চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মোহাম্মদ আতিক প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টাকা খরচ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) আজমান রাজ্যে গেছেন। পারিবারিক কৃষিজমি বিক্রি করে তিনি এই টাকার ব্যবস্থা করেন। এক বছর ধরে আজমানে অবস্থান করলেও কোনো কাজের ব্যবস্থা করতে পারেননি তিনি। যে কোম্পানির মাধ্যমে গেছেন, তারাও কিছু করতে পারছে না। ফলে তাঁকে ঘুমাতে হচ্ছে পার্ক, মার্কেট ও মসজিদে। একদিন চাকরি পাবেন, এই আশায় দেশটিতে পড়ে রয়েছেন তিনি। প্রবাসে আয় করে দেশে টাকা পাঠানো দূরের কথা, উল্টো তাঁর খাওয়ার জন্য এখন দেশ থেকে প্রতি মাসে ছয় হাজার টাকা পাঠাচ্ছে পরিবার।
মোহাম্মদ আতিকের মতো এমন হাজারো বাংলাদেশি আরব আমিরাতের দুবাই, শারজা, আজমান, আবুধাবিসহ বিভিন্ন রাজ্যে বেকার দিন পার করছেন। দেশে রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী আয় পাঠানোর পরিবর্তে তাঁরা জীবিকা নির্বাহের জন্য ন্যূনতম যে অর্থ প্রয়োজন, তা দেশ থেকে নিচ্ছেন। এসব অর্থ লেনদেন হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে, যা দেশে সংগ্রহ করা হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা (এমএফএস) ব্যবহার করে। কারণ, অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন করলে সহজে ও স্বল্প সময়ে অর্থ দেশে পৌঁছায়। আবার হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠালে বেশি টাকা পাওয়া যায়।
এ কারণে ইউএইতে জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও সেই তুলনায় প্রবাসী আয় আসা বাড়ছে না দেশটি থেকে। অবশ্য আগের চেয়ে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কারণ, ইউএই থেকে অনেকে অন্যত্র চলে গেছে। ইউএইতে বসবাসকারী বেশ কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি জানান, ছয় মাস আগেও সেখানকার বিভিন্ন পার্ক দিনরাত বাংলাদেশি শ্রমিকে ভরা থাকত। তাঁদের অনেকেই এরই মধ্যে হয় দেশে ফিরেছেন। নয়তো অন্যত্র চলে গেছেন। আবার যাঁরা কাজ পেয়েছেন, তাঁরা মেস বা বাসায় উঠেছেন। ফলে এখন পার্কগুলোতে স্থান নিয়েছে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা জনগোষ্ঠী।
সাড়ে ছয় লাখ টাকা খরচ করে এসেছি। কিন্তু কোনো কাজ নেই। মাঝেমধ্যে ঘণ্টা ভিত্তিতে বাংলাদেশি হোটেলে কাজ করলেও স্থায়ী কাজ পাইনি।
রফিকুল ইসলাম, মহেশখালী থেকে ইউএইর আজমানে যাওয়া শ্রমিক
গত ১০ বছরের মধ্যে ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি জনশক্তি রপ্তানি হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই)। গত বছর দেশটিতে যান ১ লাখ ১ হাজার ৭৭৫ বাংলাদেশি। তবে গত ৬ অর্থবছরের মধ্যে সবচেয়ে কম ২০৭ কোটি ডলার প্রবাসী আয় আসে ২০২১-২২ অর্থবছরে। কারণ, দেশটিতে যাওয়া অনেককেই দীর্ঘ সময় বেকার থাকতে হয় কিংবা দেশে ফিরে আসতে হয়েছে। আবার অনেকে অন্য দেশে পাড়ি দিয়েছেন। ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ইউএইতে গেছেন মোট ২১ লাখ ৪২ হাজার ৪৯৯ বাংলাদেশি।
গত ফেব্রুয়ারির শেষ দুই সপ্তাহ আরব আমিরাতের আজমান, আবুধাবি ও দুবাইয়ের বিভিন্ন শহরে অবস্থান করে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশির সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁদের অধিকাংশই ২০২২ সালে কাজের খোঁজে দেশটিতে পাড়ি দেন। আজমানের সবজিবাজারে কথা হয় কক্সবাজারের মহেশখালীর রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সাড়ে ছয় লাখ টাকা খরচ করে এসেছি। কিন্তু কোনো কাজ নেই। মাঝেমধ্যে ঘণ্টা ভিত্তিতে বাংলাদেশের হোটেলে কাজ করলেও স্থায়ী কাজ পাইনি। যে টাকা পাই, তা দিয়ে থাকা ও খাওয়ার খরচ হয় না। বাড়ি থেকে প্রতি মাসে কিছু টাকা আনতে হয়।’ তাঁর মতো আরও অনেককে পাওয়া যায় ওই বাজারে। বাজারটির বেশির ভাগ দোকানের অংশীদারও বাংলাদেশিরা।
বাংলাদেশ থেকে যাঁরা এ দেশে আসছেন, তাঁদের বুঝেশুনে আসা উচিত। নিয়ম মেনে ও প্রশিক্ষণ নিয়ে এলে এ দেশে ভালো থাকবেন। নিয়মিত আয় করতে পারবেন।
শওকত আলী মোল্লা, এমডি, গ্র্যান্ড স্টার ট্রাভেলস, দুবাই
একই চিত্র পাওয়া যায় দুবাইয়ের ডেইরা এলাকার আল মুতিনা সড়কেও। সড়কটি বাংলাদেশি অধ্যুষিত। সেখানেও অনেক বাংলাদেশিকে বেকার ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। ইউনিয়ন মেট্রোস্টেশনের সামনে কথা হয় মহেশখালীর আলতাফ হোসেনের সঙ্গে। তিনিও গত বছরে কাজের খোঁজে গিয়ে বেকার দিন কাটাচ্ছেন। স্টেশনসংলগ্ন পার্কে রাতে ঘুমান। খাওয়ার টাকা আসে বাড়ি থেকে। এ ছাড়া ডেইরা এলাকার বাংলাদেশি মালিকানাধীন থাকার ও খাবার হোটেলগুলোর সামনেও দিনদুপুরে অনেককে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। কথা বলে জানা যায়, তাঁদের মধ্যে অনেক সময় সংঘর্ষও হচ্ছে। অপরাধী চক্রের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছেন কেউ কেউ। কোনোমতে দেশটিতে কাউকে প্রবেশ করাতে পারলেই তারা বড় অঙ্কের অর্থ পেয়ে যাচ্ছে। এ জন্য ভ্রমণ ভিসার নামে দেশটিতে জনশক্তি রপ্তানি অব্যাহত আছে। তবে অপরাধের কারণে অনেক বাংলাদেশি এখন দেশটির জেলে রয়েছেন।
দুবাইয়ের ডেইরা এলাকায় বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন মোবাইল রিচার্জ, বিমানের টিকিট বিক্রেতা ও মোবাইল বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো অবৈধ হুন্ডি কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছে। দুবাই থেকে কেউ দেশে টাকা পাঠালে প্রতি দিরহামের জন্য দেশে দেওয়া হচ্ছে ৩১ টাকা ৮০ পয়সা। আর বাংলাদেশ থেকে পাঠাতে চাইলে প্রতি দিরহামের জন্য তারা নেয় ৩১ টাকা ৭৫ পয়সা।
আরব আমিরাত থেকে অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমেই বেশি অর্থ আসে। আবার দেশ থেকেও হুন্ডির মাধ্যমেই টাকা পাচার হচ্ছে। ওই টাকা দিয়ে দেশটির অভিজাত এলাকাগুলোয় তারকা হোটেল, ফ্ল্যাটবাড়ি কিনছেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী, আমলা, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
দুবাইয়ে প্রায় ২৫ বছর ধরে বসবাস করছেন গ্র্যান্ড স্টার ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শওকত আলী মোল্লা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যাঁরা এ দেশে আসছেন, তাঁদের বুঝেশুনে আসা উচিত। নিয়ম মেনে ও প্রশিক্ষণ নিয়ে এলে এ দেশে ভালো থাকবেন। নিয়মিত আয় করতে পারবেন। বৈধ পথে আয় পাঠালে বাংলাদেশের অর্থনীতিও ভালো থাকবে।’