তৃতীয় বিশ্বের ছোট্ট একটি দেশে আমার জন্ম। নিজের দেশটি ছাড়া চোখ মেলে এই দুনিয়াটা যদি না দেখি তাহলে কিছুই হয়ত জানা হবে না, অনেক কিছুই শেখা হবে না। যতদিন বেঁচে আছি কম-বেশি স্বাধ্য মত ঘুরে বেড়াবোই। এটাই আমার নেশা।
এবার আমার ভ্রমণ ছিল কানাডা। বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ দূরত্বের দেশের মধ্যে একটি কানাডা। প্লেন জার্নি এতটা বোরিং তা এই দেশে যেতে হাড়েহাড়ে টের পেয়েছি। ট্রানজিট সহ ২২ ঘন্টার জার্নি। বিশাল দেশ অথচ জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে তিন কোটি। শধুমাত্র অন্টারিও নামে একটি প্রদেশ ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে এবার। দেশটিতে যাওয়ার পরেই বুঝেছি যে দেশটি আমাদের থেকে সবকিছুতে উল্টা। জীবন যাপন, চলাফেরা সব কিছু।
ভৌগলিক দিকে আমাদের দেশ থেকে বিপরীত দিকে অবস্থিত কানাডা। ওদের যখন দিন, আমাদের তখন রাত। গাড়ী চলে রাস্তার ডান পাশে। বাসা বাড়ীর ইলেক্ট্রিসিটির সকল সুইচ উপরের দিকে অন এবং নীচের দিকে অফ, সেন্ট্রাল এসির পয়েন্টগুলো আমাদের সিলিংয়ে থাকলেও সেখানে ফ্লোরে। মাছ মাংসের দামের চেয়ে শাক-সবজির মূল্য অনেক বেশী। এছাড়া নামাজ পড়া হয় পূর্ব দিকে যেহেতু কেবলা সেদিকে।
অনেক সভ্য একটি দেশ কানাডা। পথে ঘাটে চলতে ফিরতে আপনাকে কেউ চিনুক আর নাই চিনুক, আপনি সাদা চামড়ার হয়ে থাকেন আর আমার মত এশিয়ান, তারা চোখে চোখ রেখে একটি হাসি দিয়ে- হায়, হাউ আর ইউ? বলবেই।
শপিং মলে ঢুকতেছেন, যদি দেখেন সামনে আর একজন আপনার আগে ঢুকছেন তাহলে তিনি অবশ্যই আপনার জন্য দরজাটি হাত দিয়ে ধরে রাখবেন যতক্ষণ না আপনি দরজার কাছে না আসেন। তবে তাই বলে আপনি তাকে আমাদের দেশের মত সিকিউরিটি গার্ড ভাববেন না। আজ তিনি আপনার জন্য দরজা খুলে ধরে রেখেছেন তো কাল আপনি কারো জন্য ধরে রাখবেন আর এটাই সভ্যতা।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো বেশীরভাগ একই রকম। তবে আমার কাছে কানাডা খুবই ফাঁকা ফাঁকা লেগেছে। জায়গার অভাব নাই, তাই রাস্তাঘাট পৃথিবীর যেকোন দেশ থেকে অনেক প্রশস্ত। আমিতো কানাডার রাস্তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। কি অপরূপ সৌন্দর্য আর ডিসিপ্লিন সম্পন্ন চলাফেরা। এমনো রাস্তা পেয়েছি যেখানে ১০টি লেন যাওয়া আর ১০টি লেন আসা। তবে তার মধ্যে দুইটি লেন শুধুমাত্র পুলিশ, এ্যাম্বুলেন্স আর ফায়ার সার্ভিসের জন্য যেটিতে অন্য কোন গাড়ী চলে না। কানাডাতে আমি অস্ট্রেলিয়ার মত রাস্তায় স্পিড ডিটেক্টর ক্যামেরা খুব কম দেখেছি। এখানে মানুষ আইন খুবই মেনে চলে। একটি ট্রাফিক সাইন যথেষ্ট পথ চলার জন্য। তারপরেও দুই একটা ফাজিল থাকবেই যারা নিয়ম কম মানেন।
দেশটিতে সরকার মানুষের মৌলিক চাহিদার পূর্ণ করে রেখেছেন। আপনি যে স্থানেই বসবাস করুন না কেন আপনার হাটা পথের মধ্যে বাচ্চাদের জন্য পার্ক বা কোন বিনোদন স্থান থাকবেই। হোক সেটি ছোট অথবা বড়। আপনি এখানে না খেয়ে মরবেন না আবার খুব আকাশ পরিমান ধনী হতে পারবেন না। আপনি যাই আয় করুন না কেন সরকারকে ৪০% ট্যাক্স দিয়ে দিতে হবে। এজন্য দেশটিতে গরীব ধনীর ব্যবধান কম। ১৮ বছর পর থেকে সকলে আয় করছে এবং প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত একটি গাড়ী আছে। চুরি ডাকাতির পরিমান খুবই নগণ্য। দিনরাত বাসাগুলোর সামনে নামীদামী ব্রান্ডের গাড়ী পার্কিং করে রাখে কিন্তু কেউই ধরেন না। আপনি যেকোন বিপদে পড়েন না কেন শুধু ৯১১ কল করে জানান, দেখবেন ৫ মিনিটের মধ্যে আপনার সাহায্যে পুলিশ অথবা সাহায্যকারী চলে এসেছেন। এখানের পুলিশ হচ্ছে জনগণের বন্ধু। পুলিশ সবসময় নাগরীকের সঙ্গে বিনয়ি ভাষায় স্যার স্যার বলে কথা বলেন।
আমি যেহেতু সামারে গিয়েছি তাই তখন এক রকম পরিবেশ আবার উইন্টারে অন্যরকম। সামারে সবুজে ভরপুর একটি দেশ। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। কানাডার আকাশটি খুবই উজ্জ্বল। মেঘের পরিমান কম থাকার কারণে আকাশটি খুবই সুন্দর দেখতে। এখানে প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনায়, রাস্তাঘাটে একাধিক কালারের ম্যাপল ট্রি আছে। এই ম্যাপল লিফ কানাডার প্রতিক। কানাডাতে আবাসিক এলাকাগুলোতে বাড়িগুলো সব একই রকম। কারণ আপনি ইচ্ছা করলেই সেখানে নিজের মত বাড়ি বড় করতে পারবেন না। বাড়ি তৈরী, কেনা, বিক্রি সবকিছুই আপনাকে এজেন্টের মাধ্যমে করতে হবে। তাই সবকিছুই একই নিয়মের মধ্যে চলে। আপনার আঙিনায় যদি বড় কোন পুরাতন গাছ থাকে এবং আপনি যদি তা কাটতে চান তাহলে অবশ্যই আপনাকে সরকারের কাছে ডলার জমা দিয়ে অনুমতি আনতে হবে। নতুবা আপনার নামে কেস হয়ে যাবে। কারণ আপনার রাইট নেই প্রকৃতির ভারসম্য নষ্ট করার। এছাড়া প্রাকৃতিক কোন কিছুই আপনি ইচ্ছা করলেই মারতে পারবেন না। ধরুণ আপনার আঙিনায় কোন সাপ দেখছেন কিন্তু ইচ্ছা করলেই সেটি আপনি মারতে পারবেন না। আপনাকে ৯১১ কল করে বলতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে তারা এসে সাপটিকে ধরে তার স্থানে নিয়ে যাবে।
সাজানো গোছানো দেশটির যেদিকেই ক্যামেরা দিয়ে ক্লিক করুন না কেন প্রতিটি যেন এক একটি ক্যালেন্ডারের স্ন্যাপ হয়ে যাবে। এখানে সকলে নিজের কাজ নিজে করেন। হোক ধনী অথবা গরীব। বাসায় ২/৩টা বিএমডব্লিউ (BMW), (Porsche) ব্রান্ডের গাড়ী পড়ে আছে। রবিবার সকালে দেখবেন ঘাস কাঁটা মেশিন দিয়ে চারিপাশে ঘাস কাটা হচ্ছে। মানুষ কোন প্রকার ময়লা রাস্তায় ফেলেন না। পার্কে ছুটির দিনগুলোতে পিকনিক সহ বারবিকিউ পার্টি হয়, অথচ দিন শেষে সব কিছু ঝকঝকে। আমরা বাঙালীরাও সেখানে সভ্য।
এই দেশে কাজের কোন ছোট বড় নেই। সকলেই সব ধরণের কাজ করেন। কারও কাজকে এখানে ছোট চোখে দেখা হয় না। আর এই মন-মানসিকতার জন্ম স্কুল থেকে। যেখানে আমাদের দেশের একটি বাচ্চাকে শেখানো হয় বড় হলে তুমি ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হবে, আর এটাই থাকে সকল শিশুর ড্রিম জব। অথচ কানাডাতে বাচ্চাদের ড্রিম জব ফায়ারম্যান অথবা গার্বেজ ট্রাক ড্রাইভার। এটাই তাদের ড্রিম জব। এই শিশু বড় হলে সেই জব করুক আর নাই করুক সেই জবের প্রতি তাদের শ্রোদ্ধাবোধ থেকেই যায়। তারা মনে করে এই জবের মাধ্যেমে বেশী বেশী মানুষের উপকার করা যায় এবং সমাজকে পরিস্কার রাখা যায়। বাংলাদেশের অনেকের কাছে কানাডা একটি বুলসিট দেশ। কারণ তারা ঘুম থেকে উঠে বুয়ার হাতের নাস্তা পায় না, কাজে যেতে ড্রাইভার গাড়ীর দরজা খুলে রাখেন না, কর্ম ক্ষেত্রেও গদি চেয়ারে বসে বসগিরি করতে পারে না। তারপরে আবার এত নিয়ম মেনে চলা অসহ্য। সবমিলে তাদের কাছে বুলসিট।
আর যদি আপনি একজন সুস্থ এবং ডিসিপ্লিন ভাবে জীবন যাপন করার মন-মানসিকতার হয়ে থাকেন তাহলে এটা হবে আপনার কাছে দুনিয়ার স্বর্গের রাজ্য। তবে এতটা শান্তি হবে না যদি আয় না করতে পারেন। বাংলাদেশের মত এত সহজ বা টাকার পাহাড় করা সেই দেশে সম্ভব নয়। আপনাকে প্রথম ৫ বছর খুব কষ্ট করতে হবে যদি সেখানে স্থায়ী বসবাস করতে চান। দেশে আপনার যত বড় ডিগ্রি থাকুক না কেন, হোক আপনি বুয়েট অথবা মেডিকেল থেকে পাশ করা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার অথবা ছিলেন কোন কোম্পানির বড় কর্মকর্তা, সেখানে আপনি জিরো। কাজকে তুচ্ছ করবেন তো আপনাকে দেশে ফিরে আসতে হবে। ভাগ্যে না থাকলে খুব সহজে স্ট্যান্ডার্ড জব আপনি পাবেন না। আর যদি মনে করেন সারাদিন (Walmart) এর মত সুপার শপে অথবা কোন বার্গার সপে সেলসে কাজ করতে পারবেন তাহলে আপনি সুখেই থাকবেন। বিদেশ যেমন সহজ, ঠিক তেমনি কঠিন। নিজেকে শুধু মানিয়ে নিতে হবে। আর একবার মানিয়ে নিলে এই সোনার দেশে আপনাকে আর ফিরে আসতে মন চায়বে না।
সবমিলিয়ে কানাডাকে অনেক সুন্দরভাবে উপভোগ করেছি। নায়গ্রার মত জলপ্রপাত থেকে শুরু করে অনেক অনেক সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। এজন্য মহান আল্লাহর নিকট চিরকৃতজ্ঞ। ইনশাআল্লাহ্ সামনে হয়ত নতুন কোন দেশ, নতুন কোন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটবে।
মিয়া মিজানুর রহমান কাজল