মে মাসের সাতাশ তারিখ। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। ঠান্ডা বাতাস, উপসালা স্টেশনে নেমেই টের পাচ্ছি। খুব কাছের বন্ধু অভিনন্দন জানাতে স্টেশনে এসেছে। ছাতার নিচে হাঁটছি দুই বন্ধু গন্তব্যের দিকে। দশ বারো মিনিটের পায়ে হাঁটার পথ। যেতে যেতে এখানকার আবহাওয়া নিয়ে টুকটাক কথা বলছি। আমার মনটা পড়ে আছে আজকের অনুষ্ঠানের দিকে।
পৌঁছে গেলাম। অফিসটি বিশাল। বাড়ি বাড়ি পরিবেশ। কর্মরত মানুষগুলোর সবার মাঝে একটা হাসি হাসি ভাব। এ রুম থেকে ও রুমে যাচ্ছে। বিভিন্ন রকমের লোকজনের সমাগম, অনলাইনে, অফলাইনে। মহামারীকাল বলে অনেকেই অনলাইনে ভিডিও আলোচনায় যোগ দিয়েছেন। ‘নানা ধরনের মানুষের সমাগম’ এ কথার তাৎপর্যের প্রতি আমার আগ্রহ। এ কথার সঙ্গে আজকের অনুষ্ঠানের মিল রয়েছে। অনুষ্ঠানের উপজীব্য ‘বৈচিত্র্য’, সুইডিশ ভাষায় যাকে বলে ‘মংফাল্ড’।
অনুষ্ঠান শুরু হলো। অনুষ্ঠানটি ছিল উপসালা সাহিত্যকেন্দ্রের বসন্ত উৎসব। যারা অংশগ্রহণ করেছেন তারা হলেন বিভিন্ন মহাদেশের, ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার। আর দেশগুলো হলো সুইডেন, নেপাল, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ, ভারত, তানজানিয়া, গুয়েতেমালা, নাইজেরিয়া এবং কেনিয়া।
অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন বর্ণের, যেমন- সাদা, কালো ও মিশ্র। তারা বিভিন্ন ধর্মের- খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলিম। তাদের একজন থেকে আরেকজনের সংস্কৃতি-কৃষ্টি পুরোপুরি আলাদা, তারা ১৮-৭০ এর মধ্যে বিভিন্ন বয়সের। ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কর্মে রত তারা, তাদের মাতৃভাষা আলাদা, যেমন-বাংলা, হিন্দি, নেপালি, স্প্যানিশ, সুইডিশ, সোমালি, সুয়াহিলি ও ইংরেজি ইত্যাদি। তাদের মানসিক ও শারীরিক গড়ন আলাদা, কত বৈচিত্র্যময় তারা!
বৈচিত্র্য বলতে আমরা আসলে কী বুঝি? যখন বিভিন্ন বয়সের মানুষ ভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, কর্ম, সংস্কৃতি, ভিন্ন মাত্রায় ধন-সম্পদ নিয়ে এক জায়গায় বাস করে তখন বলে থাকি সমাজে বৈচিত্র্য বিরাজ করছে। এ বিচিত্রতা আরও বেশি দেখা যায় যখন বিভিন্ন দেশের মানুষ এক জায়গায় থাকে বা মিলিত হয়। সেখানে ভাষা, ধর্ম, বর্ণ ও সংস্কৃতির ভিন্নতা বেশি মাত্রায় যোগ দেয়
বসন্ত উৎসব উপসালাবসন্ত উৎসব উপসালাজীবন চলার পথ থেকে এ বিচিত্রতার কয়েকটি উদাহরণ দিতে চাই। পরিবারে: সমাজে বিচিত্রতা দেখা যায় সর্বত্র। আমার পরিবারের কথায় আসি। আমরা তিন ভাই-বোন, বাবা-মাসহ পাঁচজন। আমাদের মধ্যে নানা রকমের ভিন্নতা। আমরা নারী-পুরুষ, বিভিন্ন বয়সের মানুষ, গায়ের রং সাদা-কালো-মিশ্র, শারীরিক গঠন ভিন্ন, মানসিকতা আলাদা, চিন্তা-ভাবনা পরস্পর থেকে অন্য রকম। একই ঘরে থেকে কেউ ধর্মবিশ্বাসী, কেউ ধর্মপালনে উদাসীন। আমাদের পোশাক পরিধানের পছন্দ ভিন্ন। তবে পরস্পরের পছন্দের প্রতি আমরা হস্তক্ষেপ করি না। তাই এ বিচিত্রতায় এক সৌন্দর্য বিরাজ করে। আর আমার বাবা-মা তার সন্তানদের নিয়ে সমাজের একটি সুখী পরিবারে বাস করে কথাটা বলে ওঠে।
আমার বেড়ে ওঠার কালে ফেলে আসা গ্রামে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। আশি-নব্বই দশকের কথা। আমাদের বাড়ির পাশেই হিন্দুপাড়া ছিল। হিন্দুদের যে কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বড়রা আমাদের মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত বাড়িগুলোতে এসে তাদের পূজাপার্বণে যেতে বলতো। ছোট বড় সবার সে কি আনন্দ! মনে পড়ে, সন্ধ্যাবেলায় হিন্দুবাড়ির উলুধ্বনি শুনতেই এক ধরনের আনন্দ কাজ করতো। আবার মসজিদের আওয়াজে সবাই নীরবতা পালন করতো। সবাই যেন ভিন্ন আবার কোন একটা জায়গায় এক, পরস্পরের কাজকর্মে নীরব সম্মতি। অনেক অভাব অনটনের মাঝেও এক শীতল শান্তি অনুভব করতাম আমাদের গ্রামের মানুষ।
জার্মানিতে: জীবনের কিছুটা সময় জার্মানিতে কাটিয়েছি এবং ওখানে দেখেছি বৈচিত্র্য। আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয় শহরে থাকতাম। ওই শহরে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অনেক ছাত্র তার পরিবার নিয়ে থাকতো। অনেক ছাত্রেরই ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে ছিল, যেমন ছিল আমারও।
ওখানে দেখা একটি বৈচিত্র্যের কথা বলি। আমার কন্যাসন্তানটির বয়স তখন চার। ওকে বাচ্চাদের দিবা শিশু সদনে বা ডে-কেয়ার সেন্টারে দিয়েছি, ওরা কিন্ডারগার্টেন বলে থাকে। সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে বিকেল ছয়টা পর্যন্ত কিন্ডারগার্টেনে বাচ্চারা থাকে, বাবা-মায়ের প্রয়োজন অনুযায়ী। কিন্ডারগার্টেনে বেশির ভাগ বাচ্চা জার্মান, কিন্তু অন্যদেশ থেকে আসা বাচ্চাদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। যখন বাচ্চারা দল বেঁধে খেলতো, বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন রঙের-ঢঙের বাচ্চাদের যেন একসঙ্গে একটা রঙিন ফুলের মতো লাগতো। তারা পরস্পরের কথা, গল্প শুনে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে।
একবার আমার মেয়েকে বিকেলে কিন্ডারগার্টেন থেকে আনতে গেলে ওর এক শিক্ষক আমাকে এক চিঠি দিয়ে বললো এক জার্মান বাবা-মা তোমাকে এ চিঠিটি দিয়েছে। চিঠিটি পড়ে আমার ভালো লাগলো। উনি লিখেছিলেন, ওনার মেয়ে ও আমার মেয়ে একসঙ্গে খেলা করে কিন্ডারগার্টেনে, ওরা পরস্পরের ভালো বন্ধু। এজন্য উনি খুব খুশি। আমাদের যদি আপত্তি না থাকে, আমার মেয়েটিকে একদিন ওনার বাসায় নিয়ে যেতে চান, দুজন একসঙ্গে খেলবে। পরের ধাপে ওনার বাচ্চাটিও আমাদের বাসায় আসবে, যদি আমরা চাই। আমাদের আলোচনায় আমরা পরস্পরের সংস্কৃতি নিয়ে জানতাম, উৎফুল্ল হতাম, অনেক শেখার বিষয় খুঁজে পেতাম পরস্পর থেকে। শ্রদ্ধায় ভরে যেত মনটা। বিচিত্রতা যেন আমাদেরকে কাছে টেনে নিতে সাহায্য করলো।
বসন্ত উৎসব উপসালাবসন্ত উৎসব উপসালাওদেশে বৈচিত্র্যেকে অশ্রদ্ধা একেবারেই করে না তা নয়। একবার এক ভিনদেশী নারী তার সন্তানকে কিন্ডারগার্টেনে দিতে গেলে ওখানকার শিক্ষকরা নারীটির বোরখা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। বলেছিলো, জার্মান বাচ্চারা ভয় পাবে উনি বোরখা পরে গেলে। এখানে অন্য ধর্ম বা সংস্কৃতির প্রতি এক ধরনের বৈরী আচরণ করেছে। এতে করে এক সংস্কৃতির মানুষের অন্য সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে চলার পথটি কঠিন হয়ে গেলো।
আরও একটি উদাহরণ টানতে চাই। আমি এখানে প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞান পড়াই এবং পাঠ্যসূচিতে ‘যৌনতা’ প্রসঙ্গটি সুন্দরভাবে আছে। ভালো লাগে যখন দেখি শিক্ষার্থীরা খোলা মনে যৌনতা সম্পর্কিত বিষয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরে, ক্লাসের অন্যরা ভিন্নমতের প্রতি সম্মান দেখায় এবং নিজের মতটি নির্দ্বিধায় প্রকাশ করে। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ ছেলে বা মেয়ে লিঙ্গের বলে পরিচয় দেয়, আবার কেউ কেউ কোনো লিঙ্গের আওতায় পড়ে না বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। তাদের কাছে লিঙ্গ পরিচয়টা বড় বলে মনে হয় না। প্রত্যেকে সহজ সুন্দরভাবে তাদের বন্ধুদের ইচ্ছার প্রতি গুরুত্ব ও মর্যাদা দিচ্ছে। এটা অসাধারণ, বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য ধারণ।
বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য ধারণে সৌন্দর্য বাড়ে। মানুষ প্রত্যেকে প্রত্যেকের থেকে আলাদা। তাই চিন্তা ভাবনা, চালচলনও ভিন্ন। এ চালচলনে কারোর ক্ষতি নেই, বরং পরস্পরের মতামতের বিনিময়ে জীবন সম্পর্কে আরো অনেক বেশি জানা যায়, জীবনকে উদযাপন করা যায়। মানুষে মানুষে মনের মিল হয়, যখন একটা মানুষ ভিন্ন সংস্কৃতির, ভিন্ন গণ্ডির হওয়া সত্ত্বেও আরেকটা মানুষকে ঠিক তারই মতো অনুভূতিসম্পন্ন একটা মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। তাদের মাঝে অনেক অমিল থাকা সত্ত্বেও তারা যদি পরস্পরের ভিন্ন হওয়ার কারণ খুঁজে পায়, সেখানে আনন্দ আসে। এভাবে বৈচিত্র্য উপকারে আসে এবং সমাজে এ বিচিত্রতা জরুরি।
বৈচিত্র্য না থাকলে প্রতিটি স্তরে একগুয়েমি আসে। যেমন পরিবারের সবাই যদি একরকম হয় সেখানে পরিবারে একজন আরেকজনকে জানার আগ্রহ হারায়। ফলে জীবনবোধে বাধা আসে। ঠিক একই রকম ব্যাপার সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ঘটে, যদি বিচিত্রতা না থাকে। তাই বলি, বৈচিত্র্যে লাভ বিনা আমাদের ক্ষতি নেই।
লেখক রাবেয়া মীর, সুইডেন