শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১৮ অপরাহ্ন

পানামা খাল: বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল জলপথ

  • আপডেট সময় রবিবার, ২ এপ্রিল, ২০২৩

সময়টা ১৯০৩, নির্মাণাধীন পানামা খালে বৃষ্টিস্নাত একদিন। যে দেশে বছরে ৮০ শতাংশ সময় বৃষ্টি হয়, সেখানে এমন ভেজা পাথুরে পাহাড়ে কাজ করতে গিয়ে একজন শ্রমিক হঠাৎ পা পিছলে মৃত্যুদুয়ারে হাজির হবে, তা কি হর্তাকর্তাদের অজানা? ঠিক তখন থেকে শুরু করে ১৯১৪ পর্যন্ত দুর্ঘটনা, ম্যালেরিয়া, পীত্ জ্বরে মারা যায় আরো ৫,৬০০ জন। সরকারি খাতায় থাকা এই ৫,৬০০ জনের অংকটা বাস্তবে হয়তো আরো বড় (ধারণা অনুসারে ২২,০০০ জন)। ৮০ কিলোমিটার লম্বা প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে সংযোগকারী এই কৃত্রিম জলপথটি বাস্তবেই যেন এক বিস্ময়! কিন্তু উনিশ শতকের এই স্থাপনা কী করে একুশ শতকের পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে? তার একটা ছোট্ট বিবরণ চলুন জেনে নিই।

নির্মাণ শ্রমিকদের কয়েকজন । Image source: rarehistoricalphotos.com
নির্মাণশ্রমিকদের কয়েকজন; Image source: rarehistoricalphotos.com

১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল প্রকল্পে ফরাসিদের সাফল্যের পর আমেরিকা উত্তর আমেরিকার সাথে ইউরোপ, এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার দূরত্ব কমাতে বিকল্প একটি জলপথ তৈরির চিন্তা করতে থাকে। পানামা খাল তৈরির আগে ইউরোপ থেকে উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে অথবা এশিয়া থেকে উত্তর আমেরিকার দক্ষিণে পৌঁছাতে পুরো দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল সংলগ্ন এলাকা পাড়ি দিতে হতো। যাতে গন্তব্যে পৌঁছাতে লেগে যেত অতিরিক্ত ১৪ দিন এবং পাড়ি দিতে হতো আরও প্রায় সাড়ে বারো হাজার কিলোমিটার জলপথ।

১৯০৩ সালে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট প্রায় ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে ফরাসিদের থেকে নির্মাণাধীন খাল খনন প্রকল্পটি কিনে নেন। এরই মাধ্যমে শুরু হয় এক যুগেরও বেশি সময়ব্যাপী পানামা খালের খনন কাজ। কিন্তু ১৯০৩ সালে পানামা ছিল কলাম্বিয়ার একটি অংশ। পানামা খাল প্রকল্পের শুরুতে আমেরিকা কলাম্বিয়ার সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করতে চান, যার মাধ্যমে পানামা খাল ও সংলগ্ন এলাকায় আমেরিকার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু সেসময় পানামাও কলাম্বিয়া থেকে স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টায় ছিল। তখনই আমেরিকার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পানামা রক্তপাতহীনভাবে কলাম্বিয়ার থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং বিনিময়ে আমেরিকানদের পানামা খালে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সাল চুক্তি স্বাক্ষরের  মাধ্যমে ১৯৯৯ সালে আমেরিকা খালটির দায়িত্ব পানামাকে ফিরিয়ে দেয়।

পানামা খাল না থাকলে এতটা পথ ঘুরে যেতে হতো; Image source: AJOT.com

আঠারো শতকে লোহিত সাগরের সৈয়দ বন্দর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগকারী সুয়েজ খাল তৈরি করেছিল যে ফরাসিরা, তারাই কিন্তু পানামা খাল তৈরির প্রকল্প আমেরিকানদের আগে শুরু করে। কিন্তু পানামার বন্ধুর ভূমি ও সমতল মিশর ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যে একে অপরের থেকে পুরোপুরি আলাদা। এ কারণেই সুয়েজ খালের আদলে পানামা খালকরাটাই ছিল ফরাসি প্রকৌশলীদের একটি বড় ভুল।

এবার কথা বলা হবে পানামা খাল নির্মাণের প্রধান অন্তরায়গুলো নিয়ে। লেখাটির শুরুতেই বলা হয়েছে নির্মাণশ্রমিকদের মৃত্যুঝুঁকির কথা। এছাড়াও পানামার বৃষ্টিস্নাত ও আর্দ্র জলবায়ু, ভূমিধ্বস ব্যয়বহুল নির্মাণশৈলী শুরু থেকেই ফরাসি প্রকৌশলীদের নিরুৎসাহিত করছিল।

১৯১৩ সালে মাটি ধ্বসের পর শ্রমিকরা কাজে নেমেছেন।

১৯১৩ সালে মাটি ধসের পর শ্রমিকরা কাজে নেমেছেন; Image source: realhistoricalphotos.com  

পানামা খালটির ভৌগলিক নকশা অনুযায়ী পার্বত্য অঞ্চলে এর অবস্থান হওয়ার কথা। ফলে পাহাড় কেটে যদি খালটি তৈরি করা হত তবে খালের পানির উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতার সমান হওয়া জরুরি ছিল। কারণ উঁচু জায়গা থেকে পানি সবসময়ই নিচু জায়গার দিকে প্রবাহিত হয়। তাই খালের অবস্থান উঁচুতে হলে তাতে পানিও থাকবে না আর জাহাজও চলতে পারবে না। সে কারণেই ফরাসিরা পাহাড়গুলো একবারে কেটে সমতল ভূমি তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এ ধরনের নকশায় পারিপার্শ্বিক ভূপ্রকৃতি ও বৃষ্টি প্রধান এলাকা হওয়ায় খালটি সমুদ্রের সাথে এক সমতলে যদি তৈরি হতো তবে পাহাড় থেকে আশেপাশের মাটি ধ্বসে খালটি ভরাট হয়ে যেত। সেক্ষেত্রে পুনরায় খালটি আবার খনন করতে হতো। নির্মাণকাজ শুরুর অল্প কয়েক বছর পরে নকশার এত বড় ত্রুটি দেখেই তারা মূলত প্রকল্পটি আমেরিকানদের কাছে বিক্রি করে দেয়।

১৯১৩ সালে নির্মাণাধীন লকগুলো; Image source: realhistoricalphotos.com

আটলান্টিক থেকে কোনো জাহাজ পানামা খালের দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করতে চাইলে প্রথমে তাকে তিনটি লক পাড়ি দিতে হবে। এই লকগুলোর দুপাশে দুটি দরজা থাকে এবং মেঝেতে পাশের উঁচু লক থেকে নিচু লকটির দিকে নিয়ন্ত্রিতভাবে পানি প্রবাহিত করার ব্যবস্থা থাকে। একটি জাহাজ প্রথম লকের সমুদ্রের দিকে এসে পৌঁছালে দ্বিতীয় লক থেকে পানি প্রথম লকে ভরা হয়, যাতে প্রথম লকের পানি এবং সমুদ্রের পানির উচ্চতা সমান হয়। তখন সমুদ্রের দিকের দরজাটি খুলে দিলে জাহাজ প্রথম লকে ঢুকে যায় এবার দ্বিতীয় লকটি থেকে আরো পানি প্রথম লকে ঢোকানো হয়, যাতে প্রথম ও দ্বিতীয় লকের পানি সমান উচ্চতায় থাকে এবং জাহাজ দ্বিতীয় লকের উচ্চতা পর্যন্ত ভেসে ওঠে। তখন দ্বিতীয় লকের দরজাটি খুলে দিলে জাহাজ এতে ঢুকে যায়। এভাবেই জাহাজটি পৌঁছে যায় ২৬ মিটার উচ্চতার গাতুন হ্রদে। তৈরির সময় প্রতিটি লকের দুটো দরজার মধ্যে দূরত্ব ছিল প্রায় ৩২০ মিটার এবং প্রস্থে লকগুলো প্রায় ৩৩.৫৩ মিটার। লকগুলো প্রায় ২৬.৭ মিলিয়ন গ্যালন পানি ধারণ করতে পারে এবং পানিপূর্ণ করতে সময় লাগে প্রায় ৮ থেকে ১০ মিনিট।

জাহাজগুলো পানিতে ভাসিয়ে ওপরে তোলা হয়; Image source: Gfycat

আগেই বলা হয়েছে, গাতুন হ্রদের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৬ মিটার। শাগ্রে নদী (Chagres river) হলো পানামা খালের পানির অন্যতম উৎস। এই নদীতে দুটো বাঁধ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে হ্রদটি। জাহাজগুলোকে এখানে প্রায় ৩৩ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে হয় প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে পেদ্রো মিগেল লকে পৌঁছাতে। এই হ্রদটি তৈরির সময় ৭.২ বিলিয়ন কিউবিক ফুট পাথর ও মাটি খুঁড়ে তোলা হয়, যা ছিল সুয়েজের প্রায় তিনগুণ। এগুলো পরে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় ফেলা হয়, যেখানে বর্তমানে গড়ে উঠেছে সেনা ক্যাম্প।

এই বাঁধগুলো গাতুন হ্রদের পানিকে আটকে রাখে; Image source: realhistoricalphotos.com

আটলান্টিক থেকে পানামা খাল দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করতে একটি জাহাজের সময় লাগে প্রায় ৮-১০ ঘণ্টা। এত দীর্ঘ ও যান্ত্রিক একটি জলপথ পাড়ি দিতে জাহাজগুলোকে কিন্তু উচ্চহারে শুল্ক দিতে হয়। বলা হয়ে থাকে, পানামা খালের এই শুল্কহার পৃথিবীর অন্যান্য সব জলপথের শুল্কের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। এ কারণেই একে বলা হয় সবচেয়ে ব্যয়বহুল জলপথ। প্রায় ৮০ মিটার দীর্ঘ এই জলপথ দিয়ে বছরে প্রায় ১৪ হাজারেরও বেশি জাহাজ চলাচল করে।

১৯১৪ সালে S.S.Anchon জাহাজের যাত্রার মধ্যে দিয়ে কার্যক্রম শুরু করে পানামা খাল; Image source: realhistoricalphotos.com

কিন্তু উনিশ শতকের এই খালটিকে একুশ শতকেও ব্যবহার উপযোগী ও প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে বেশ কিছু পরিবর্তন করতে হয়েছে। পানামা খালের এই লক সিস্টেম থাকার কারণে লকগুলোর মাপের চেয়ে জাহাজ বড় হলে তা পানামা খাল দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। অপরদিকে, পানামার উচ্চ শুল্ক পরিশোধ সত্ত্বেও জাহাজগুলোর ধারণ ক্ষমতা তেমন বেশি না হলে জাহাজ মালিকদের লোকসান হবে। এ কারণেই ২০১৬ সালে এই লকগুলো পরিবর্তন করে এগুলো আরও বড় করা হয়।

আগে যেখানে চলাচলকারী জাহাজগুলোর ওজন ছিল সর্বোচ্চ ৫,০০০, বর্তমানে সর্বোচ্চ ওজন সেখানে করা হয়েছে ১৫,০০০ TEU। আর পানামা খালের এই আকৃতি বর্ধনের ফলে বর্তমানে জাহাজগুলোও বড় আকারে তৈরি করা হচ্ছে, যেগুলোকে বলা হয় নিও পানামাক্স (Neo Panamax) জাহাজ।

নিও পানামাক্স (Neo Panamax) জাহাজ; Image source: FreightWaves.com

তবে পানামা খাল বর্ধিতকরণের রয়েছে খালের ধারণক্ষমতা বেশি হওয়ায় বড় মাপের জাহাজ এখান দিয়ে চলাচল করবে। এ কারণেই বড় জাহাজগুলো যে দেশের বন্দরে গিয়ে ভিড়বে তাদের বন্দরের ধারণক্ষমতাও হতে হবে জাহাজগুলোর উপযোগী। এজন্য জলপথটি ব্যবহারকারী দেশগুলোকে তৈরি করতে হয়েছে গভীর সমুদ্রবন্দর এবং নদীপথগুলোকেও করতে হয়েছে আরো গভীর।

২০০৭-১৫ পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে সংস্কার করা হয়েছে খালটির; Image source: The Seattle Times

এতকিছু সত্ত্বেও শতাব্দী প্রাচীন এই খালটির উচ্চ শুল্কহার এবং জাহাজের আকৃতির ও ওজনের বিধি-নিষেধ নিকারাগুয়াকে রাজনৈতিকভাবে উৎসাহিত করে তুলছে বিকল্প একটি জলপথ তৈরির কাজে। বেশ কয়েক বছর আগে চীনের কিছু বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকেও বিষয়টি নিয়ে ঘাটতে দেখা গেছে। কিন্তু বিকল্প জলপথের জন্য চাই প্রচুর অর্থ, কূটনৈতিক তৎপরতা এবং প্রকৌশলীদের সঠিক নির্মাণশৈলী। তবে যতদিন এসব কিছুর একসাথে সমন্বয় না হচ্ছে ততদিন এ পানামা খাল হয়ে থাকবে এশিয়া-ইউরোপের সাথে উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার সেতুবন্ধন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com