ইরাক (Iraq) মধ্যপ্রাচ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ, যা আরব বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত। এটি প্রাচীন সভ্যতা, সমৃদ্ধ ইতিহাস, এবং বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির জন্য পরিচিত। ইরাকের পূর্বদিকে ইরান, উত্তরে তুরস্ক, পশ্চিমে সিরিয়া ও জর্ডান, এবং দক্ষিণে কুয়েত ও সৌদি আরব অবস্থিত। ইরাকের দক্ষিণ-পূর্বে পারস্য উপসাগরের একটি ছোট উপকূলরেখাও রয়েছে।
ভূগোল
ইরাকের ভূখণ্ড প্রধানত দুটি বড় নদী, টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস দ্বারা গঠিত। এই নদীগুলি মেসোপটেমিয়া নামক বিখ্যাত প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্র ছিল। ইরাকের মোট আয়তন প্রায় ৪,৩৮,৩১৭ বর্গকিলোমিটার। দেশটির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মরুভূমি, তবে টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদীর অববাহিকা উর্বর এবং কৃষিকার্যের জন্য উপযুক্ত।
রাজধানী ও প্রধান শহর
ইরাকের রাজধানী বাগদাদ (Baghdad), যা ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর। বাগদাদ ছাড়াও মসুল, বসরা, নাজাফ, কারবালা এবং এরবিল ইরাকের উল্লেখযোগ্য শহর।
জনসংখ্যা ও ভাষা
ইরাকের জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। দেশের প্রধান জাতিগোষ্ঠী আরব, তবে কুর্দি সম্প্রদায়ও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সরকারিভাবে আরবি এবং কুর্দি ভাষা ব্যবহৃত হয়। এছাড়া তুর্কমেনি, সিরিয়াক এবং আর্মেনীয় ভাষাও কিছু অঞ্চলে প্রচলিত।
ধর্ম
ইরাকের প্রধান ধর্ম ইসলাম, এবং জনসংখ্যার বেশিরভাগই মুসলিম। মুসলিমদের মধ্যে শিয়া এবং সুন্নি দুটি বড় সম্প্রদায় রয়েছে। নাজাফ ও কারবালা শিয়া মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র স্থান। এছাড়াও দেশে খ্রিস্টান, ইয়াজিদি এবং মান্দেয়ান ধর্মাবলম্বীরাও রয়েছে।
অর্থনীতি
ইরাক একটি তেল-সমৃদ্ধ দেশ। দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হলো তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি। তবে যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দুর্নীতির কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রায়ই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি, বিশেষ করে গম, বার্লি, খেজুর এবং চাল উৎপাদনও দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ইতিহাস
ইরাকের ইতিহাস বিশ্ব ইতিহাসে অন্যতম প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ। এটি মেসোপটেমিয়ার অংশ ছিল, যেখানে সুমের, আক্কাদ, ব্যাবিলন, এবং আসিরিয়ান সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। ব্যাবিলনের বিখ্যাত “হ্যামুরাবি কোড” এবং “ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান” ইরাকের ঐতিহ্যের অংশ।
ইসলামের উত্থানের পর বাগদাদ আব্বাসীয় খিলাফতের রাজধানী হয়ে ওঠে এবং ৮ম থেকে ১৩শ শতাব্দীর মধ্যে এটি ছিল জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। তবে মঙ্গোল আক্রমণ, উসমানীয় শাসন, এবং ঔপনিবেশিক শাসন ইরাকের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ১৯৩২ সালে ইরাক স্বাধীনতা লাভ করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদের কারণে দেশটি বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।
সংস্কৃতি
ইরাকের সংস্কৃতি তার প্রাচীন ইতিহাস এবং ইসলামিক ঐতিহ্যের মিশ্রণে গঠিত। সঙ্গীত, সাহিত্য, এবং শিল্পকলায় ইরাকের বিশেষ অবদান রয়েছে। মাকাম সংগীত এবং আরবি কবিতা ইরাকের ঐতিহ্যের অংশ।
পর্যটন
ইরাকে অনেক ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় স্থান রয়েছে। বাগদাদের ইতিহাস-সমৃদ্ধ স্থান, উর ও বাবিলনের ধ্বংসাবশেষ, নাজাফ ও কারবালার পবিত্র মাজার, এবং কুর্দিস্তানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
চ্যালেঞ্জ
ইরাক যুদ্ধ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছে। অবকাঠামো উন্নয়নের অভাব, বেকারত্ব, এবং নিরাপত্তা সমস্যা দেশের প্রধান চ্যালেঞ্জ। তবে ইরাকি জনগণের সাহসিকতা এবং সংস্কৃতি তাদের নতুন পথ খুঁজে নেওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায়।
ইরাক একটি বৈচিত্র্যময় দেশ, যা প্রাচীন এবং আধুনিক বিশ্বের একটি অনন্য মেলবন্ধন। এর সমৃদ্ধ ঐতিহ্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ভবিষ্যতের জন্য অনেক সম্ভাবনা তৈরি করে।