২০১৩ সালে আমরা ৩ ভাইবোনের পরিবারের ১১ জন মিলে ১০ দিন মালয়েশিয়া আর সিঙ্গাপুরে ভ্রমণ করি। সেই লম্বা সফরে আমরা মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর, লাংকাউই দ্বীপ আর পেনাং শহর ভ্রমণ করে পেনাং এয়ারপোর্ট দিয়ে সোজা সিঙ্গাপুরে চলে আসি। সিঙ্গাপুরের জন্য মাত্র ৩ দিন বরাদ্ধ ছিলো। ফলে সিঙ্গাপুরের বেশ কিছু অবশ্যদ্রষ্টব্য জায়গা দেখা হয়নি সেবার। ৩ দিনের সিঙ্গাপুর ভ্রমণে আমরা সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত সান্তোসা আইল্যান্ড (Santosa Island), সিঙ্গাপুর ফ্লাইয়ার (Singapore Flyer) বা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নাগরদোলা আর কিছু শপিং সেন্টারে ঘুরাঘুরি করে কাটিয়ে দেই। লম্বা সফরের শেষের দিক ছিলো বলে আমরা বেশ ক্লান্তও ছিলাম ফলে সিঙ্গাপুরের অনেক কিছুই অদেখা থেকে যায়। তবে সেই সফরে আমরা যখন সিঙ্গাপুর ফ্লাইয়ারের উপরে উঠেছিলাম তখন সেখান থেকে সিঙ্গাপুরের প্রায় অর্ধেক আকর্ষনীয় জায়গা দৃশ্যগোচর হয়েছিলো। সিঙ্গাপুর ছোট জায়গা। সিঙ্গাপুর আসলে একটি শহর আবার সেই শহরটিই একটি দেশ। আর সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা মেরিনা বে (Merina Bay) বা মেরিনা উপসাগর। এটা সমুদ্রের সাথে সংযুক্ত একটা লেকের মতো। এই উপসাগরের চারপাশেই সিঙ্গাপুরের বেশকিছু আকর্ষনীয় জায়গার অবস্থান। ফলে পর্যটকরা চাইলে খুব অল্প সময়ে সিঙ্গাপুরের এই বড় অংশটি নিজে নিজে ভ্রমণ করতে পারে।
দুই দফার ভ্রমণে আমি সিঙ্গাপরে মোট ১৩ দিন থেকেছি। আর সিঙ্গাপুরের বেশ অনেক জায়গা ভালো ভাবেই ঘুরতে পেরেছি আমি। সেজন্য বলা যায়, সিঙ্গাপুরে আমার অনেক স্মৃতি। তারপরও এই লেখায় আমি আলাদাভাবে সিঙ্গাপুরের যে বিখ্যাত জায়গাটি নিয়ে লেখতে বসেছি তার নাম ‘গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে’ (Gardens by the Bay)। ‘গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে’ নামের ঐ জায়গাটি আমার প্রথম চোখে পরে সিঙ্গাপুর ফ্লাইয়ার বা বিশাল নাগরদোলা টাইপ জিনিসের একটি ক্যাপসুল টাইপ চেম্বারে বসে। সিঙ্গাপুর ফ্লাইয়ার লন্ডনের লন্ডন আইয়ের মত, তবে উচ্চতায় মনে হয় লন্ডন আইয়ের চেয়েও কিছুটা বেশি। একেবারে বিশালাকার যাকে বলে। যাইহোক ফ্লাইয়ারের রাইডে চেপে আমাদের ক্যাপসুলটা যখন একদম উপরে উঠেছিলো তখন চারিদিকে তাকিয়ে রাতের সিঙ্গাপুরকে অলৌকিক একটা জায়গা মনে হয়েছিলো।
নানা রঙের আলোয় ঝলমলে সিঙ্গাপুরের রাতের রূপ দেখে বর্তমান দুনিয়ার পর্যটকদের জন্য সিঙ্গাপুর কেন এত আকর্ষনীয় একটা জায়গা সেটার কারণ বেশ বুঝতে পেরেছিলাম। সিঙ্গাপুর ফ্লাইয়ারের উপর থেকে সেবার আমরা অনেক কিছুই দেখেছিলাম। পৃথিবীর অন্যতম বিশ্বয়কর হোটেল মেরিনা বে স্যান্ডস (Merina Bay Sands), যেটা পাশাপাশি তিনটি ৬০ তালা বিল্ডিয়ের উপরে একটা জাহাজাকৃতির সমতল ছাদ দিয়ে সংযুক্ত, সেই হোটেল বিল্ডিংটি ফ্লাইয়ারের একদম কাছে থাকায় আমরা খুব মন দিয়ে ওটা দেখেছিলাম। মেরিনা বে উপসাগর, তার চারিদিকের বড় বড় বিল্ডিং আর মেরিনা বে তে ভেসে বেড়ানো রং বে রঙয়ের নৌযান, মারলায়ন পার্কের মারলায়ন ঝর্ণা, সব কিছুই দেখা যাচ্ছিলো। কিন্তু আমার খুব বেশি চোখে পড়ছিলো মেরিনা বে স্যান্ডস হোটেলের পিছে বিশাল বিশাল বৃক্ষাকৃতি কিছু স্থাপনা, যেগুলো বিভিন্ন রঙের আলোয় উজ্জ¦ল দেখাচ্ছিলো। পরে খোঁজ নিয়ে নাম জেনেছিলাম, ঐটি গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে উদ্যান। যেহেতু আগে থেকে গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে সম্পর্কে কিছু জানা ছিলো না, ফলে আমাদের ঘুরতে যাওয়ার তালিকায় নাম ছিলোনা। পরিনামে, আমার ব্যক্তিগত প্রচুর আগ্রহ থাকা সত্বেও সেই ট্যুরে আর গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে তে আর যাওয়া হয়ে উঠে নি।
আধুনিক সিঙ্গাপুর অনেক পর্যটকের প্রিয় জায়গা। আর আমি সচরাচর বলো থাকি যে সিঙ্গাপুরের ‘গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে’ পৃথিবীর বুকে আমার সবচেয়ে প্রিয় একটা জায়গা। অনেকে হাসতে পারে এই বিপুলা পৃথিবীর আমি কতটুকুই বা দেখেছি যে অন্য কোন দেশের কোন জায়গাকে সবচেয়ে প্রিয় জায়গা বলার অধিকার আমার থাকতে পারে! আসলে আমি যে কারনে এটা বলি সেটা হচ্ছে জায়গাটিতে খুব অল্প সময়ে বেশ কয়েকবার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও সুখস্মৃতি আমার আছে, আর এটার অবাক করা সৌন্দর্যের কারণে জায়গাটি আমার হৃদয়ের মনিকোঠায় জায়গা করে নিতে পেরেছে। আর সবচেয়ে বড় কারণ আমার পুরো পরিবারের বেশ সুন্দর কিছু সুন্দর স্মৃতি রয়েছে স্বপ্নের বাগানের মতো জায়গাটিতে এবং সিঙ্গাপুরের অন্যান্য কিছু জায়গা কেন্ত্র করে।
এবার বিস্তারিত প্রসঙ্গে আসি, কিভাবে গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে এবং সিঙ্গাপুরের আরও কয়েকটি অসাধারন জায়গার সাথে আমার পরিচয় কিভাবে হলো, সেই অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে। ২০১৩ সালে সিঙ্গাপুরে প্রথম ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। এই লেখার প্রথমেই বলেছিলাম সিঙ্গাপুর ফ্লাইয়ারের উপরে বসে প্রথম দেখেছিলাম স্বপ্নের মতো সুন্দর গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে’র ঝলক। কিন্তু সেই সফরে আর যাওয়া হয়ে উঠেনি। কিন্তু সেবার র্ডেনস্ বাই দ্যা বে মিস করলেও দেশে ফিরার পর গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে বিষয়ে বেশ গবেষণা করেছিলাম ইন্টারনেট ঘেটে। জানা গেলো ‘গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে’ আসলে একটি প্রাকৃতিক উদ্যান। পুরো এলাকার পরিমান ১০১ হেক্টর বা ২৫০ একর। এই বাগানের মধ্যে তিনটি ভাগ বা আলাদা আলাদা বাগান আছে। দেখার মতো অনুভব করার মতো অনেক জিনিস এখানে আছে যেগুলো নিয়ে আলোচনা করে আমার অতি সাধারন মানুষের ভ্রমণকাহিনীটি ভারি করতে চাই না। আপনারা ইন্টারনেটের সাহায্যে জায়গাটির অতি সুন্দর ছবি ও তথ্যাদি দেখে নিতে পারেন। আমি চলে যাই আমার পরের সিঙ্গাপুর সফরের স্মৃতিচারণে, যে সফরটি দীর্ঘ ১০ দিন ব্যাপি করেছিলাম।
আমরা দ্বিতীয়বার সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করি ২০১৫ সালে। বেশ লম্বা ট্যুর ছিলো সেটা। আমি আর আমার পরিবার ১০ দিনের জন্য সেবার সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করি। পুরা ট্যুরটা ঠিক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ছিলো না। আমার ছেলেকে সিঙ্গাপুরে চেকআপ করতে নিয়ে গিয়েছিলাম । হাসপাতালে ঠিক কতো দিন লাগতে পারে, সে বিষয়ে কোন আইডিয়া না থাকাতে লম্বা সময় নিয়ে গিয়েছিলাম। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের মানুষের প্রিয় জায়গা লিটল ইন্ডিয়ার খুব কাছে ম্যাকেঞ্জি রোডের হোটেল সোলক্স ইন (Soluxe Inn) এ উঠেছিলাম প্রথম ৫ দিনের জন্য। কারন যে হাসপাতালে আমরা এ্যাপয়েন্টমেন্ট করে গিয়েছিলাম, সেই কে কে হাসপাতাল (KK Hospital, Singapore) আমাদের হোটেল থেকে হাটা পথ ছিলো।
সিঙ্গাপুরে বেশ অনেকদিন যেহেতু ছিলাম, আমাদের চলাফেরায় টুরিষ্টদের মতো কোন হাবভাব ছিলো না। এমন কি আমরা কোন আইটেনারী বা ভ্রমণসূচীও করিনি। সিঙ্গাপুর পৃথিবীতে বিখ্যাত খরুচে জায়গা হিসাবে। ফলে প্রথম দিন থেকে থাকা খাওয়া ও হাসপাতালে যাওয়া নিয়ে অনেক মজার অভিজ্ঞতা আছে, সে বিষয়ে অন্য আরেকদিন আলোচনা করা যাবে। সেই ট্যুরের প্রথম ৪ দিনেই হাসপাতালের কাজ শেষ হয়ে গেলো। আমাদের হাতে তখনও ৬টি পুরো দিন থেকে গেলো। প্রথমে চিন্তা করা হলো টিকেট বদলে আমরা দেশে ফিরে যাবো কিনা? পরে অনেক চিন্তা করে ঠিক করা হলো, এসেই যেহেতু পরেছি সিঙ্গাপুরটা ঘুরেফিরে খেয়ে ঘুমিয়ে দেখেই যাই এবার। আবার কবে আসা হবে, কে জানে।
সিঙ্গাপুর ঘুরার জন্য ৬ দিন অনেক বেশি সময়। ফলে আমাদের কোন তাড়াহুড়ো ছিলো না। পঞ্চম দিন সকাল ১০ টায় ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে আবার হোটেলে ফিরে বাচ্চাদের সাথে হুটোপুটি করে ঘুম দিয়ে দুপুর হয়ে গেলো। তখনও কোন পরিকল্পণা ছিলোনা কোথায় বের হওয়ার। একদম রিল্যাক্স হয়ে হোটেলে বসে থাকার অভিজ্ঞতা আগে কখনও ছিলো না, ফলে ব্যাপারটা খুব মজা লাগছিলো। দুপুরে হঠাৎ মনে হলো সিঙ্গাপুরের আসল চেহারাটা না দেখলে মনে হচ্ছে আমরা বাংলাদেশের বাহিরে খুব উন্নত একটি শহরে আছি সেই বোধটি ঠিক আসছে না।
কেবল একটু বেশি রকমের পরিস্কার পরিচ্ছন্ন একটা জায়গায় আছি এটা ছাড়া স্পেশাল কিছু মনেই হচ্ছিলো না। দুপুর একটার দিকে স্ত্রী আর দুই বাচ্চাকে বললাম চলো এবার সত্যিকারের সিঙ্গাপুর দেখে আসি। দেশ বা বিদেশে আমাদের ট্যুর গুলোতে আর্মির মতো কমান্ড শোনার অভ্যাস করিয়েছি বউ বাচ্চাকে। সবাই খুব অল্প সময়ে তৈরী হয়ে নিলো। হোটেলের নিচ তালাতে ঐতিহ্যবাহী একটি হালাল চাইনিজ রেস্টুরেন্টে আগের পাঁচ দিনের তিন দিন নাস্তা করা হয়েছিলো। সেখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই রেডি। গন্তব্য মারলায়ন পার্ক (Merlion Park)। আধুনিক সিঙ্গাপুরের প্রতীক হচ্ছে মারলায়ন অর্থাৎ মাছ বা মারমেইড আর সিংহের মিলিত মূর্তিরূপ। এই মারলায়নের চেহারা দিয়ে তৈরী হয়েছে বিরাট পানির ফোয়ারা। মেরিনা বে’র এক পাশে। মেরিনা বের একপাশে মারলায়ন পার্ক, ওপর পাড়ে মেরিনা বে স্যান্ডস্ হোটেল ও শপিং সেন্টার। একটা এলাহি ব্যাপার বলা যায়। না দেখলে বোঝানো কঠিন। তবে মেরিনা বে স্যান্ডস হোটেল তৈরীর আগে পর্যটকরা মারলায়ন পার্কের ফোয়ারার সামনে ছবি তুলেই তাদের সিঙ্গাপুরের স্মৃতি সংরক্ষণ করতো।
মারলায়ন পার্কে যাবো, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বের হয়েছিলাম, কিন্তু মনে মনে আশা করছিলাম, যদি সময় পাই তবে গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে তে ঘুরে আসবো। ট্যাক্সি ধরে মারলায়ন পার্কে রওনা দিয়েছিলাম ২টা ৩০ মিনিটে। রাস্তায় ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে গল্প করতে করতে গেলাম। মারলায়ন পার্ক থেকে গার্ডেনস বাই দ্যা বে কত দুরে আর কত সময় লাগবে জিজ্ঞাসা করাতে ও বললো, তোমরা ইচ্ছা করলে ওখান থেকে হেটেই চলে যেতে পারবে। তবে ৩০ মিনিট হাটতে হবে। আগেই বলেছি আমরা ঘুরতে গেলে আর্মি রুলস ফলো করি। ট্যাক্সিতে থাকতেই সবাইকে মনে করিয়ে দিলাম, আজকে কিন্তু হাটতে হবে। সবাই দেখলাম ভাবলেসহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আমি জানি মনে মনে সবাই খুব এক্সাইটেড, কারন ততক্ষণে আমরা সিঙ্গাপুরের সিবিডি (CBD) বা সিঙ্গাপুর সেন্ট্রাল বিজনেজ ডিস্ট্রিক্ট (Central Business District) এর দিকে বিশাল রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছি। বামে পড়লো এক সময়ের বিখ্যাত ডুরিয়ান (Durian) অথবা কাঠালের মতো দেখতে Esplanade Theatres নামে বিশাল কনভেনশন সেন্টার।
এই থিয়েটার বিল্ডিংয়ে ১৬০০ এবং ২০০০ সিটের বিশাল কনসার্ট হল আছে। সিডনির অপেরা হাউসের মতো দ্যা এসপ্লানেড নামের এই বিল্ডিংটিও একদা জগৎ বিখ্যাৎ ছিলো। কিন্তু পর্যটকদের কাছে সিঙ্গাপুরের নতুন ল্যান্ডমার্ক ‘মেরিনা বে স্যান্ডস হোটেল’ আর ‘গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে’ উদ্যানের এর সুনাম বেড়ে যাওয়ায় বেচারা Esplanade Theatres এর কদর কমেছে বেশ। বামে এসপ্লানেডকে রেখে সামনে তাকিয়ে আমাদের শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা। বিশাল রাস্তা বামে মেরিনা বে বা উপসাগরকে রেখে সোজা চলে গেছে ৬০-৭০ তালা এক গুচ্ছ বিল্ডিংয়ের দিকে। সিঙ্গাপুর সিবিডির দিকে। বিল্ডিংগুলো মনে হলো নিজেদের মধ্যে উচ্চতা আর বিশালত্বের প্রতিযোগীতায় মত্ত। মনে আছে ট্যাক্সির সামনের সিট থেকে আমার মেয়ের দিকে ঘাড় কাত করে তাকিয়ে বলেছিলাম, আমাদের সিঙ্গাপুর ট্যুর শুরু হয়ে গেলোরে।
মারলায়ন পার্ক জায়গাটা শুরু থেকেই আমাদের মনে ব্যাপক মুগ্ধতা তৈরী করেছিলো সেদিন। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ধন্যবাদ দিয়ে আমরা হইচই করতে নেমেছিলাম সেদিন। চারিদিকেই বিস্ময়কর দৃশ্য। সোজা রাস্তা চলে গেছে ভিষণ উচুঁ বিল্ডিয়ের গুচ্ছের দিকে। আমাদের ডানে প্রায় শতবর্ষ পুরোনো দৈত্যাকার বিল্ডিংটা হোটেল ফুলারটন বে। ভিষণ আধুনিকের মধ্যে যেন ঐতিহ্যের ছোয়া। তবে দেখতে মোটেই বেমানান নয়। আর বামে বিরাট মেরিনা বে উপসাগর। তার চারপাশে যেন মনি মানিক্যের মতো ছড়িয়ে আছে সিঙ্গাপুরের নাম করা স্থাপনাগুলো। তিনটি ৬০ তালা বিল্ডিংয়ের মাথায় জাহাজ আকৃতির ছাদ দিয়ে সংযুক্ত মেরিনা বে স্যান্ডস্ হোটেলটিই সব মনি মানিক্যের মধ্যে যেন কহিনুর হিরা, সেভাবেই নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিলো।
মেরিনা বে স্যান্ডস হোটেলের সাথে সাথে চোখের সামনে মাথা তুলে দাড়িয়ে ছিলো সিঙ্গাপুর ফ্লাইয়ার (Singapore Flyer) নাগরদোলা। অসংখ্য ৫ তারা হোটেলের বড় বড় বিল্ডিং ছড়িয়ে ছিলো উপসাগরের একটি পাড় ধরে। মারলায়ন পার্কের ঝর্ণা দেখতে দেখতেই চারিদিকের এসব জিনিস দেখা হয়ে যাচ্ছিলো। পুরো উপসাগর জুড়ে নানা রকম ছোট বড় নৌযানে পর্যটকদের ভ্রমণ করা দেখতেও মজা লাগছিলো। ঝর্ণাকে পিছে রেখে পর্যটকদের ছবি তোলার তোড়জোড়ও দেখার মতো। কতো মজার মজার আইডিয়াতে যে ছবি তুলছিলো সবাই। আমরাও ঝর্ণার কিছু মজার ছবি তুলেছিলাম। প্রায় আধাঘন্টা মারলায়ন পার্কে থাকা হলো। যেহেতু বেশ গরম ছিলো তাই আইসক্রিম খেয়ে বেশ আরাম পাওয়া গেলো।
এরপর মেরিনা উপসাগরের এক পার ধরে বৃত্তাকারে অপর পারের মেরিনা বে স্যান্ডস হোটেলের দিকে হাটা দিলাম ট্যাক্সি ড্রাইভারের দেখিয়ে দেয়া দিক অনুয়ায়ী। বেশ অনেক দুরের পথ। ছোট দুই বাচ্চা ও স্ত্রী নিয়ে অন্য কেউ এই দুঃসাহস দেখাতো কি না জানিনা, তবে আমার চেয়ে আমার পরিবারের উৎসাহ অনেক বেশি ছিলো। তবে চারিদিকের অপূর্ব দৃশ্য আমাদের এক মূহুর্তের জন্যও শারীরিক কষ্টকে অনুভব করতে দেয়নি। ধিরে ধিরে মারলায়ন পার্ক ও তার পিছের বহুতল বিল্ডিংগুলো আমাদের থেকে অনেক দুরে চলে গেলো। আমরা তখন মেরিনা উপসাগরের পাড় ধরে হেটে চলেছি। মাঝে মাঝে পাড়ে পাতা বেঞ্চিতে বসে বিশ্রাম নিয়েছি। পুরো যাত্রাটা ছিলো মনে রাখার মতো। গোল উপসাগর থেকে একটি শাখা বের হয়ে সমুদ্রের দিকে চলে গেছে মেরিনা বে স্যান্ডস হোটেলের পাশ দিয়ে। ঐ যায়গাটিতে একটি সাইন্স ফিকশন গল্প থেকে তুলে আনা চেহারার পায়ে হাটা সেতু আছে। নাম হেলিক্স ব্রিজ (Helix Bridge) । সাসপেনশন ব্রিজটি পুরোটাই স্টেইনলেস স্টিলের তৈরী। সুন্দর হেলিক্স ব্রিজে উঠার পর খেয়াল করলাম, প্রায় ২ কিলোমিটার হেটেও আমাদের মন খারাপ লাগছিলো না এক রত্তি।
ব্রিজ পেরিয়ে মেরিনা বে হোটেল আর সংলগ্ন ম্যামথ সাইজের বিশাল শপিং সেন্টার প্রাঙ্গনে ঢুকে পরলাম। বাহিরে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে বেশ কিছু ছবিটবি তুলে শপিং সেন্টারে ঢুকে পারলাম। সেভেন স্টার হোটেলের সাথের শপিং সেন্টার বেশ দামি হওয়ারই কথা। আমরা ঢুকেই নিচতালার ফুড কোর্ট খুঁজে হালকা ফাস্ট ফুড খেয়ে নিলাম। ফুড কোর্টের সাথেই আইস স্কেটিং রিং। খাওয়া দাওয়া সেরে প্রায় ৫ তালার সমান উচুঁ বিরাট একটা এসকেলেটার দিয়ে শপিং সেন্টারের ছাদ টাইপের বারান্দায় উঠেছিলাম। ওখান থেকেই মেরিনা বে স্যান্ডস এর পিছনে গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে’র ধাতব গাছ টাইপের স্থাপন দেখা যাচ্ছিলো। আমি সবাইকে তাড়া দিলাম, গার্ডেনস বাই দ্যা বে তে চলে এসেছি, এখানে সময় নষ্ট করার দরকার নাই। এমনিতেও সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
তারপরের দৃশ্যটা প্রায় দৌড়ের বলা যায়। আবার হোটেলে একপাশ দিয়ে হেলিক্স ব্রিজকে বামে রেখে সোজা গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে উদ্যানের ঢুকার মুখে। গেটের কাছে উত্তেজনায় আমার মেয়ে আরিয়া সিড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেলো। আমরা হেসেছিলাম, কিন্তু বেচারী ভালোই ব্যাথা পেয়েছিলো। কিন্তু কোন বাঁধাই যেন আমাদের আটকে রাখতে পারলো না। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে উদ্যানে প্রবেশ করার পর খেয়াল করলাম উদ্যানে ঢুকতে কোন টিকেট কাটা হয়নি। ভিতরে ঢুকে নায়লাকে বললাম টিকেট ছাড়াই ঢুকে গেলাম। বাহ। পরে জেনেছি পুরা কমপ্লেসটি পর্যটকদের জন্য ফ্রি। শুধু বেশ কিছু প্রদর্শনী কেন্ত্র বা স্থাপনায় ঢুকতে টিকেটের দরকার হয়।
আমরা যে দিক দিয়ে গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে তে ঢুকেছিলাম তার বামে ছিলো মেরিনা রিজার্ভার বা উপসাগরের অংশ। পিছনে মেরিনা বে স্যান্ডস হোটেল। ডানে মাথা উঁচিয়ে আছে বিশাল গাছ আকৃতির বড় বড় স্ট্রাকচার। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করেছে। মেরিনা রিজার্ভারের পাড় ধরে পাকা হাটার রাস্তা। প্রচুর মানুষ হাটছে বা জগিং করছে। একটু সামনে এগোতেই সোজাসুজি আমরা বিরাট বিরাট দুটি ডোম বা ছাওনির মতো বিল্ডিং দেখতে পেলাম। পরে জেনেছি একটা বিল্ডিংয়ের নাম ক্লাউড ফরেস্ট (Cloud Forest) আর আরেকটির নাম ফ্লাওয়ার ডোম (Flower Dome)।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে, অচেনা জায়গায় একটু অস্বস্তি লাগছিলো। কিন্তু সিঙ্গাপুরে কেমন জানি একটা নিরাপত্তা বোধ কাজ করে। আমাদের তখন আবিস্কারের নেশা। ইস্পাতের বিশাল গাছগুলোতে তখন রঙ বে রঙের বাতি জ্বলে উঠেছে। পিছনে মেরিনা বে স্যান্ডস্ হোটেলের চেহারা অচেনা। তিনটি বিল্ডিংকে বেঁধে রাখা জাহাজাকৃতি প্লাটফর্মটা যে বাঁকা সেটা ওখানে দাড়িয়েই প্রথম বুঝতে পারি। ততক্ষণে আমরা গাছপালা দিয়ে তৈরী টানেলের মতো রাস্তা দিয়ে সিলভার গার্ডেন নামের তিনটি ইস্পাতের গাছের নিচে পৌছে গেছি। কোন মানুষ নেই, শুধু আমরা চার জন। অদ্ভূত এক ভালো লাগায় আমরা বাকরুদ্ধ। দেখতে পেলাম আরও বড় বড় ইস্পাতের গাছের একটা গুচ্ছ আরেকটু দুরে দেখা যাচ্ছে। আর বাগানের ভিতরে পায়ে হাটা রাস্তা বিভিন্ন দিকে চলে গেছে। আমরা কিছুক্ষণ সেই সুপার ট্রি গুলোর নিচে বিরাট পাথরের বসার যায়গায় শুয়ে মাথার উপরের আকাশ দেখলাম। একপাশে দানব আকৃতির মেরিনা বে হোটেল আর ইস্পাতের আলোকিত গাছ। সাথে চারিদিকে প্রাকৃতিক গাছের দেয়াল। গাছের ফাকে দিয়ে পায়ে হাটা পথ চলে গেছে এদিক ওদিক। আমরা একটা পায়ে হাটা রাস্তা দিয়ে হাটা দিলাম হোটেল বিল্ডিংয়ের দিকে। একটু পরেই আরেকটি বিস্ময়। দেখলাম আমরা একটা লম্বা লেকের সামনে দাড়িয়ে আছি। স্টেইনলেস স্টিলের তৈরী বড় একটি ফড়িং বসানো আছে লেকের পারে আর সেখানে লেখা ড্রাগন ফ্লাই লেক (Dragonfly Lake)। লেকের ওপারেই বিশাল মেরিনা বে স্যান্ডস হোটেলের আলো ঝলমলে বিল্ডিং।
একদম চুপচাপ আলোছায়া ভরা লেকের পাশে কিছুক্ষণ বসে চারিদিকের প্রাকৃতিক আর মানুষ্যনির্মিতঢ অতিআশ্চর্য স্থাপনা ও দৃশ্য অনুভব করার চেষ্টা করলাম কিছুক্ষণ। যেহেতু আমাদের সেদিনের পুরো ঘুরাঘুরিটাই ছিলো এডভেঞ্চার টাইপ। কিছু ঠিক না করে খুঁজে খুঁজে দেখা আর আবিস্কার করার মতো তাই আমরা সবাই এতো আনন্দ পেয়েছিলাম যে বলার মতো না। ব্যক্তিগত ভাবে আমি প্রকৃতিভক্ত। সিঙ্গাপুরের মতো একটা কৃত্রিম নগরীকে ভালো লাগার কথা নয় হয়তো। কিন্তু পরিবারের সাথে বিদেশ বিভুইয়ে একা একা এমন নিরাপদ ঘুরাঘুরির অভিজ্ঞতা আর আধুনিকতার সাথে প্রকৃতির অসাধারণ মেলবন্ধন আমার হৃদয়কে এক অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে ফেলেছিলো সেদিন।
বেশ রাত হয়ে যাওয়ায় আমরা সেদিন মেরিনা বে হোটেলের নিচ থেকে ট্যাক্সি ধরে আমাদের হোটেলে ফিরে এসেছিলাম। ‘গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে’ উদ্যানকে কে ভালোলাগার শুরু সেই প্রথম দিনের অল্প দেখাতেই। আমরা ফিরতি পথেই ঠিক করলাম, পরের দিন যাবো জুরং বার্ড পার্কে এবং তারপরের দিন যাবো ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে। তারপর আবার আসবো গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে তে। একটু সময় নিয়ে আসবো। একই সাথে সেদিন ঐদিন মেরিনা বে স্যান্ডস্ হোটেলের ছাদেও ঘুরে আসবো। ৬০ তালার উপর থেকে পাখির চোখে সিঙ্গাপুরকে আবিস্কার করতে ভালো লাগার কথা।
প্রথম দিনের চমকে উঠা ভালোলাগা আমাদের আবার গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে তে আসতে বাধ্য করেছিলো সিঙ্গাপুরের বেশ কিছু আইকনিক যায়গা ভ্রমণ করার পর। দ্বিতীয়বার আমরা যখন গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে তে বেড়াতে গেলাম সেদিন বেশ পরিকল্পনা করেই গেলাম। আগের দিন যেমন ঘুরতে ঘুরতে হাটতে হাটতে চলে গেছি সেভাবে না গিয়ে ট্যাক্সি করে গার্ডেনস বাই দ্যা বের প্রধান ফটক পার হয়ে একদম উদ্যানের মাঝখানে নেমেছিলাম। দুপুর তিনটার দিকেই পৌছেছিলাম সেদিন। আমার উদ্দেশ্য গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে থেকে দিনের আলো থাকতেই মেরিনা বে স্যান্ডস হোটেলের ছাদে উঠতে হবে। তাতে ছাদের উপর থেকে দিনের আলো এবং সাথে সাথে রাতের সিঙ্গাপুর একবারে দেখা হয়ে যাবে।
আগেই বলেছি দ্বিতীয় দিনের গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে ভ্রমণ শুরু হলো গার্ডেনের একদম মাঝখান থেকে। ওখান থেকে মেরিনা বে স্যান্ডস হোটেলটা একটু দুরে লাগছিলো। ডানে তাকাতেই একটু দুরে বিশাল দুটি গ্রীন হাউস টাইপ বিল্ডিং দেখা যাচ্ছিলো মেরিনা রিজার্ভারের কাছে। চারিদিকে সুন্দর পারিপাটি ফুল আর গাছ দিয়ে সাজানো আধুনিক বাগান। পাথরের একটি ষাড়ের মুর্তি পাওয়া গেলো ঢুকার মুখেই। খুব কাছেই দেখলাম বাচ্চাদের জন্য একটা ওয়াটার পার্ক। ওয়াটার পার্কে ঢুকে ঘুরে দেখলাম কিছুক্ষণ। শতশত বাচ্চা মজার মজার ওয়াটার রাইডের মধ্যে গোছল করছে। আমার মেয়ে তখনই পারলে গোছল করতে নেমে যাই আর কি। ওকে বোঝানো হলো আজকে গোছলের জন্য এক্সট্রা জামাকাপড় নিয়ে আসি নাই। আরেক দিন আসা যাবে, শুধু এখানে গোছল করতেই আনবো তোকে। সমস্যা নাই।
ওর মধ্যে ততদিনে আমাদের উপরে একটা ভরসা তৈরী হয়ে গেছিলো যে, গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে আমাদের মোটামুটি হাতের নাগালের জায়গা। টিকেট পর্যন্ত লাগছেনা। এতো সুন্দর একটা ওয়াটার পার্ক সেটা পর্যন্ত ফ্রি। ফলে আব্বু এখানে আবার নিয়ে আসবে নিশ্চিত। ওয়াটার পার্কটার নাম ফার ইস্ট অর্গানাইজেশন চিলড্রেনস্ গার্ডেন (Far East Organization’s Children’s Garden)। ওখান থেকে ঘুরে আমরা গেলাম পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্রীন হাউস বিল্ডিং ফ্লাওয়ার ডোমে (Flower Dome)। গিনিস বুকে এখন এই গ্রীন হাউসের নাম উঠেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্রীন হাউস হিসেবে। এখানে পৃথিবীর ৫ মহাদেশের হাজার হাজার গাছের স্পেসিমেন আলাদা ৯টি বাগানে প্রদর্শীত হচ্ছে। আরেকটি বিল্ডিং বা ডোমের নাম ক্লাউট ফরেস্ট (Cloud Forest), ওখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইন হাউস ওয়াটার ফলস বা জলপ্রপাত আছে। প্রায় ৯০ ফুট উঁচু জলপ্রপাত একটি ভবণের ভিতর, ভাবাই যায় না।
এরপরের জায়গাটি হচ্ছে সুপারট্রি গ্রুভ (Supertree Grove)। আগের দিন আমরা তিনটি ইস্পাতের গাছের কাছে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে আরও বড় বড় গাছ দেখা যাচ্ছিলো, সেটাই সুপার ট্রি গ্রুভ। বিশাল সব ইস্পাতের গাছ গোল হয়ে দাড়িয়ে আছে। বৃত্তের মতো গাছগুলোর সাথে হাটার জন্য ঝুলন্ত পথ দেয়া আছে। নাম ওসিবিসি স্কাইওয়াক (OCBC Skywalk)। আকাশ বা শুন্যে হাটার ব্যাবস্থা। পুরো জায়গাটা মনে হচ্ছিলো কোন সায়েন্স ফিকশন সিনেমা দেখে বানিয়েছে। আর আমরাও সেই সিনেমার ভিতরে ঢুকে গেছি। আশেপাশেই অন্য গ্রহ থেকে আসা প্রাণীর দেখা মিলবে। একটা কথা বলা হয়নি, এতো যে হাটাহাটি ঘুরাঘুরি করছিলাম আমরা, পুরো এলাকায় খাবার জায়গা আর টয়লেট ফ্যাসিলিটির কোন অভাব ছিলো না। সুপারট্রি গ্রুভের স্কাই ওয়াকে উঠে পাখির চোখে গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে কে দেখে সেই সেই অপূর্ব বাগানটিকে যেন নতুন করে ভালোবেসেছিলাম। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ, বিশাল লেক, অসাধারন সব বাগান, কংক্রিট আর স্টিলের বড় বড় বিশাল স্থাপনা অথবা বিল্ডিং, আর ঘাড়ের উপরে পৃথিবীর অন্যতম বড় বিল্ডিং মেরিনা বে স্যান্ডস্ হোটেল। সব মিলিয়ে খুব ভালো লেগেছিলো। স্কাইওয়াক থেকে নেমে আমরা গেলাম উদ্যানের পিছনের দিকে। সেখানে গিয়ে শিশুর বিশাল একটা ভাস্কর্য পাওয়া গেলো। ভাস্কর্যটির নাম সম্ভত প্লানেট (The Planet) বা গ্রহ। অবাক করা ভাস্কর্য, যেন বাতাসে ভাসছে। পুরো ভাস্কর্যটির ওজন একটি জায়গায় কেন্ত্রভুতকরে কিভাবে যেন স্থাপন কর হয়েছে। দারুন একটা জায়গা। চারিদিকে সবুজ গালিচার মতো ঘাস ছিলো। আমরা ওখানে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিলাম। পাশেই দেখলাম কনসার্ট করার জন্য একটা জায়গা আছে গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে এর মধ্যে, নাম দ্যা মিডো (The Meado)। আমরা যখন রেস্ট নিচ্ছিলাম তখনও দ্যা মিডোতে গান বাজনা হচ্ছিলো। অসংখ্য মানুষ ঢুকছিলো ভিতরে।
কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে আমরা রওনা দিলাম গার্ডেন্স বাই দ্যা বে হোটেল বিল্ডিংয়ের দিকে। গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে থেকে সরাসরি একটা ওভার ব্রিজ ড্রাগন ফ্লাই লেক আর রাস্তা পেরিয়ে সোজা হোটেল বিল্ডিংয়ে যেয়ে নেমেছে। পর্যটকদের কত সহজে সব জায়গা ঘুরিয়ে দেখানো যায় সেটা সিঙ্গাপুরে না গেলে বুঝতে পারতাম কখনও বোধহয়। প্রতিটা জায়গায় বিভিন্ন দিকের দিক নির্দেশনা দেয়া আছে। বুঝতে কোন অসুুবিধাই হয়নি। এতো ঘুরাঘুরিতেও আমাদের উৎসাহ উদ্দিপনায় ঘাটতি হয়নি। মেরিনা বে স্যান্ডস হোটেলের এক কোনা থেকে হোটেলের উপরে যাওয়ার ব্যাবস্থা আছে।
পর্যটকদের জন্য বেশ কিছু প্যাকেজ আছে। যে স্থানটুকুতে পর্যটকরা উঠতে পারে তার নাম স্যান্ডস স্কাইপার্ক অবজারভেশন ডেক (Sands Skypark Ovservation Deck), এই অল্প জায়টাটি ছাড়া পর্যটকরা পুরো ছাদের খুব সামান্য জায়গাতেই যেতে পারে। জাহাজের মতো ছাদের তিন কোনা মাথায় দাড়িয়ে মটোমুটি পাখির চোখে পুরো সিঙ্গাপুর শহরকে দেখা যায় ওখান থেকে। আমরা টিকেট কেটে সন্ধ্যার আগেই ছাদে পৌছে যাই। প্রচুর পর্যটকদের মধ্যে ভারতীয় পর্যটকদের আধিক্য দেখতে পেয়েছিলাম সেদিন। পুরো ছাদের ১০ ভাগের একভাগ জায়গাতে অবজারভেশন ডেকটি। তবে ১০ ভাগের এক ভাগ জায়গাই কয়েকশো ফুটের বিশাল জায়গা। ওখানে কফিশপ ও খাওয়া দাওয়ার জায়গাও আছে। মেরিনা বে হোটেলের ছাদে বসে আমরা দিনের পরিচিত সিঙ্গাপর আর রাতের আলো ঝলমল রূপকথার পরীর দেশের মতো সিঙ্গাপুর দেখে নেমেছিলাম সেদিন। নিচ থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা হোটেলে।
এটা গেলো দ্বিতীয় দিনের গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে সফর। তৃতীয় দিন আমরা দুই সেট করে জামাকাপড় নিয়ে গার্ডেনস্ বাই দ্যা বের চিল্ড্রেনস গার্ডেনে ঢুকে পরি। যারা ভবিষ্যতে সিঙ্গাপুরে বেড়াতে যেতে চান, আর আপনাদের সাথে ১০ বছরের নিচে বাচ্চা থাকে, তবে আপনাদের পরামর্শ দিতে চাই যে, সিঙ্গাপুর ভ্রমণের মধ্যে গার্ডেনস্ বাই দ্যা বে তে গিয়ে অন্তত একবার চিল্ড্রেন্স গার্ডেনে ঢুকবেন। কোন প্যাকেজে না গিয়ে নিজেরাই ট্যাক্সি করে যেতে পারবেন।
আমরা তৃতীয় দিনে আগে থেকে করা পরিকল্পনা অনুয়ায়ী সরাসরি ফার ইস্ট অর্গানাজেশন’স চিল্ড্রেনস্ গার্ডেনে চলে যাই। পুরো জায়গাটি শিশুদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষনীয় করে বানানো। ফুলে বাগানের মধ্যে পায়ে হাটা রাস্তা, বিভিন্ন বয়সী শিশুদেও অনেক ধরনের খেলার সরঞ্জাম। দারুন একটি ওয়াটার পার্ক। সেই ওয়াটার পার্কে পানি যে কতো রকম করে বাচ্চাদের গায়ে গড়িয়ে পরছে তার ইয়াত্তা নেই। ওয়াটার পার্কের সাথে চেঞ্জিং রুম আছে ফলে অনায়াসে ভেজা কাপড় বদলে নেয়া যায়। সেদিন সাথে করে দুই সেট জামা কাপড় নিয়ে গিয়েছিলাম বলে অসুবিধা হলো না। ছেলে মেয়ে দুজন ওখানে ইচ্ছা মতো খেলাধুলা আর গোছল করে নেয় খুব মজা করে।
এরপরে আমরা আবার সেদিন সুপারট্রি গ্রুভ বা গার্ডেনস বাই দ্যা বের মাঝখানের সেই বড় সুপার ট্রি গুচ্ছের মাঝে চলে যাই। আমাদের ইচ্ছা গার্ডেনস বাই দ্যা বের বিখ্যাৎ লাইট এন্ড সাউন্ড শো দেখা। হাতে সময় থাকায় আবার উদ্যানের এদিক ওদিকে ঘুওে আগের দুইদিন দেখা হয়নি এমন কিছু জায়গা আবিস্কারও করে ফেলি। সিঙ্গাপুরের সেই এক সফরে এক জায়গায় তিনবার ঘুরে জায়গাটাকে এত আপন লাগছিলো যে কি বলবো। আগের দিন যে ওভার ব্রিজ দিয়ে মেরিনা বে স্যান্ডস হোটেলে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যায় ওখানে বসেই স্বপ্নের মতো একটা কিছু সময় পার করেছিলাম সেদিন। তারপর শুরু হয়েছিলো লাইট এন্ড সাউন্ডের আলো আর শব্দের খেলা। সুপার ট্রি গুলো যে কত রঙের আলোয় বারবার রাঙাচ্ছিলো অবাক হয়ে দেখেছিলাম অনেক্ষণ ধরে। তারপর মনে হলো অনেক হয়েছে। এবার হোটেলে ফিরি। আবার মেরিনা বে স্যান্ডস হোটেলে ট্যাক্সি ষ্ট্যান্ড থেকে ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলের দিকে রওনা হলাম। তবে মনে মনে ঠিক করলাম। আবার আসতে হবে ভাই বোন বা বন্ধুবান্ধবদের সাথে নিয়ে আমাদের অতিপ্রিয় এই স্বপ্নের উদ্যানে।
লেখক: আনিসুল কবীর