বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:২৬ অপরাহ্ন

‘এপ্রিল ফুল’ এর সাথে কি মুসলমানদের ট্র্যাজেডি জড়িয়ে আছে

  • আপডেট সময় শনিবার, ১ এপ্রিল, ২০২৩

এপ্রিল মাসের প্রথম দিনটি পশ্চিমা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে বেশ ঘটা করে পালন করা হয়। এদিনে একে অপরকে চমকে দিয়ে ‘বোকা বানাতে’ চায়। যদিও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে এই প্রচলন খুব একটা দেখা যায় না।

পহেলা এপ্রিল পশ্চিমা দেশগুলোতে অনেকে কিছুটা বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করে। অন্যথায় কারো না কারো কাছে তাকে বোকা হিসেবে পরিচিত হতে হবে এবং এটি নিয়ে হাস্যরস তৈরি হতে পারে।

এ দিনটিকে তাই বলা হয় অল ফুলস ডে, বাংলায় বোকা বানানোর দিনও বলতে পারেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ফলাও করে ভুয়া ও ভুল সংবাদ ছাপায়। পরদিন অবশ্য সেটার সংশোধনী দিয়ে জানিয়ে দেয় খবরটা আসলে এপ্রিল ফুল ছিল।

একই সাথে এদিন পরিবারের ছোটরা সাধারণত বড়দের সাথে নানাভাবে মজা করে বোকা বানানোর চেষ্টা করে। আবার বন্ধু বা কলিগরাও একে অন্যের সাথে মজা করে। তবে যাকে বোকা বানানো হয়, তাকে শেষে সবাই মিলে চিৎকার করে জানিয়ে দেয় ‘এপ্রিল ফুল’।

মুসলমানদের জন্য ট্র্যাজেডির?

বাংলাদেশে একটা প্রচলিত ধারণা এপ্রিল ফুলের সঙ্গে আসলে মুসলমানদের বোকা বানানোর ইতিহাস জড়িয়ে আছে।

অনেকেই মনে করেন ১৫শতকের শেষ দিকে স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটান রাজা ফার্দিনান্দ ও রানি ইসাবেলা। তারা স্পেনের মুসলিম অধ্যুষিত গ্রানাডায় হামলা করেন এবং পরাজিত অসংখ্য মুসলিম নারী, পুরুষ ও শিশুকে মসজিদে আটকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারেন। আর সেদিনটি ছিল পহেলা এপ্রিল।

কিন্তু এর কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান।

“এটি আমরাও শুনেছি এবং এটি একরকম আমাদের বিশ্বাসের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমি ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে যখন স্পেনের ইতিহাস পড়েছি, দেখেছি যে সেসময় গ্রানাডার শাসক ছিলেন দ্বাদশ মোহাম্মদ। তার কাছ থেকেই ফার্দিনান্ড ও ইসাবেলা গ্রানাডা দখল করে নেন। আর এ ঘটনাটি ঘটেছিল জানুয়ারি মাসের ২ তারিখে। কোন কোন সূত্র বলে জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ। এবং এটি দুই পক্ষের মধ্যে আনুষ্ঠনিক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে হয়েছিল।”

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলছেন, সেসময় ফার্দিনান্ড ও ইসাবেলা মুসলমানদের উপর নির্যাতন করেছে, ইহুদিদের উপরও করেছে, কিন্তু এপ্রিল ফুলের যে ট্র্যাজেডির কথা বলা হয় সেটার সাথে তার কোন সত্যতা পাওয়া যায় না।

“ইতিহাসে আমরা যে বইগুলো পড়েছি সেখানে কোথাও ঐ বর্ণনা পাইনি। আমাদের কাছে মনে হয় এই ঘটনা নিয়ে একটা মিথ তৈরী করা হয়েছে, যার সাথে কোন ঐতিহাসিক সংযোগ নেই।”

মি. ছিদ্দিক বলেন অন্যদিকে গূরুত্ব দিয়ে অবশ্য মুসলমানরা এটি উদযাপন নাও করতে পারে। কারণ ইসলাম ধর্ম মিথ্যা বলা, প্রতারিত করা বা কাউকে বোকা বানানো সমর্থন করে না।

এপ্রিল ফুলের উৎপত্তি সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু জানা যায় না

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,
এপ্রিল ফুলের উৎপত্তি সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু জানা যায় না

ক্যালেন্ডার বদল থেকেই এর উৎপত্তি!

কিন্তু এই এপ্রিল ফুলের উৎপত্তি কীভাবে? কেনইবা এর নাম এপ্রিল ফুল হল?

মজার ব্যাপার হল এই দিনটির ইতিহাসের ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কিছু জানা যায় না। অনেকগুলো মত এ ব্যাপারে প্রচলিত আছে।

অনেকে বিশ্বাস করেন, মুসলমানের জন্য এ দিনটি আসলে ট্র্যাজেডির। আসলেই কি তাই?

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, ব্রিটানিকা, হিস্ট্রিসহ বেশ কিছু ওয়েবসাইট বলছে এপ্রিল ফুলের উৎপত্তি হয় ফ্রান্সে। আর সেটা ১৫০০ শতকে, যখন ক্যালেন্ডার বদল ঘটে।

তার আগে পর্যন্ত জুলিয়াস সিজার প্রবর্তিত জুলিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার হয়ে আসছিল। যে ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ঋতুর সঙ্গে মিল রেখে নতুন বছর শুরু হতো মার্চের শেষে বা এপ্রিলের শুরুর দিকে।

কিন্তু ফ্রান্স প্রথম গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করে। যে ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পহেলা জানুয়ারি ধরা হয় বছরের প্রথম দিন।

কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই সেই খবর সব জায়গায় পৌঁছাতে আরো বেশ কিছুদিন লেগে যায়। অনেকে আবার সিদ্ধান্ত নেয় তারা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ীই চলবেন। ফলে পহেলা জানুয়ারির পরিবর্তে অনেকেই আগের মতো মার্চের শেষে বা এপ্রিলের শুরুতে নতুন বছর উদযাপন করতে থাকে।

আর সেই বিষয়টি বেশ হাস্যরস ও আনন্দের খোরাক হয়ে দাঁড়ায়। ফলে যারা এরই মধ্যে পহেলা জানুয়ারি নতুন বছর উদযাপন করছে তারা তখন তাদের ‘এপ্রিল ফুলস’ বলে ডাকতে থাকে।

ফ্রান্সে বা অন্যান্য দেশে ফ্রেঞ্চভাষী মানুষদের মাঝে এই দিনটি অবশ্য ‘এপ্রিল ফিশ’ হিসেবেই বেশি পরিচিত।

এদিন যাকে বোকা বানানো হয় তার পেছনে একটা কাগজের মাছ এমনভাগে লাগিয়ে দেয়া হয় যাতে সে বুঝতে না পারে।

এপ্রিল ফুল ফ্রেঞ্চভাষীদের মাঝে 'এপ্রিল ফিশ' হিসেবেই পরিচিত

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,
এপ্রিল ফুল ফ্রেঞ্চভাষীদের মাঝে ‘এপ্রিল ফিশ’ হিসেবেই পরিচিত

ব্রিটিশদের মতে ইংরেজি সাহিত্যের জনক জেফরি চসারের বিখ্যাত দ্য ক্যান্টারবুরি টেলস বই থেকে এই এপ্রিল ফুল ব্যাপারটি এসেছে।

বইয়ের নানস প্রিস্টস টেল গল্পে তিনি বর্ণনা করেন মার্চ মাসের ৩২তম দিনে একটা মোরগকে বোকা বানায় শেয়াল।

কিন্তু যেহেতু মার্চ মাস ৩১ দিনের, তাই তিনি আসলে ৩২তম দিন বলতে পহেলা এপ্রিলকেই বুঝিয়েছেন বলে ধরে নেন অনেকে।

আবহাওয়া বোকা বানায়!

ভারনাল ইকুইনক্স-অর্থাৎ যেদিন পৃথিবীর দিন ও রাত সমান হয়।

সাধারণত মার্চের ২০-২১ তারিখে এমনটা হয়ে থাকে।

আর নর্দান হেমিস্ফেয়ার অঞ্চলে এটি হল বসন্তের আগমনী হিসেবে দেখা হয়।

আর এ সময়টায় আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটে। তাই আগে থেকে কিছু অনুমান করা যায় না। অর্থাৎ আবহাওয়া মানুষকে বোকা বানায়।

আর সে থেকেই এপ্রিল ফুলের উৎপত্তি বলে মনে করেন অনেক ইতিহাসবিদ।

প্রাচীন রোমের ‘হিলারিয়া’

ইতিহাসবিদরা প্রাচীন রোমের সাথেও এপ্রিল ফুলের যোগসূত্র দেখে থাকেন।

মার্চের শেষদিকে সেখানে দেব-দেবীদের মাতা খ্যাত সাইবেলের অনুসারীরা একটি উৎসব পালন করতেন যার নাম ছিল হিলারিয়া। লাতিন এই শব্দের অর্থ হল আনন্দদায়ক।

এদিনে মানুষ বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারণ করে অন্যদের সাথে মজায় লিপ্ত হত। আর সেখান থেকেই এপ্রিল ফুলের শুরু বলে অনুমান অনেকের।

এদিন সাধারণত পরিবারের ছোটরা বড়দের বোকা বানিয়ে থাকে

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,
এদিন সাধারণত পরিবারের ছোটরা বড়দের বোকা বানিয়ে থাকে

এপ্রিল ফুল এবং মজার ঘটনা

এপ্রিল ফুলের ইতিহাসে সবচেয়ে মজার ঘটনা ঘটে ১৬৯৮ সালে। সেবার ১লা এপ্রিল ইংল্যান্ডের টাওয়ার অব লন্ডনে “ওয়াশিং দ্যা লায়ন্স” অনুষ্ঠান দেখানোর নাম করে টিকিট বিক্রি করা হয়।

সিংহের গোসল করানো দেখতে হাজারো দর্শক নির্দিষ্ট সময়ে সেখানে ভীড় করে এবং দেখে সেখানে অনুষ্ঠান আয়োজনের নামমাত্র নেই। এভাবে সেদিন হাজারো মানুষকে বোকা বানানো হয়।

এপ্রিল ফুলের এই ট্রেন্ডে যোগ দিয়েছে বিবিসিও। আর এই দিনে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্র্যাংক মনে করা হয় ১৯৫৭ সালে বিবিসির একটি অনুষ্ঠানকে।

প্যানোরোমার প্রতিবেদনে বলা হয় সুইজারল্যান্ডে শীতের সময়ে স্প্যাগেটির ফলন হয়েছে। ভিডিওতে দেখানো হয় গাছ থেকে নুডলসের মতো স্প্যাগেটি ঝুলছে, আর কৃষকরা সেগুলো সংগ্রহ করছে।

মনে করা হয় এপ্রিল ফুল ঘিরে মানুষকে বোকা বানাতে টিভিতে অন এয়ার হওয়া এটিই প্রথম কোন অনুষ্ঠান।

অনেকেই অবশ্য এতে বিবিসির সমালোচনা করেছিল। আবার অনেকে খোঁজ নিতে থাকে যে তারা নিজেরা কিভাবে এই স্প্যাগেটি গাছ সংগ্রহ করতে পারে।

তবে ফেক নিউজের এই যুগে এপ্রিল ফুল থেকে একটু বাড়তি সাবধানতা দরকার সবারই।

বিবিসি বাংলা

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com