আলেকজান্ডার নেভস্কি ক্যাথেড্রাল থেকে পশ্চিমের দিকে কয়েক গজ হাঁটলে আরও একটি দৃষ্টিনন্দন গির্জার দেখা মেলে। স্থানীয় লোকজন একে রাশিয়ান চার্চ বলে থাকে। এটি ‘চার্চ অব সেইন্ট নিকোলাস দ্য মিরাকল মেকার’ নামে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচিত। এ চার্চটি নির্মিত ১৮৮২ সালে। স্বাধীনতা–উত্তর বুলগেরিয়াতে রাশিয়ার দূতাবাস তাঁদের কর্মীদের উপাসনার জন্য এ চার্চটি নির্মাণ করে। অটোমান শাসনামলে এ স্থানে একটি মসজিদ ছিল, যেটি বুলগেরিয়ার স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বিদ্রোহীরা ধ্বংস করে ফেলে। বুলগেরিয়ানদের মতো রাশিয়ানরাও অর্থোডক্স খ্রিশ্চিয়ানিটিতে বিশ্বাসী; তা সত্ত্বেও রাশিয়ান চার্চগুলো অন্য অর্থোডক্স চার্চগুলোর তুলনায় গঠনগত দিক থেকে আলাদা। রাশিয়ান চার্চগুলোর গম্বুজ অর্ধ-গোলাকৃতি নয়, বরং অনেকটা সরু ও লম্বাকৃতির হয়ে থাকে।
রুশ সাম্রাজ্যের সাবেক অধিপতি দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে বুলগেরিয়ানরাও জাতীয় বীর হিসেবে সম্মান করেন। সোফিয়াতে তাঁর স্মরণে ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে অটোমানদের পরাজিত করার মাধ্যমে বিশ্বের বুকে বুলগেরিয়া নামক যে রাষ্ট্রটি জন্ম হয়েছে, তার প্রধান কারিগর ছিলেন দ্বিতীয় আলেকজান্ডার। তাঁর স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্যটিকে তাই ‘মনুমেন্ট টু দ্য টিসার লিবারেটর’ নামে অভিহিত।
বুলগেরিয়ানরা তাঁদের জাতীয় পতাকাকে খুবই ভালোবাসে এবং দেশটির সব জায়গায় তাঁদের এই জাতীয় পতাকার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বলা হয়ে থাকে, বুলগেরিয়ার সেনাবাহিনী নাকি তাদের দেশে সংগঠিত বর্তমান কিংবা অতীতের হেন কোনো যুদ্ধ নেই, যেখানে তারা নিজেদের পতাকাটিকে হারিয়ে ফেলেছে অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে ফেলে চলে এসেছে। বুলগেরিয়া ও তুরস্কা—এ দুটি দেশের মতো সর্বত্র জাতীয় পতাকার ব্যবহার আমি অন্য কোনো দেশে খুঁজে পাইনি। সোফিয়া থেকে শুরু করে সানি বিচ কিংবা রিলা মনাস্ট্রি—সর্বত্র এই পতাকার উপস্থিতি চোখে পড়েছে।
সোফিয়ার বেশির ভাগ স্থাপনা, যেমন সেন্ট্রাল হল মার্কেট, ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি, বিচার বিভাগের কার্যালয়, সিটি গার্ডেন, ন্যাশনাল পার্লামেন্ট—সবকিছুই সিটি সেন্টারকে ঘিরে। মোটামুটিভাবে হেঁটে এসব স্থাপনা ঘুরে দেখা সম্ভব।
ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় বুলগেরিয়ার মানুষের খাবারে তুলনামূলকভাবে মাংসের চেয়ে সবজির পরিমাণ বেশি থাকে। বুলগেরিয়ানদের দৈনন্দিন জীবনে টকদই বা ইয়োগার্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অনেকে মনে করেন, ইয়োগার্টের উৎপত্তি হয়েছিল বুলগেরিয়াতে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের মতো বুলগেরিয়াতেও কাবাব অত্যন্ত জনপ্রিয়। তবে বুলগেরিয়াতে কাবাবের সংজ্ঞা অন্যান্য দেশের তুলনায় ভিন্ন। বুলগেরিয়ানদের খাবারে মসলার ব্যবহার দেখলাম, যেটা ইউরোপে সচরাচর দেখা যায় না।
ভিতোশা বুলেভার্ডে আমার সঙ্গে এক প্রবাসী বাংলাদেশির পরিচয় হয়। তিনি একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সোফিয়াতে কাজ করছেন। কথা প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছিলাম, বুলগেরিয়াতে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা কেমন?
তিনি জানালেন, বর্তমানে খুব বেশি নেই। হালে যেসব বাংলাদেশি বুলগেরিয়াতে আসেন, তাঁদের বেশির ভাগের মধ্যেই অবৈধভাবে সেনজেনভুক্ত কোনো না কোনো দেশে অনুপ্রবেশের জন্য একধরনের নেতিবাচক প্রবণতা কাজ করে। তা ছাড়া বুলগেরিয়া এখনো সেভাবে অভিবাসনবান্ধব দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠেনি।
তবে গত শতাব্দীর আশির দশক পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য শিক্ষার্থী বৃত্তি নিয়ে বুলগেরিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। শিক্ষা সম্পন্ন করার পর তাঁদের বেশির ভাগই ভালো ভালো জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাঁদের অনেকে অধ্যাপনাও করছেন বলে জানালেন তিনি।
ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো বুলগেরিয়াতেও স্ট্রিট মিউজিক অত্যন্ত জনপ্রিয়। বুলগেরিয়ার সংস্কৃতি ও সাধারণ মানুষের খাদ্যাভ্যাসের মতো তাদের সংগীতেও অটোমানদের প্রভাব রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো বুলগেরিয়ারও জাতীয় বাদ্যযন্ত্র ব্যাগপাইপ, যা স্থানীয় ভাষায় গাইদা নামে পরিচিত।
দুপুরের খাবার শেষে ছুটলাম সোফিয়ার ডাউনটাউনে। পেরলোভস্কা নদীর তীরে নির্মিত ইগল’স ব্রিজ সোফিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এ ব্রিজের ওপর চারটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে, যেগুলো দেখতে ইগল পাখির মতো। এ কারণে ব্রিজটির এই নামকরণ। সরকারি কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ জানাতে প্রতিবাদকারীরা এখানে একত্র হন।
ইগল’স ব্রিজের পর আমাদের গন্তব্য ছিল বোরিসোভা গার্ডিনা। ইগল’স ব্রিজ থেকে মিনিট আড়াই হাঁটলে দেখা মিলবে বোরিসোভা গার্ডিনা নামের এই পার্কের। সোফিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় পার্কগুলোর মধ্যে বোরিসোভা গার্ডিনা একটি। ১৮৮৪ সালে এটি নির্মাণ করা হয়। বুলগেরিয়ার রাজা তৃতীয় বরিসের নাম অনুসারে এ পার্কটির নাম রাখা হয় বোরিসোভা গার্ডিনা। কমিউনিস্ট শাসনামলে এ স্থানটিকে বলা হেতো ‘ফ্রিডম পার্ক’। সম্পূর্ণ পার্কটি তিনভাগে বিভক্ত। তিন ভাগের কাজ সম্পন্ন হয়েছে তিনটি ভিন্ন সময়ে। পার্কটির বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য যার কোনোটি বুলগেরিয়ার স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ত, কোনোটি আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত, কোনোটি আবার বুলগেরিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা মানুষদের স্মরণে নির্মিত।
সোফিয়াতে আমাদের শেষ গন্তব্য ছিলো মিউজিয়াম অব সোশ্যালিস্ট আর্ট। ৪৫ বছর ধরে দেশটিতে বিরাজ করা কমিউনিস্ট শাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয়কে উপজীব্য করে এ মিউজিয়ামটি সাজানো হয়েছে। এ জাদুঘরটি অনেকটা ওপেন এয়ার মিউজিয়ামের মতোই। লেনিন ও স্তালিন থেকে শুরু করে কমিউনিজম ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মূর্তি সেখানে শোভা পাচ্ছে। মিউজিয়াম অব সোশ্যালিস্ট আর্টের অবস্থান সিটি সেন্টার থেকে একটু দূরে।
বুলগেরিয়ার একটি জিনিস আমার কাছে আশ্চর্য লেগেছে। কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থায় যেখানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁকা চোখে দেখা হয়। অথচ দীর্ঘ ৪৫ বছর কমিউনিস্ট শাসন সেখানকার মানুষের মধ্যে ধর্মবিশ্বাসে তেমন কোনো চিড় ধরাতে পারেনি। তুলনামূলকভাবে অর্থোডক্স চার্চগুলোকে খ্রিষ্টধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্য যেকোনো চার্চগুলোর তুলনায় অধিক রক্ষণশীল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের মধ্যেও ধর্মীয় চেতনা অত্যন্ত প্রবল, ক্যাথলিক কিংবা অ্যাংলিক্যানদের তুলনায়। এ কারণে হয়তো ৪৫ বছর তাদের ধর্মবিশ্বাস সুপ্ত অবস্থায় ছিল; কমিউনিজমের পতনে সেটি আবার প্রকট হয়েছে।
বুলগেরিয়া সত্যিকার অর্থে এ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশগুলোর মধ্যে একটি। এ দেশটিকে ভালোভাবে জানতে হলে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। মাঝেমধ্যে পরিতাপ হয় ভুল সময়ে বুলগেরিয়া ভ্রমণের জন্য। তা ছাড়া সঠিক পরিকল্পনারও অভাব ছিল। ইউরোপে আসার পর এটিই ছিল আমার প্রথম সফর। ফলে অনভিজ্ঞতাও এই সফরের সঙ্গী ছিল। তা সত্ত্বেও বুলগেরিয়া ভ্রমণের স্মৃতি আমার হৃদয়ে চিরভাস্বর। ভবিষ্যতে আরও একবার বুলগেরিয়া সফরের পরিকল্পনা আছে। তবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই ছুটব চলব এশিয়া ও ইউরোপের সঙ্গমস্থলের এ দেশটিতে।
বুলগেরিয়া থেকে আমার পরবর্তী গন্তব্য ছিল রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্ট। সোফিয়া থেকে বাসে বুখারেস্ট পর্যন্ত পৌঁছাতে আমাকে মাত্র এক ইউরো ভাড়া গুনতে হয়। সেরদিকা বাস টার্মিনালে আমাকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন স্ভেটোস্লাভ। বলা হয়, যার সব ভালো তার শেষ ভালো। তাই শুরুর অভিজ্ঞতা যতই তিক্ত হোক না কেন, বুলগেরিয়া সফরের শেষটা ছিল তৃপ্তিদায়ক ও স্মৃতিময়।
লেখক: রাকিব হাসান