ১০ অক্টোবর ১৯৭০।
আয়তন : ১৮ হাজার ২৭৪ বর্গকিলোমিটার।
জনসংখ্যা : ৯ লাখ ৯ হাজার ৩৮৯।
ঘনত্ব : প্রতিবর্গকিলোমিটারে ৪৬.৪ জন।
জিডিপি : মোট ৮.৩৩০ বিলিয়ন ডলার।
মাথাপিছু : ৯ হাজার ৩১৪ ডলার।
মুদ্রা : ফিজিয়ান ডলার।
জাতিসংঘে যোগদান : ১৩ অক্টোবর ১৯৭০।
ছবি ও তথ্য – ইন্টারনেট