‘আদিবাসী’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে- একটি অঞ্চলে সুপ্রাচীন অতীত থেকে বাস করছে এমন জনগোষ্ঠী। ক্ষুদ্র জাতি-উপজাতি হলেই ‘আদিবাসী’ বা আদি-বাসিন্দা হবে তেমন কোনো কথা নয়। বাংলাদেশের বৃহত্তর পরিমণ্ডলে ‘আদিবাসী’ বা আদি-বাসিন্দাদের উত্তরসূরী হওয়ার প্রথম দাবিদার এদেশের কৃষক সম্প্রদায়, যারা বংশপরম্পরায় শতাব্দীর পর শতাব্দী মাটি কামড়ে পড়ে আছে। বানভাসি, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, নদীভাঙন, ভিনদেশি হামলা কোনো কিছুই তাদের জমি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। নদীভাঙনে কেবল এখান থেকে ওখানে, নদীর এক তীর থেকে অপর তীরে সরে গেছে। এ মাটিতেই মিশে আছে তাদের শতপুরুষের রক্ত, কয়েক হাজার বছরের। কাজেই বাংলার ‘আদিবাসী’ অভিধার প্রকৃত দাবিদার বাংলার কৃষক আদিতে প্রকৃতি পূজারী, পরবর্তীতে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান যে ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন।
এদিকে আদিবাসী নিয়ে বিতর্কে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে সমাধান দেয়া হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬ এর ২ ধারা মতে, জাতি হিসেবে বাঙালি ও নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশি বলে বিবেচিত হবে। এছাড়া বাঙালি ব্যতীত অন্যান্য যারা আছে তারা উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলে পরিচিত হবে। বাংলাদেশে বসবাসরত কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজেদের আদিবাসী স্বীকৃতির দাবি করায় এই মীমাংসিত বিষয়টি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
আভিধানিক ও নৃতাত্ত্বিক সংজ্ঞা অনুযায়ী আদিবাসী মানে আদিবাসিন্দা। আদিবাসী শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ Indigenous people। প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ মর্গানের সংজ্ঞানুযায়ী আদিবাসী হচ্ছে, ‘কোনো স্থানে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাসকারী আদিমতম জনগোষ্ঠী যাদের উৎপত্তি, ছড়িয়ে পড়া এবং বসতি স্থাপন সম্পর্কে বিশেষ কোনো ইতিহাস জানা নেই।’
স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই যখন পুরো দেশ স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতি নির্দয় ছিল, তখন বঙ্গবন্ধু ছিলেন ব্যতিক্রম। শুধু তাই নয়, তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ ছিলেন না। যার প্রমাণ মেলে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের মাত্র ১৮ দিনের মাথায় ২৯ জানুয়ারিতে যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের এই প্রতিনিধিদল তার সাথে সাক্ষাৎ করে। তিনি প্রতিনিধিদলকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, (ক) বাংলাদেশ সরকারের চাকরিতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নায্য হিস্যা প্রদান করা হবে (খ) ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ঐতিহ্য ও কৃষ্টি পুরোপুরিভাবে সংরক্ষণ করা হবে (গ) ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা তাদের ভূমির অধিকার আগের মতোই ভোগ করতে থাকবেন।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতা ও উদারতার ধারা অব্যাহত ছিল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে। পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করেই তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সংরক্ষিত মহিলা আসন থেকে শ্রীমতি সুদীপ্তা দেওয়ানকে সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। অথচ চাইলেই এই পদে যেকোনো বাঙালি অথবা চাকমা ব্যতীত অন্যকোনো সম্প্রদায়ের কাউকে মনোনয়ন দিতে পারতেন। জাতীয় সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রীর চেম্বারে সাক্ষাৎ করে সুদীপ্তা দেওয়ান বঙ্গবন্ধুকে তার নির্বাচনী এলাকা এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীয় জনসাধারণের সমস্যা সম্পর্কে অবহিত করার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, “ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীয় এলাকার জনগণের জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করা হবে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীয় জনগণ ও স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক এবং অন্যান্য নাগরিকদের মতোই সমান সুযোগ ও সুবিধা ভোগ করবে।”
এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীয় ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বৈদেশিক বৃত্তি মঞ্জুর করা হয়। ফলে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেই বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীয় ছাত্র-ছাত্রীকে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, পূর্ব জার্মানি, কিউবা এবং ভারতে পাঠানো হয়। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীয় ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসিক সংকট নিরসনের লক্ষ্যে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহারের জন্যে পাকাদালান বরাদ্দ করা হয়। মূলত পাহাড়ের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য বঙ্গবন্ধু সরকারের গৃহীত বিভিন্ন বাস্তবমুখী পদক্ষেপের ফলে, যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৬১ সালে শিক্ষার হার ছিল ১২.৭৯%, ১৯৭৪ সালে তা ১৯.৪৮% এ উন্নীত হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৩ (ক) রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। সংবিধানের কোথাও আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। এছাড়াও সংবিধানের ২৮ ধারায় উল্লেখ আছে “জনগণের যেকোনো অনগ্রসর অংশকে অগ্রসর করার নিমিত্তে, সুবিধা দেয়ার নিমিত্তে রাষ্ট্র যেকোনো প্রকার বন্দোবস্ত নিতে পারবে এবং সংবিধানের অন্যকোনো ধারা সেটাকে বাধা দিতে পারবে না।” যেমন শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা, বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ, বিসিএস নিয়োগে কোটা ইত্যাদি।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বেশ কিছু ক্ষুদ্র ও খণ্ড জাতি-উপজাতি আজকের দিনেও তাদের পৃথক সত্তা নিয়ে বিরাজ করছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাঝখানে বা প্রান্তিক অবস্থানে থেকেও তাদের অবস্থান বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। এর কারণ প্রথমত আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে জাতিসত্তার বিকাশে অপূর্ণতা এবং যথার্থ গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সমাজচেতনার অনুপস্থিতি। দ্বিতীয়ত অসম ও শোষণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে সমাজের দুর্বলতর অংশের দারিদ্র্যের চক্রজালে আবদ্ধ থাকা এবং তৃতীয়ত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমাজের ক্ষুদ্রতর বা পিছিয়ে থাকা অংশের প্রতি মানবতাবোধে উজ্জীবিত ‘গ্রহণীয়’ বা inclusive দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। আমাদের সমাজে অন্য ধর্মাবলম্বী বা অন্য জাতি-গোষ্ঠীর কোনো মানুষকে হাত বাড়িয়ে বরণ করে নেয়ার মানসিকতার অভাব খুবই স্পষ্ট। ফলে সুদীর্ঘকার পাশাপাশি বা কাছাকাছি থেকেও এসব ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী নিজ নিজ বৃত্তে আবদ্ধ থেকে গেছে।
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এতদঞ্চলে আগমন কয়েকশ বছরের বেশি পূর্বে নয়। বিশেষ করে চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলার চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এই তিন প্রধান সম্প্রদায়ের এতদঞ্চলে আগমনের নানা বিবরণ সুনির্দিষ্টভাবে ইতিহাসে বিধৃত আছে। চাকমাদের এতদঞ্চলে আগমন তিন-চারশ বছর পূর্বে। থাইল্যান্ড বা মিয়ানমারের কোনো একটি অঞ্চলে গোত্রীয় সংঘাতের জের ধরে এই জনগোষ্ঠী আরাকান হয়ে কক্সবাজার এলাকা হয়ে চট্টগ্রামে আগমন করে এবং চট্টগ্রামের সমতল ভূমিতে বসতি স্থাপন করে বাস করতে থাকে। একসময় তারা চট্টগ্রাম অঞ্চলে রাজশক্তিতেও পরিণত হয়েছিল। এই জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হয় ব্রিটিশ আমলে। ব্রিটিশরা লুসাই পাহাড়ে তাদের দখল স্থাপনের জন্য হামলা চালানোর সময় চাকমা সম্প্রদায়কে কাজে লাগায়। ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে মিজোদের বিরুদ্ধে তারা লড়াই করে। তার বিনিময়ে লড়াই শেষে তাদের রাঙামাটি অঞ্চলে বসতি গড়ার সুযোগ দেয়া হয়।
মারমা সম্প্রদায়ের ইতিহাসও প্রায় একইরকম। কয়েক বছর আগে বান্দরবনের সাবেক মং রাজা অংশে প্রু চৌধুরী এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমরা এই অঞ্চলে আদিবাসী নই’। বান্দরবান এলাকায় মারমা বসতি ২০০ বছরেরও পুরোনো। মং রাজাদের বংশলতিকা এবং ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ থাকায় এ বিষয়ে সংশয়ের কিছু নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তৃতীয় বৃহৎ জনগোষ্ঠী ‘ত্রিপুরা’। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছে পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্য থেকে। কথিত আছে সেখানকার রাজরোধ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্রতর অংশ স্বেচ্ছানির্বাসন বেছে নিয়ে এখানে এসেছে। সেটাও বেশি দিনের কথা নয়। এর বাইরে পার্বত্য চট্টগ্রামে আছে আরও আটটি ক্ষুদ্র জাতি। তাদের কোনো কোনোটি চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাদেরও পূর্ব থেকে এই অঞ্চলে বসবাস করছে। সংখ্যায় নগণ্য হলেও তাদের পৃথক নৃতাত্ত্বিক সত্ত্বা দৃশ্যমান।
বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায় গারো, হাজং, সাঁওতাল, ওরাঁও, রাজবংশী, মনিপুরী, খাসিয়া প্রভৃতি জনগোষ্ঠী রয়েছে। এদের অধিকাংশেরই বৃহত্তর অংশ রয়েছে প্রতিবেশী ভারতে। ক্ষুদ্রতর একটি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে আগে-পরে বাংলাদেশে এসেছে। তবে এদের কোনোটিই বাংলাদেশের আদিবাসিন্দা বা ‘আদিবাসী’ নয়। এই সকল জনগোষ্ঠীর প্রধান দাবি তাদের পৃথক জাতিসত্তার স্বীকৃতি। সরকার এসব জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করেছে। তাদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী পৃথক জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানেও কোনো আপত্তি থাকা উচিত নয়। কারণ সামগ্রিক জাতীয় পরিচয়ে তাতে কোনো সমস্যা দেখা দেয় না।
একটি আধুনিক জাতির-রাষ্ট্র যতই এগিয়ে যাবে তার পরিমণ্ডলে অবস্থিত বিভিন্ন জনগোষ্ঠী কাল-প্রবাহে বৃহত্তর দৈশিক আবহে ততই একক ও অভিন্ন পরিচয়ে ধাতস্থ হয়ে যাবে। এটাই ইতিহাসের ধারা। দুনিয়াজুড়ে প্রতিটি জাতি-রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই অসংখ্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বিরাজমান। এক হিসাবে পৃথিবীতে এখনও এ রকম ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এদের প্রত্যেকের পৃথক সত্তার স্বীকৃতি মেনে নিয়েই তাদের আত্মস্থ করে নিতে উদ্যোগী হতে হবে সব জাতি-রাষ্ট্রকে। সে জন্য প্রয়োজন উদার ও সংবেদনশীল মানসিকতা। পিছিয়ে থাকা গোষ্ঠীর প্রতি সহমর্মিতা।