শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৫০ পূর্বাহ্ন
Uncategorized

আজকের থিম্পু

  • আপডেট সময় শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১

গরমে দাবদাহ থেকে বাঁচতে পাহাড়ের দেশে ঘুরে আসার আইডিয়াটা মন্দ নয় বলুন? এই গরমে ঘুরে আসুন থিম্পু। ভুটানের পশ্চিম অংশে অবস্থিত, ছবির মতো সুন্দর এই শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একবার চোখে দেখলে, চোখ ফেরাতে পারবেন না। ছবির পোস্টকার্ডের মতো ছিমছাম সুন্দর এই শহর। ওয়াংচু নদীর ধারে চড়ুইভাতি করুন বা সপরিবারে গ্রুপফি তুলুন। ঘুরে দেখুন ৮০০ বছরের পুরনো বৌদ্ধমঠ চাংগাংখা লাখাং। পাহাড়ের কোল ঘেঁযা দূষণহীন এই শহরে দিন দুয়েক কাটিয়েই আসুন না!

শেষ বিকেলে গাড়ি প্রবেশ করল সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় ৮০০০ ফুট উচ্চতায় নীলাভ পাহাড়ে ঘেরা চিরসবুজ মনলোভা পরিবেশে সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ভূটানের রাজধানী থিম্পুতে। পাহাড়ি উপত্যকায় ঝকঝকে নীল আকাশের নীচে এই শহর। শহরের প্রান্ত ছুঁয়ে বয়ে চলেছে ওয়াংচু নদী। তার একদিকে পাহাড় আর একদিকে চড়াই-উৎরাইয়ের সুদৃশ্য নীচের চওড়া রাস্তা। ওয়াংচু নদীর ওপর পুল পার করে শহরের কেন্দ্রস্থলে ব্লক-টাওয়ারে পৌঁছালাম। যাবার পথে পুলের নীচে লক্ষ্য করি বাস স্ট্যান্ড ও শেয়ারে প্রাইভেট গাড়ির ছড়াছড়ি। গাড়িকে ছেড়ে ব্লক-টাওয়ারের সামনে দেখি চড়াই-উৎরাইয়ের ফুটপাত। এর চারদিক ঘিরে রয়েছে দোকানপাট, হোটেল, রেস্তোরাঁ ও সুদৃশ্য  ফোয়ারা। একদিকে বিরাট ড্রুক হোটেল, সামনে কিছুটা এগিয়েই ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, সরকারী অফিস ও বুমথাং, চেলাপাশ, হা-ভ্যালি, পুনাখা প্রভৃতি জায়গায় যাওয়ার অনুমতি পত্র সংগ্রহর পর্যটন অফিস। স্ত্রী-পুত্রকে লাগেজ সমেত ফুটপাতে দাঁড় করিয়ে কয়েকটি হোটেলের ঘর দেখি। নরজিমলামে নরজোয়েড প্লাজায় একটি হোটেল এক কথায় পছন্দ হয়ে গেল। সেখানে তৃতীয় তলে কেটি দ্বি-শয্যার ঘর দিন-চারেকের জন্য সংরক্ষণ করি। হোটেলের দুই ভূটানী যুবতী নীচে নেমে হাসিমুখে লাগেজসহ স্ত্রী-পুত্রকে ঘরে পৌঁছে দেয়।

দ্বিতলে এদের হোটেল সংলগ্ন আহারের রেঁস্তোরাঁটি অতীব চমৎকার। সূর্য পশ্চিমে অস্ত যেতেই স্ত্রী-পুত্রসহ হোটেলের সামনের রাস্তায় নরজিমলামে থিম্পুর সাঁঝের রূপ দেখতে বেরিয়ে পড়ি। পার্বত্য উপত্যকার হিমেল হাওয়ার স্রোত আমাদের হাড় কাঁপিয়ে দেয়। ঝাঁ চকচকে চড়াই-উৎরাইয়ের পাহাড়ি রাস্তায় অধিকাংশ ভূটানীই দোমা পোন্য মুখে দিয় চলাফেরা করছে কিন্তু কাউকে ধুমপান বা পানের পিক ফেলতে দেখলাম না। রাস্তায় প্রতিটা ল্যামপোস্টে রাস্তার ছবি। যা পরে লক্ষ্য করেছিলাম প্রতিটি হোটেলে, অফিস ও দোকানের দেওয়ালে টাঙানো। রাস্তায় এক টুরিস্ট ট্যাক্সিকে আগামীকাল সমগ্র থিম্পুর সাইট সীন দেখার জন্যে বুক করি। সে তার ফোন নং দিয়ে আগামীকাল সকালে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নেয়। হঠাৎ লক্ষ্য করি থিম্পুর রাতের আকাশ ভেদ করে এক সার্চ লাইটের তীব্র আলো পশ্চিম পাহাড়ে এক বুদ্ধ মূতির্র ওপর ঘোরাফেরা করছে। রাতে হোটেলেই ডিনার সারি।

পরদিন সকাল দশটায় চালক তার টুরিস্ট ট্যাক্সি নিয়ে হাজির। নরজিমলাম থেকে মেইন ট্রাফিক মোড় পেরিয়ে প্রথমেই পড়ল ভূটানের রানির পৃষ্ঠপোষোকতায় গড়ে ওঠা ন্যাশানাল মেমোরিয়াল চোর্তেন। চোর্তেনের ভিতরে দেখি এক ধ্যানমগ্ন বুদ্ধমূতির ও সম্মুখে প্রজ্জ্বলিত সারি সারি প্রদীপজ্বালা। এর সামনেই ভূটানের জেনারেল হাসপাতাল যা আসলে ভারতীয় মিলিটারি হাসপাতাল। পতে লক্ষ্য করি পাহাড় দিয়ে শহরটার চওড়া প্রশস্ত পাহাড়ি পথ ঘাটের সঙ্গে ভূটানী স্থাপত্য গড়ে উঠেছে বাড়িঘর, হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং সর্বশেষে মল ও ফ্ল্যাট কালচার। গাড়ি পাহাড়ি রাস্তা ধরে পৌঁছয় কুয়েনসাল নেচার পার্কের বুদ্ধ পয়েন্টে। থিম্পুবাসী ও পর্যটকদের কাছে সদ্য তৈরি হওয়া এই বুদ্ধপয়েন্ট এখানে এখন বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে দেখি প্রায় তিনতলা বাড়ির সমান ধ্যানমগ্ন ব্রোঞ্চের ওপর স্বর্নালী গিল্ট করা এক বুদ্ধমূর্তি। নেচার পার্কে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে যাই সার্বিথাঙ্গে থিম্পুর বোটানিকাল গার্ডেনে। জায়গাটায় যেন ভূটানীদের মেলা বসে গেছে। প্রধানরা পরিবারবর্গের সঙ্গে খাবার এনে পিকনিকের আনন্দ উপভোগ করছে ও যুবক-যুবতীরা বাহুবন্ধনে প্রেমে মত্ত। এরপর গাড়ি থিম্পুর হাইওয়ে ধরে। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে তিব্বত থেকে আসা বরফগলা জলের প্রবাহে পাথরের নুড়ির ওপর দিয়ে স্বচ্ছ জলের সেই ওয়াংচু নদী। কিছুটা এগিয়ে এক বিরাট মল। পরের জায়গার নাম চাংদিগাফু এবং এর পাশেই এক আপেল গাছের বাগান। অতপর গাড়ি থামে রবিটেনলামে চাংগাঙ্খা মনস্ট্রি দেখার জন্য।

সেখান থেকে চ়়ড়়াই–উৎরাইয়ের পাহাড়ি পথে হাজির হই থিম্পুর চিড়িয়াখানা থোরেলামে। থোরেলামে মোতিহাং নামে এক পাহাড়ের ওপর চিড়িয়াখানাটি। ভূটানের মিনিস্ট্রি অফ এগ্রিকালচার ও ফরেস্ট ডিভিশনের অধীনে চিড়িয়াখানাটি। সারা চিড়িয়াখানা জুড়ে ছাগল ও গরুর সংমিশ্রণে ‘তাকিন’ নামে এক অদ্ভুত জন্তু। ভূটানের এই জাতীয় পশুটিকে এখন কোনওরকমে সংরক্ষিত করে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়ে গাড়ি আরও ওপরে সঞ্জেগঙের পাহড়ি পথ ধরে। পাশেই ভূটানের ব্রডকাস্টিং রেডিও স্টেশনের টাওয়ার। এরপর গাড়ি জিলুখা নামে এক পাহাড়ি পথ ধরে হাজির হয় সাদা রং করা রাজার প্রশাসনিক সদর দফতর তাশিজঙ্গে। এখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। গাড়ি জুমলাম ধরে থিম্পুর সাবজেলামে চিলড্রেন পার্কে এসে পৌঁছায়। পার্কের অপর প্রান্তে বড় দ্বিতল এক সবজি বাজার। শুনে আশ্চর্য হলাম, ভারত থেকে আমদানীকৃত সবজি একতলায় ও ভূটানে উৎপাদিত সবজি দ্বিতলে বিক্রয় হয়। চালক বলল ভারতের উৎপাদিত ফসলে কীটনাশক পদার্থ ব্যবহারের জন্যে এই বিভাজন। চিলড্রেন পার্কের একপাশে থিম্পুর হাইকোর্ট ও আর একপাশে চাঙালী মাথান ন্যাশানাল স্টেডিয়াম। ছেলেরা দেখি ফুটবল প্যাকটিস করছে। চিলড্রেন পার্কটির নাম ‘করোনেশন পার্ক’। ২০০৮ সালে ইয়াংজম ওয়ানচুফের সময় তৈরি। থাইল্যান্ড থেকে আনা দন্ডায়মান এক বুদ্ধমূর্তি চিলড্রেন পার্কের মুখ্য আকষর্ণ। পার্কের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ জলের সেই ওয়াংচু নদী। হিমালয়ের মানসকন্যা অনিন্দসুন্দর পার্বত্য ভূমির মাঝে শীতের এই পড়ন্ত বিকেলে বয়ে যাওয়া তীব্র হিমেল হাওয়াকে সঙ্গী করে পার্কের এক বেঞ্চে বসি। পাশে বসে গাড়ির চালক জিগমে। স্ত্রী-পুত্র তখন দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশের নীচে পাহাড় সৌন্দর্য ভরা ওয়াংচু নদীর পাড়ে পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে। জিগমে ভাঙা হিন্দিতে তার দেশ সম্বন্ধে গল্প জুড়ে দেয়। ‘‘অতীশ দীপঙ্করের’’ পর তিব্বতের লামা ধর্ম প্রচার করেন। রাজা জিগমে দরজে ওয়াংচুফের স্পর্শে তারা আধুনিকতার ছোঁওয়া পায়। সে আরও বলে— ‘ভারত ছাড়া স্যার আমাদের একদিনও চলবে না।’ এই যে দেখছেন আমার পরিধেয় ‘খো’, তার কাপড় ভারত থেকে আনা। ভারতীয় সেনারা আমাদের সেনাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভূটানকে বাইরের দেশ থেকে রক্ষা করছে। থিম্পুর ভারতীয় সেনাদের হাসপাতালটি আমাদের চিকিৎসার প্রধান কেন্দ্র। তার গর্বিত উক্তি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শপথের পর ভূটানেই প্রথম আগমন। ভারতীয় সেনাদের প্রশিক্ষণে ভূটানী সেনারা প্রশিক্ষিত। ভূটানের পাহাড়ি পথ ঘাটের উন্নতি সর্বত্রই ভারতী সহায়তা ও উন্নতি প্রযুক্তির ফল। থিম্পু সফর শেষে সন্ধায় গাড়ি আমাদেরকে ক্লক-টাওয়ারের কাছে নামিয়ে দেয়।

বছরের প্রথম দিনের সন্ধেতে থিম্পু আলোকমালায় সজ্জিত। রাস্তায় যুবক-যুবতীরা বাহুবন্ধনে ক্লক-টাওয়ারের সামনের পার্কে প্রেমে মত্ত। রেস্তোরাঁগুলিতে চলেছে সুরা পানের তুফান ও হিন্দি গানের সুরের ঝঙ্কার। ক্লক-টাওয়ারের নীচে এক নেপালি দিদির দোকানে তৎক্ষনাৎ বানানো ঝালমুড়ি সহযোগে চায়ের তেষ্টা মেটাই। এই ছোট দোকানটিতে সর্বদাই ভিড়। বিশেষ করে যুবক-যুবতীদের। নেপালি দিদির সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে জানা গেল, অনেক ছোট থেকেই তিনি এখানে আছেন এবং রাজার সাহায্যে তার এই দোকান করা। চা খাওয়ার মাঝে এক প্রশ্নে জানতে চেয়েছিলাম, ভূটানীরা কেন অন্য জায়গায় কাজের খোঁজে যায় না। অল্প পরিশ্রমেই এখানে বেশি পাওয়া যায় ও পর্যাপ্ত সুখ এখানে। রাজার শান্তির হাত আমাদের সবার মাথার ওপরে। বাস্তবিকই লক্ষ্য করেছিলাম সময়ানুবর্তিতার অভাবের ফলে এদের দৈনন্দিন জীবন কাটে আলস্যে। হোটেলে ফেরার পথে রাতের থিম্পু তখনও আলো ঝলমলে, কল্লোলিত। পরদিন ভোররাত্রে ঘর সংলগ্ন অলিন্দ থেকে নীচের রাস্তায় দৃষ্টি যায়। থিম্পু তখনও জাগেনি। পথের স্বাস্থবান সারমেয়গুলি কুন্ডলী পাকিয়ে নিদ্রারত। ভোরের হালকা মায়াবী আলোয় নিস্তব্ধ পাহাড়ি শহরের অনন্য এক নয়নভিরাম সৌন্দর্য মনকে ছুঁয়ে যায়। কর্পোরেশনের জ্যাকেট-জিনস পরিহিতা সুবেশী ভূটানী তরুণীরা পথ সাফাইয়ে কাজ ইতিমধ্যই শুরু করেছে।

একটু বেলায় রাস্তায় বেরোলাম। দোকান বাজার খুলছে। দূরে দেখা যাচ্ছে সুউঁচ্চ পর্বতমালা। নরজিমলাম রাস্তার দু’পাশে ভূটানী স্থাপত্যের রং-বেরঙের পাহাড়ি বাড়িগুলির পাশ দিয়ে এগিয়ে চলি আমাদের হোটেলের পিছনের রাস্তায়। মোড়ে নৃত্যরত এক ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি সামলাচ্ছে। যদিও বা শহরের মধ্যে ঘণ্টায় ২০ কিমি বেগে চলা যানবাহন সবই শৃঙ্কলাবদ্ধ। কোনও গাড়ির হর্ন শোনা যায় না। একটু এগিয়েই ভারতীয় মিলিটারি হাসপালটি। দেখি ভূটানী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ চিকিৎসার জন্য অপেক্ষায়রত। তার পাশেই সাজানো এক শিবের মন্দির। ভূটানীরা নতশীরে ঘণ্টা বাজিয়ে প্রাথর্নায় মগ্ন। মন্দিরের সামনে ‘ইমট্রাক্ট’ ভারতীয় মিলিটারি ক্যান্টিন। থিম্পুতে গরম সিঙাড়া, অমৃত্তি ও চা-কফির জন্য বিখ্যাত। রাস্তায় সর্বত্র মানুষের মনে বুদ্ধের মহান বাণীকে ছড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যে তহিশি, আর্থাৎ ‘ওঁ মনিপদ্মে হুম’ লেখা মেনজ। ফেরার পথে ফুল বডি ম্যাসাজ ও স্পায়ের বিজ্ঞপিত বোডর্গুলি দেখে কৌতূহলী মন দ্বিতলে এক পার্লেরে টেনে নিয়ে যায়। রক্ষণশীল দেশে ম্যাসাজ পার্লার? খোঁজ নিতে গেলে দুই সুবেশী ভূটানী যুবতী পরিষ্কার হিন্দিতে জানায় হাজার থেকে দুই হাজারের মধ্যে ফুল বডি ম্যাসাজ ও বিভিন্ন স্পা পাবেন, কেবলমাত্র প্রাইভেট পার্টস ব্যাতীত। সহজ সরল অতিথিবৎসল রাজতান্ত্রিক দেশে শ্বালীনতার সীমা এখনও লঙ্ঘিত হয়নি। কাদিংচে অর্থাৎ ধন্যবাদ জানিয়ে হোটেলের পথ ধরি। দ্বি-প্রাহরিক আহারে সুস্বাদু বাঙালি খাবার পেয়ে কোলকাতার বাইরে যে আছি বোঝাও গেল না।

দুপুরে বিছানায় আলস্য কাটিয়ে বিকেলে আবার ক্লক-টাওয়ারের পথে। নরজিমলামের রাস্তা বরাবর হাঁটতে থাকি। সিনচুলা নামে এক রেস্তোরাঁয় দেখি ভারতীয় থালি সাজানো ছবি ও নানান খাবারের প্রদর্শন। থিম্পু সেন্টারে এক প্লাজায় প্রবেশ করলাম। পাপড়িচাট থেকে সামোসা, আলু পরোটা, এগরোল, দইবড়া, ভেজ মোমো, দই-ফুচকা এমনকি সন্দেশ, রসগোল্লা কি নেই সেখানে! প্লাজার ভিতরে বিহার প্রবাসী এক চর্মকারের দোকানে জগমোহন রামের সঙ্গে পরিচয় হল। কোনওকালে বাপ-ঠাকুর্দার আমলে সে এখানে এসেছিল। দোকানের মাথায় দেখলাম ‘জয় বাবা বিশ্বকর্মা’—এক সাইনবোর্ড। প্রত্যেকটা হোটেলের নীচে লক্ষ্য করলাম শপিং কমপ্লেক্স ও পানের দোকান। লন্ড্রি সার্ভিস, বুদ্ধের ছিব দেওয়া অ্যাস্ট্রোলজি সার্ভিস ও নানান পার্লার। চড়াই-উৎরাই পুটপাত সংলগ্ন সাজানো দোকানগুলিতে নানান মুখোশ, আসবাবপত্র, ইমিটেশান গয়নাগাটি ও শীতকালীন পোশাক-আসাক বিক্রি হচ্ছে। আর আছে বিভিন্ন ভারতীয় ও বিদেশী কোম্পানীর ইলেকট্রনিক সামগ্রীর দোকান। রাতের জমজমাট নরজিমলামে বিদেশী প্রায় চোখেই পড়ল না। কিন্তু আশ্চর্য হলাম কিছু বাঙালি পরিবারের ঘোরাফেরা ও তাঁদের সুউঁচ্চ কণ্ঠস্বর, যা জানান দেয় আমরা বিশ্বের সর্বত্রই বিরাজমান।

হোটেলে ফিরে যুবক ম্যানেজার ছেলেটির সঙ্গে আড্ডা জমাই। ক’দিন ধরে লক্ষ্য করছি হোটেলের মেয়েগুলি সকাল থেকেই কাজের ফাঁকে কেবল টিভির প্রোগ্রাম গেলে। সবই ভারতীয় হিন্দি চ্যানেল। ভারতীয় হিন্দি সিরিয়ালগুলি সবার মুখস্থ। অবাক হলাম সিরিয়ালগুলি দেখার সময় যদি আপনি কাউকে ঠেলা দেন, পড়ে যাবে। কোনও কথা জিজ্ঞাসা করলে সিরিয়ালের ঘোরে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে উত্তর দেবে। থিম্পুতে সকালে কোনও হকারকে কাগজ দিতে দেখিনি, পরতেও চোখে পড়েনি কোনও দৈনন্দিন খবরের কাগজ বা ম্যাগাজিনের স্টল। মনে হয় সংবাদ প্রচারে কোনও বাঁধা নিষেধ আছে। প্রাচীন সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের নিজস্ব ধারাকে বজায় রাখাই যেন ভূটানবাসীদের গর্ব। যদিও শহরে যথেষ্ট ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ও ইংরেজি ভাষায় ভূটানীরা যথেষ্ট সাবলীল। এখানে হাতে গোনা সিনেমা হলগুলিতে কেবলমাত্র ভূটানী ছবিই প্রদর্শিত হয়। মনে হয় রাজা বাইরের সংস্কৃতি থেকে এদেরকে দূরে সরিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। এরা অতিথিবৎসল হলেও বাইরের মানুষ এদের কাছে ব্রাত্য। মনের ভাব যেন ওই দু’-একদিন আমাদের দেশে এসেছে, ভ্রমণ করেছ ঠিক আছে কিন্তু বাপু কোনওরকম থেকে যাওয়ার চেষ্টা করও না। আমরা আমাদের নিয়েই সুখে আছি। পুরো ভূটানবাসীই সর্বদা হাস্যময়, সহজ সরল। জটিলতা এখনও এদের মধ্যে প্রবেশ করেনি। কথা বলে মনে হয়েছিল চিরকালই ওরা নিজেদের নিয়ে আত্মহারা, বহির্বিশ্বে প্রতিনিয়ত কি হচ্ছে তা জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।

নামগেল আর ডিকি দুই উচ্ছ্বল ভূটানী যুবতী। এক সকালে আমাদের ঘরের কার্পেটগুলো সাবান জল দিয়ে পরিস্কার করছিল। আমার স্ত্রী পরিচয়ের মাধ্যমে ক্ষনিকের জন্য ওদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে যায়। জানা গেল উচ্চ-মাঝ্যমিক ফলাফল বেরোবার মাঝে পকেট মানির জন্য কয়েক মাস হোটেলে চাকরি। আমার স্ত্রী তার সঙ্গে আনা টিপের পাতা উপহার দিতেই উচ্ছাসে ভেসে যায় ওরা। আমি ওদেরকে কোলকাতা আসার আমন্ত্রণ জানালে ওদের সহজ সরল প্রশ্ন, ‘আপনার বাড়িতে কি আমাদের ফ্রিতে কয়েকদিন রাখবেন?’

সকালে হোটেলের সামনে থেকেই ফুন্টশোলিং ফেরার শেয়ার ট্যাক্সি ধরি। শেয়ারে আজ আমাদের চতুর্থজন যাত্রী বাংলাদেশী যুবক ফারুক। সেই ট্যাক্সির ভাড়া নিয়ে দর-দস্তুর করে। ফেরার পথে গাড়ি পাহাড়ি পথে হাই স্পিড তুলল। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ির গতির নিয়ন্ত্রণের কথা বলতেই চালকের জবাব, ‘সব সময় কি নিয়ম মানা যায়? মাঝ রাস্তায় দ্বি-প্রাহরিক আহারের সময় দেখলাম ফারুক ও গাড়ির ড্রাইভার মৌজ কর সিগারেট ধরিয়েছে। ফারুককে ধুমপান নিষেধের কথা মনে করালে সে বলল, ছাড়ুন তো দাদা এরা নিষেধ ভাঙার অপেক্ষায়। আর কিছুদিন যেতে দিন না, সব বাঁধ ভেঙে যাবে। আমি তো এখানে প্রতিনিয়ত যাতাযাত করছি, অনেক কিছুই লক্ষ্য করি। ফারুকের কথার রেশ ধরে মনে পড়ল, থিম্পু ভ্রমণকালীন আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভার জিগমেকে টিপসের কথা জিজ্ঞাসা করতে সে আম্লান বদনে বলেছিল বিদেশীরা যাওয়ার সময় কতই না তাদের ডলারে টিপস দিয়ে যায়। বুঝতে পেরেছিলাম টিপস দেওয়া নেওয়ার নিষেধ থাকলেও অন্তরে টিপস নেওয়ার ব্যাকুলতা আছে। অপূর্ব পাহাড়ি শোভার মাঝে, কখনও নেমে আসা মেঘের কোল ছুঁয়ে গাড়ি থিম্পুকে বিদায় জানিয়ে ফুন্টশোলিং-এর উদ্দেশ্যে ছুটে চলে।

কীভাবে যাবেন

বিমানে  ভূটানের ড্রুক এয়ারে পারো গিয়ে ১ ঘণ্টায় গাড়িতে থিম্প।

কোথায় থাকবেন

থিম্পুর প্রধান রাস্তা ক্লক-টাওয়ারের কাছে নরজিমলামে প্রচুর হোটেল, ওয়েলকাম, নামগে, হারমনি, ট্যানডিন, ইয়োদজার, উগেন, নরলিং ও নানান গেস্ট হাউসে থাকা খাওয়ার চমৎকার বন্দোবস্ত। হোটেলের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝেছি, থিম্পুতে সিজন বা অফ সিজন বলে কিছু নেই। যখনই যাবেন সাধ্যের মধ্যে পর্যাপ্ত থাকার জায়গা পেয়ে যাবেন। থিম্পুতে সবরকম খাবারই পাবেন। মদ খুব সস্তা ও সুরা পানে কোনও বাধা নিষেধ নেই।

জেনে রাখা ভাল

এখনও থিম্পু থেকে তিন থেকে চার হাজারের মধ্যে দিনপ্রতি গাড়ি ভাড়া করে একদিন পারো, চেলা পাস, হা-ভ্যালি ও অন্যদিন দো-চুলা পাশ, পুজাখা, ওয়াংদি জং ও ফবজিকা দেখে আসা যায়। কেবলমাত্র বুংথাং দেখতে হলে আপনাকে দু’-তিনদিন সময় দিতে হবে। ভারতীয় টাকা ও ভূটানের টাকার বিনিময় মূল্য সমান। ভারতীয় টাকা ভূটানের সর্বত্রই চলে।

ভূটানে সারা বছরই যাওয়া যায় ।

ভূটানের পর্যটকের ওয়েবসাইট: www.tourism.gov.bt.

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com