চারিদিকে সারি সারি পাহাড়, নীল আকাশের ফাঁকে ফাঁকে সাদা তুলোর মত মেঘ। অতিকায় সব পাহাড়ের ফাঁক গলে নিশ্চিন্তে বয়ে যাচ্ছে কাঁচের মতো স্বচ্ছ পানির হ্রদ। পাহাড়ি সবুজ আভায় সমতল থেকে দীগন্ত দেখবার উপায় নেই। এ যেন সবুজের রাজ্যে সাদা মেঘের হ্রদের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন আপনি। নিশ্চয়ই ভাবছেন স্বপ্নের মত সুন্দর এরকম দৃশ্য বাস্তবে আদৌ কি সম্ভব?
এসবে কাশ্মীরকে সম্রাট জাহাঙ্গীরের দেয়া “পৃথীবির স্বর্গ” উপাধিটার কথা মনে পড়বে। যার সৌন্দর্য মলিন হয়ে পড়ছে রাজনৈতিক দাঙ্গায়।তবে কাশ্মীরের সৌন্দর্য নিয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের তকমায় হয়তো ভাগ বসাতেই পারে চীনের নয়নাভিরাম মেঘপুরী জিওজাইগো ভ্যালি।সৌন্দর্যের পূজারী পর্যটকদের ঢল সারা বছর লেগেই থাকে চীনের সিচুয়ান প্রদেশের হিমালয়ের গহীনে লুকোনো এই বিষ্ময়কর প্রাকৃতিক রূপ দেখতে।
আশ্চর্যজনকভাবে এই ভ্যালির মাত্র ৫০ কিলোমিটার জায়গা জুড়েই আছে ১৭ টি ঝর্ণা, ১১৪ টি বিস্ময়কর স্বচ্ছ জলের হ্রদ এবং সুন্দর বনাঞ্চল। জিওজাইগো ভ্যালি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু মালভূমি অঞ্চলে থাকা বিস্ময়কর এক জলের রাজ্য। আর তাই চীনের জাতীয় পর্যটন স্থল হিসেবে জায়গাটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে চীন সরকার।
অতীতে এই উপত্যকা ছিল সমুদ্রের তলদেশে। ভূপ্রাকৃতিক পরিবর্তনে হিমালয় সৃষ্টির সময় তা এই ভ্যালির সমতল মাটি এমন পর্বতের আকার ধারণ করেছে। ভূতাত্ত্বিকদের আবিষ্কৃত এই পর্বতশৃঙ্গের ৮ হাজার ফুট উচ্চতায় প্রাপ্ত জীবাশ্ম তার প্রমাণ। তিব্বতের মিন পর্বতমালার এক বিশেষ অংশ এই জিওজাইগো ন্যাশনাল পার্ক, যার আয়তন মাত্র ৭২০ বর্গ কিলোমিটার। এখানকার হ্রদগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড়ে ১০ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত। তার চারপাশে ঘিরে আছে পাহাড়ি বনভূমি। মাত্র ৫০ কিলোমিটারের ব্যবধানে এই হ্রদের পানি ৬ হাজার কিলোমিটার নিচে নেমে গেছে, আর চলার পথে সৃষ্টি করেছে নয়নাভিরাম জলপ্রপাতের।
চীনা ইতিহাসবিদদের মতে, এই জলপ্রপাত ও বনাঞ্চল হলো উক্ত অঞ্চলের প্রাণ। ৪০ বছর আগে চীন সরকারের এই অঞ্চল সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। এই জায়গা অত্যন্ত দুর্গম, এমনকি এর নিকটবর্তী শহর থেকে জিওজাইগো ভ্যালিতে যেতে সময় লাগে ১০ ঘণ্টা। কিন্তু ১৯৬০ এ পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। ১৯৭৫ সালে চীনের কৃষি ও বন মন্ত্রণালয় এখানকার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অনুভব করেন যে, অঞ্চলটি বনজ সম্পদ ও বিভিন্ন বন্য প্রাণী সমৃদ্ধ অভ্যয়ারণ্য। ১৪০ প্রজাতির পাখী, বহু কাঠবিড়ালি, অতিকায় পান্ডা ও নাক বোঁচা বাঁদর এই নির্জন এলাকার প্রধান বাসিন্দা। এছাড়াও আছে অগণিত বিরল প্রজাতির মূল্যবান গাছ। কিন্তু বন উজাড় করে দেয়া দুষ্কৃতকারীদের দৌরাত্ম্যে চীন সরকার ১৯৮২ সালে এই উপত্যকাকে হ্যারিটেজ উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করেন।
বলা বাহুল্য, আন্তর্জাতিকভাবে জিওজাইগো ভ্যালি নামে এ স্থানটি পরিচিত হলেও চীনা উচ্চারণে এর প্রকৃত নাম, “চিওচাইকোউ ভ্যালি”। যার বাংলা অর্থ “৯ গ্রামের উপত্যকা”
স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই অঞ্চলের সৃষ্টির মূলে ছিল ৯ জন সুন্দরী, সাহসী ও বুদ্ধিমতী বোন। এই ৯ বোন একবার এই এলাকার সৌন্দর্য্য দেখতে এসে এক অতীকায় বিষাক্ত সাপের আক্রমণের শিকার হয়, কিন্তু সাহসীকতা ও বুদ্ধিদীপ্ততার ফলে তারা সে সাপকে মারতে সমর্থ হয় ও প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে স্থানীয় সম্ভ্রান্ত ৯ জন তিব্বতি যুবককে বিয়ে করে এই উপত্যকা জুড়ে ৯টি পৃথক গ্রামে বসবাস শুরু করে। আর সেই থেকেই এখানকার নাম হয়েছে চিওচাইকোউ অর্থাৎ জিওজাইগো। নামে নয় গ্রামের উপত্যকা হলেও বর্তমানে এখানকার ৭টি গ্রাম অক্ষত আছে। আর এই সব গ্রামে মাত্র ১১০ টি পরিবার বসবাস করে। এই বাসিন্দারা এতটাই বিচ্ছিন্ন যে তাদের ভাষা ভিন্ন, এমনকি নিজেদের মতো করে আলাদা এক নিয়মে বৌদ্ধ ধর্মের চর্চা করে থাকে।
১৯৮৪ সালে এই জায়গাকে ভ্রমণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর থেকে হাজার হাজার পর্যটক আসেন এখানে। ২০১০ সালের মধ্যেই প্রায় ১০ লক্ষেরও বেশি পর্যটক জিওজাইগো ঘুরে গেছে। আর বর্তমানে প্রতিদিন ৫ হাজার পর্যটক ভ্রমণের অনুমতি পান। স্থানটি এখনও অত্যন্ত দূর্গম অঞ্চল হলেও বর্তমানে জনপ্রিয় পর্যটন স্পট হবার দরুন চীন সরকার রাস্তা ও যাতায়াতের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়ে তা বাস্তবায়নও করেছে।
ভূতাত্ত্বিকদের মতে প্রায় ৫ লক্ষ বছর আগে বিশাল এক পাহাড় ধসে জিওজাইগোর একটি মুখ বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে বৃষ্টির পানি জমে তৈরি হয় এক বিশাল হ্রদ – লম্বায় প্রায় ৭ কিলোমিটার এবং প্রস্থে মাত্র ৫০০ গজ।
সমুদ্র থেকে প্রায় দেড় লক্ষ কিলোমিটার দূরে বসবাস করায় এখানকার বাসিন্দাদের কাছে এই হ্রদই সমুদ্র।
এখানকার অধিকাংশ হ্রদ তৈরি হয়েছে ভূমিকম্পের ফলে। হ্রদের পানি নানান রঙে সজ্জিত। আশ্চর্যজনকভাবে স্বচ্ছও বটে। মূলত হ্রদে প্রচুর শৈবাল ও নানান রঙের বিরল সব জলজ উদ্ভিদের কারণেই এর রঙ এত বর্ণিল।
পর্যটকদের জন্য এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পার্থিব জগতের স্বর্গ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হলেও, এই পর্যটকদেরই অসতর্কতার ফলে বিভিন্ন স্থানে প্লাস্টিক পণ্য ও আবর্জনা ফেলে হুমকির মুখে ফেলছে। তবে বর্তমানে চীন সরকার আইন প্রচলনের মাধ্যমে সমস্যাটি নিরসন করতে পেরেছে এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে উত্তরোত্তর উন্নয়নের কাজ করে যাচ্ছে।