1. [email protected] : চলো যাই : cholojaai.net
মিথোজীবী সহবাস । কারমেন নারানহো
বৃহস্পতিবার, ২৮ অগাস্ট ২০২৫, ০৮:২৪ অপরাহ্ন
Uncategorized

মিথোজীবী সহবাস । কারমেন নারানহো

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২ জুলাই, ২০২১

কারমেন নারানহো (জন্ম : ১৯৩১) কোস্টারিকার ঔপন্যাসিক ও গল্পকার। স্প্যানিশ ভাষায় লেখা তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘লাস পেরোস নো লাদরারোন’ ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় এবং ১৯৮২ সালে প্রকাশিত তাঁর ছোটগল্পের সংকলন ‘ওনদিনা’, যা সারা দেশে ব্যাপক সাড়া ফেলে। নারানহোর এই গল্পটি স্প্যানিশ ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সেদরিক বুসেত্তে। লাতিন আমেরিকান নারীদের লেখা জাদুবাস্তব গল্পের সংকলন ‘শর্ট স্টোরিজ বাই ল্যাটিন আমেরিকান উইমেন, দ্য ম্যাজিক অ্যান্ড দ্য রিয়াল’–গ্রন্থে গল্পটি রয়েছে। সেখান থেকে গল্পটি বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।]

আমাদের মধ্যে প্রেম ছিল। আমার নাম অ্যানা। আর তার নাম মানুয়েল। আমাদের হুট করে যে দেখা হয়েছিল, ব্যাপারটা মোটেও সেরকম না। আমাদের পরিচয়ের আগেই একজন আমার ব্যাপারে মানুয়েলকে বলেছিল। আর দশজন মেয়ের চেয়ে আমি যে একটু আলাদা ধরনের জীবনযাপন করি; রাস্তার বিড়াল কোলে তুলে তার গালে আদরের চুমু খাওয়ার মতো অভ্যাস যে আমার আছে, সে কথা মানুয়েল সেই কেউ একজনের কাছ থেকেই শুনেছিল। একটা অন্যরকম পৃথিবীর স্বপ্নে আমার বিভোর হয়ে থাকার কথা সে জেনেছিল। কীভাবে রাত্রির স্তব্ধ অন্ধকার আমার চোখ খুলে দেয়, কীভাবে রাত্রি আমার রূপ খুলে দেয়—এসব সে শুনেছিল। সে শুনেছিল, কখনো আমি চুপচাপ মটকা মেরে থাকি, কখনো চেষ্টা করেও কেউ আমার বকবকানি থামাতে পারে না। সে শুনেছিল, খুশিতে চিকচিক করা যেকোনো মুখ কীভাবে আমাকেও খুশিতে আত্মহারা করে এবং কীভাবে আমি বিরামহীন স্বগতোক্তি দিয়ে লম্বা পরিসরের মোনোলোগধর্মী উপন্যাস লিখে থাকি।

ঠিক সেই কেউ একজন মানুয়েলকে যেমন আমার সম্পর্কে বলেছিল, তেমনি মানুয়েলের বিষয়েও আমাকে বলেছিল। মানুয়েলের একটা প্রেমের সম্পর্কে জড়ানো ও বিপর্যয়করভাবে সেই সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, তার একাকিত্ব, অতি সাধারণ ছোটখাটো বিষয়কেও অতি গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করার তার নিউরোটিক অভ্যাস এবং এই সংবেদনশীলতার একটানা গুরুভার তাঁকে যে চিকিৎসাযোগ্য সংবেদনশীলতার রোগীর পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল—এসব কিছু সে আমাকে জানিয়েছিল। পরে সেই লোকই আমাদের দুজনের একটি ‘অ্যাকসিডেন্টাল’ সাক্ষাতের ব্যবস্থা করিয়ে দেয়।

অকুস্থলে আমিই প্রথম পৌঁছেছিলাম। কাউকে কথা দিলে কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সময়ে হাজির হওয়ার বদভ্যাসই আমাকে সেখানে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। আড্ডা চলছিল। মানুয়েল যে সেখানে আগে থেকেই হাজির হয়ে আছে আমি তা জানতাম। সে ‘হ্যালো’ বলাতে তাঁর কণ্ঠ ও হাত নাড়িয়ে শুভেচ্ছা জানানোর ভঙ্গিমা দেখে তাকে চিনে ফেললাম। প্রথম দেখাতেই প্রবল উচ্ছ্বাসে ডগমগ হয়ে জড়িয়ে ধরেটরে হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলা লোক সে নয়। আবার নিজের ভেতরকার আবেগ প্রকাশ না করে পিঠের ওপর শীতল অভিব্যক্তির আলতো হাত চাপড়ানি দেওয়া, কিংবা কাছে এসেই গালে চকাস করে বা খানিক দূরত্ব বজায় রেখে সশব্দ চুমু খাওয়া লোকদের মতোও সে নয়।
যখন আমার মনে হলো আড্ডাটা শেষের পথে, তখন আমি তার সাথে কথা না বলেই চলে যাওয়ার জন্য উঠলাম। আড্ডার মধ্যে যারা আমার খুব কাছে ছিল, বিশেষ করে যাদের এতক্ষণ ধরে আমি নানা ধরনের রেসিপি বাতলে দিচ্ছিলাম এবং কালো দুল পরেও কীভাবে মুখশ্রী ফুটিয়ে তোলা যায়, সেই জ্ঞান দিচ্ছিলাম—তাদের সবাইকে ‘গুডবাই’ বলে পা বাড়ালাম।

দরজার কাছে যেতেই সেই কেউ একজন চেঁচিয়ে বলল, ‘আরে, আড্ডা তো মাত্র শুরু হলো! তুই উঠে যাচ্ছিস যে!’ তার দিকে আমি না চেয়েই দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললাম, ‘আমার অন্য কাজ আছে’। পেছনে না ফিরেই আরেকবার সবাইকে ‘গুডবাই’ বললাম। হুট করে উঠে পড়ে যেকোনো আড্ডাকে মাঝপথে মাঠে মারার যে কুখ্যাতি আমার ছিল তা ধরে রাখতে পারা গেল এবং মনে মনে তার সাথে আলাপ করার আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখার পরও শেষ পর্যন্ত আগ বাড়িয়ে তার সাথে পরিচিত হতে যাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখা গেল—এটা ভেবে ভালোই লাগছিল। বের হতে হতে শুনলাম সেই কেউ একজন আমাকে চেঁচিয়ে বলছে, ‘আরে থাকো, তার সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেবো। আমি নিশ্চিত তোমাদের দুজনে মানাবে ভালো। আমি শিওর, তোমরা দুজনই চাঙা হয়ে যাবে।’

আমি কিছু না বলে বেরিয়ে রাস্তায় নামলাম। বাইরে এসে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বুক ভরে নিশ্বাস নিলাম। বুঝলাম, আমি আলাপের চেয়ে স্বগতোক্তি বেশি পছন্দ করি। আমার কাছে সেনসেশনের চেয়ে সেন্টিমেন্টের দাম বেশি। আমাকে কেউ পছন্দ করবে—এটি আমার কাছে যতটা ভালো লাগার বিষয় তার চেয়ে অনেক বেশি ভালো লাগার বিষয় হলো আমি কাউকে পছন্দ করব। অর্থাৎ, পছন্দ করার কর্তৃত্বটা আমার নিজের দখলে রাখাই আমার বেশি পছন্দের।

আমি আড্ডা থেকে বেরিয়ে রাস্তার একেবারে শেষ কানায় যেতেই মানুয়েল আমাকে থামাল। বলল :
‘তুমি তো আচ্ছা মেয়ে! পিছলা কেটে পালিয়ে যাচ্ছ যে বড়! আমি যে তোমার জন্যই এখানে এলাম। তোমার সাথে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাই না। আমরা কি দুজনে একসঙ্গে এক কাপ কফি খেতে পারি?’

তার বলার মধ্যে অধিকার মেশানো একটা আবদার আর আমাকে রাজি করিয়ে ফেলার ক্ষমতা ছিল। তাই এড়ানোর উপায়ও ছিল না। আমরা ক্যাফেতে টেবিলে মুখোমুখি বসলাম। আমরা দুজন যেন অনেক আগে থেকেই দুজনকে নিবিড়ভাবে জানি, এমন মনে হচ্ছিল। কথা বলতে বলতে আমরা পরস্পরের পায়ের পাতার স্পর্শ অনুভব করলাম। সেই স্পর্শ আমার মধ্যে একটা প্রবল আবেগভরা উষ্ণতা ও প্রাণশক্তি জাগিয়ে তুলল। আমি যেন আমার মধ্যে তৈরি হয়েই ছিলাম। সত্যিই আমি সেই স্পর্শের জন্য তৈরি হয়েছিলাম। আমি তার মুখের দিকে চাইলাম। কথা বলতে বলতে আমাদের চুমু খাওয়া চলছিল। কফি আর সিগারেটের কড়া ঘ্রাণমাখা মুখে সে আমাকে চুমু খাচ্ছিল। টেবিলের কানায় ভর করা আমার দুই হাতের কনুই ব্যথায় ভারী না হয়ে আসা পর্যন্ত আমি তার গাঢ় চুম্বনে যেন অসাড় হয়ে গিয়েছিলাম। কাফে থেকে বেরিয়ে সারা পথ হাত ধরাধরি করে আমার অ্যাপার্টমেন্টে না পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা চুমু বিনিময় করছিলাম। সেখানে টানা এক সপ্তাহ আমরা ভালোবাসাবাসিতে কাটিয়েছি। দিন আর রাতের পার্থক্য যেন আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। সারা দিনরাত বিছানায় জড়াজড়ি করে পড়ে থাকতে থাকতে অবসন্ন হয়ে না পড়া পর্যন্ত, টিনজাত টুনামাছের একঘেঁয়ে খাবারের গন্ধে তিতিবিরক্ত না হওয়া পর্যন্ত এবং টেলিফোন বাজলে তা রিসিভ করা দরকার—এমনটা মনে না হওয়া পর্যন্ত গোটা সপ্তাহ আমরা অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরই হইনি।

‘আমি তোমাকে ভালোবাসি মানুয়েল, এখনো তোমাকেই ভালোবাসি। সেই ভালোবাসা, আমার সেই প্রেমকে তোমার বুঝতেই হবে।’
স্বীকার করছি দুজনের দুরকমের স্বভাবগত প্রকৃতির ভিন্নতা একটা সময় নিশ্চয়ই পরিস্থিতিকে বদলে দেয়। এই বদলে যাওয়া মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কেরই অংশ। পৃথিবীর তাবৎ সম্পর্কের অলিখিত চুক্তিই একদিন শেষ হয় এবং সেটি স্মৃতি রোমন্থনে এসে শেষ পরিণতি পায়।

পৃথিবীর সব সম্পর্কের মতো আমাদের মাখামাখি সম্পর্কের পারদও নিচে নামতে শুরু করল এবং আমরা শুধু উইকেন্ডে অভিসারে মিলিত হতে শুরু করলাম। প্রথম দিকে উইকেন্ডে একসঙ্গে থাকার বিষয়টি আমাদের কাছে খুব জাঁকালো ব্যাপার ছিল। দেখা হওয়ার সময় মনে হতো যেন আমরা দুজনই এই দিনটির জন্য সপ্তাহজুড়ে ক্ষুধিত থাকতাম। আমরা দীর্ঘ সময় কাটাতাম। একটা সময় সেই সপ্তাহান্তের অভিসারও কেমন যেন রুটিনের মতো হয়ে দাঁড়াল এবং মিলনের সময়ের ব্যাপ্তিও ক্রমান্বয়ে কমতে লাগল। শেষমেশ সেটা একেবারে পানসে পর্যায়ে গিয়ে ঠেকল, কারণ আমাদের দুজনের আচরণই দুজনের কাছে পূর্ব অনুমেয় হয়ে উঠেছিল। প্রত্যেকবার ভাবতাম, এবারের উইকেন্ডটা কীভাবে কাটানো যায়? দুজন দুজনকে সারপ্রাইজ দেওয়া, জোর করে আদর করা, সিডিউস করা, ঠাট্টা-তামাশা করা, কপট অভিনয় করে পরিস্থিতি সহজ করার চেষ্টা করা, জেলাসি দেখানো, সন্দেহ করা, এমনকি সাবেক লাভারকে নিয়ে এসে এক অন্যকে খোঁচা মারা—এমন সব ধরনের কাণ্ড আমাদের মধ্যে ঘটে গেছে। এসব কিছুই একটা সময়ে আমাদের কাছে নিতান্ত পানসে ব্যাপার মনে হতে লাগল।

মানুয়েল, তুমি মনে করে দেখো, আমাদের মধ্যে কী নিয়ে কথা হতো। আমরা সবসময় শুধু আমাদের ব্যাপার নিয়েই কথা বলতাম। আমরা কতটা সৎ, আমরা কতটা সুখী আর সৌভাগ্যবান, আমাদের জুটিবাঁধাটা কতটা চমৎকার, অন্য যুগলদের চেয়ে আমরা কতটা আলাদা, আমাদের নিজেদের জন্য একটা আলাদা জগতের কতটা দরকার—এই সব আত্মকেন্দ্রিক আলাপই তো আমাদের মধ্যে বেশি হতো। আমরা এখনো একটা কল্পিত সমাজ ও জগতে বিচরণের যে স্বপ্ন দেখি এবং আমাদের সেই ভাবনার মধ্যে যে রাজনৈতিক দর্শন লুকিয়ে আছে তা কেউ বুঝতে পারে না কেন—তা নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হতো বেশি। সাহিত্য করে বললে বলা যায়, আমাদের দুজনের মনই একটা পর্যায়ে এলোমেলো ও অপ্রত্যাশিত অবস্থার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। একদিন আমার এক বন্ধু মানুয়েলের চোখের রং কী তা জিজ্ঞাসা করেছিল। আমি চট করে বলে ফেললাম, ওর চোখ তো নীল, ঘোরলাগা সুন্দর নীল, খুব সংবেদনশীল আর ধীরস্থির চোখের মণি। কথাটা বলেই আমার মনে খটকা লাগল। আদতেই কি নীল? কখনো কখনো তো তোমার চোখ প্রায় সবুজের মতো লাগে, বিশেষ করে তুমি যখন পাহাড়ের দিকে তাকাও তখন। যখন মনে হলো আমি তার চোখের রংটা পর্যন্ত চিনতে পারিনি তখন যেন একটা হতাশা আমাকে স্তব্ধ করে দেয়। আমি আসলে কখনো চোখে চোখ রেখে তাকে দেখিনি। আমাদের শারীরিক ভালোবাসাবাসি আমাদের এক কুয়াশাচ্ছন্ন রহস্যের মধ্যে ফেলে দিয়ে গেছে।

একটা সময়ে আমরা দুজন এই সম্পর্কে জড়ানোর পর কে কার চেয়ে কত বেশি দিয়েছি তা নিয়ে তর্কে জড়ানো শুরু করলাম। আমি বলতাম, ‘আমরা দুজন যে ফার্নিশড্ অ্যাপার্টমেন্টটায় থাকি সেটা আমার টাকায় কেনা। বিদ্যুৎ বিল, ফোনের বিল—এই সব হাবিজাবি সব খরচ আমি দেই। আমি এই ‘সংসারে’ যা খরচ করি তা যে কাউকে কৈফিয়ত না দিয়ে নিজের মতো করে চলার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট।’ আর সে বলত, প্রতিদিনকার খাবার, ভদকা, সিগারেট আর গাড়ির তেল খরচ দেওয়া ছাড়াও বাইরে রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাওয়ার খরচ তাকে দিতে হয়। সে বলত, রেস্টুরেন্টে খাওয়ার পর বিল মিটিয়ে যা বাঁচে তা দিয়ে অনেক সময় ওয়েটারকে বকশিশ দিতে গিয়েই সব শেষ হয়ে যায়। একটা সময় আমার মনে হলো, এভাবে তো আর চলতে পারে না। এ রকম খারাপ অবস্থায় আমি কখনো পড়িনি। মাগনা থাকছে, মাগনা মেয়েমানুষ পাচ্ছে, মাগনা পিরিতের আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। এ কোন ধরনের ভেড়ুয়া আমার কপালে জুটল? ঈশ্বর আমাকে এমন এক উপহার দিলেন! আসলে আমার কপালই এমন। র‌্যাফেল ড্রতে আমার ভাগ্যে খালি ফেলনা জিনিসপত্রই ওঠে।

তুমি বলতে, একটু চাপাচাপি করে খরচ করে দুটো পয়সা বাঁচানোর বিদ্যে আমার নাকি একেবারেই জানা নেই। কথাটা মিথ্যে নয়। আমার খরচের হাত বরাবরই লম্বা। পাই-পয়সা করে জমিয়ে জমিয়ে ট্যাক ঢাউস করা অনেকের নেশা। আমার সে ধরনের অবসেশন নেই। যে জিনিস অলরেডি হজম হয়ে গেছে তা আবার ঢেকুর তুলে গালে এনে চিবিয়ে খাবার খেয়ে খরচা বাঁচানোর ছোটলোকি নেশা আমার কখনোই ছিল না। আসলে এগুলো হলো কোনো ফসল না বুনে কিংবা ফসল না কেটেই নিজের টাকা দ্বিগুণ করে নেওয়ার বিদ্যা শেখার ফল। আমাদের নিজেদের আর্গিউমেন্ট কী ছিল! আমার দিক থেকে বলতে পারি, আমি তোমাকে ঠিকই বুঝেছি। আমার ওপর নজর ছিল তোমার। হ্যাঁ, আমি যা বলছি, ঠিকই বলছি, তোমার নজর ছিল আমার ওপর। একটা সময় আমরা পরস্পর চোখের দৃষ্টি দিয়ে মনের অলিন্দে ঢোকার চেষ্টা করেছি।

একদিন আমরা একে অন্যের দিকে কতক্ষণ গভীরভাবে বা কৌতূহল মেশানো দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম তা নিশ্চিত করে বলতে পারব না। তোমার চোখে তাকিয়ে আমি সেই রংটা আবিষ্কার করতে পারলাম যেটি ছিল একেবারে নোংরা ধরনের হলুদ যা সবকিছুকে প্রতিফলিত করে, যা সবকিছুকে বদলে দেয়, যা ঘোরলাগা দৃষ্টিমাখা চাউনির হীমশীতলতার সঙ্গে একেবারে ঠিকঠাক মিলে যায়। সে চাউনির মধ্যে এমন বিশদ দৃশ্য ছিল যা আমাদের এমন ঘোরে নিয়ে গিয়েছিল যে আমরা আমাদের অতিসঞ্চয়ী হওয়া ও অপব্যয় সংক্রান্ত ঝগড়াঝাটি ভুলে গিয়েছিলাম। যতক্ষণ একটা মিষ্টি আবেশ, চমক, আর ঘোর আমাদের চোখকে পূর্ণ করে রেখেছিল ততক্ষণ আমরা পরস্পরের দিকে পলকহীন চেয়েছিলাম। সেটিই ছিল আমাদের শেষবারের মতো ভালোবাসাবাসি। শেষ পর্যন্ত যখন আমরা আমাদের তীব্রভাবে পরস্পরকে বিদ্ধ করে ফেলা দৃষ্টি থেকে নিজেদের ফারাক করলাম, তখন আমরা দুজনেই কাঁপছিলাম। ঘামছিলাম। ততক্ষণে আমাদের একটা দেহাতীত অর্গাজম হয়ে গেছে। আমার কণ্ঠে আবার এমন কোমলতা ফিরে এল যাতে বোঝা যাচ্ছিল, আমরা যে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বাদানুবাদ করছিলাম, সেই মন কষাকষি আমাদের মন থেকে মুছে গিয়েছিল।

সেও তর্কাতর্কির জন্য ক্ষমা চাইল। বলল, ‘এমনটা আর হবে না। আজকে আমি একটু খিটখিটে হয়ে গিয়েছিলাম।’ আমরা ঠিক করলাম, এক সপ্তাহ আমরা আলাদা থাকব। এই বিচ্ছিন্নতা আমাদের পরস্পরের অনুপস্থিতিকে টের পাইয়ে দেবে। এতে মানবিক সম্পর্কের সত্যিকারের উপাদান আমরা মিস করব। নতুন করে দুজন দুজনের প্রতি আকর্ষণ বোধ করব। এক সপ্তাহ পার হওয়ার পর সে তার সুটকেস নিয়ে হাজির হলো। তার গায়ে তখন নোংরা পোশাক। তার মুখ থেকে দুর্গন্ধ আসছিল। এই সময়টাতে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল এবং আমিও তাকে মিস করছিলাম। তাকে যে আমি মিস করছিলাম, সে বিষয়ে আমি তাকে মিথ্যাও বলতে পারছিলাম না, সত্যও বলতে পারছিলাম না। এ কারণে চুপ ছিলাম। আমরা দুজনই ঘরের দুই কর্নারে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। জন্তু-জানোয়াররা যেভাবে দূর থেকে একজন আরেকজনের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করে সেভাবে আমরা পরস্পরকে নিয়ে ভাবছিলাম। অন্য রুম থেকে সারা রাত তার বমি করার শব্দ আমার কানে আসছিল। সে কিছুই পেটে রাখতে পারছিল না।

সে আলুবোখারা খেয়েছিল। আধা হজম হওয়া সেই আলুবোখারা বমির সাথে বের হয়ে টয়লেট সিটকভার এবং বাথরুমে যেন রং করে ফেলেছিল। পরের দিনগুলোতেও তার বমি হতে লাগল। পেয়ারা, শিমের বিচি, মাখন লাগানো আটার রুটি, ম্যাকারনি, পিৎজা—সবকিছুতেই তার শরীর একই প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিল। তার ছোটখাটো তুচ্ছ কাজ কারবারেও আমার বিরক্ত লাগতে শুরু করল। মনে হলো তার বেশ কিছু তুচ্ছ কাজ আমাকে জ্বালিয়ে মারছে। সে হালকা পাতলা গড়নের। ফলে যখন তার স্তন বড় হতে শুরু করল এবং তলপেট স্ফীত হতে লাগল তখন সে খুবই অবাক হচ্ছিল। ছয় মাস পর বেচারা মানুয়েল আমাকে হতবুদ্ধি করে, এমনকি নিজেকে বিস্ময়াভিভূত করে শারীরিকভাবে এতটাই বদলে গেল যে তাকে আর পুরুষমানুষ বলেই চেনার উপায় থাকল না। তার পেট বিশাল আকার নিয়েছে, স্তন পেটের কাছে নেমে এসেছে। সে নিজেকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে। সে নিজেকে ঘরের মধ্য লুকিয়ে রাখছিল। আমি তাকে ডাক্তারের কাছে যেতে বললাম। কিন্তু সে ঘরের বাইরে যেতে চাইল না। সে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাপড় বোনা ছাড়া আর কোনো কাজ করছিল না। সে উল দিয়ে ওড়না এবং সোয়েটার বুনছিল। লো ব্লাডপ্রেশারের কারণ তার গায়ে কাঁপুনি ছিল। তার শীত করছিল। কিছুই তার শরীরকে গরম রাখতে পারছিল না। বোধ হয় সেকারণেই সে উল দিয়ে সোয়েটার বুনছিল।

সে আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠছিল। কিন্তু তাকে তিরস্কার করতে করতে এক সময় আমি ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। একপর্যায়ে তার আচার আচরণ, অসংবদ্ধ কথাবার্তা, সব মেনে নিতে শুরু করলাম। সে অনবরত বলত, ‘আমি বাঁচব না। আমি অকর্মা হয়ে আর কোনো কাজ করার যোগ্য নই। এ হলো বুড়ো হওয়ার আগেই বুড়িয়ে যাওয়া রোগ।’ সে সেক্স করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আমি সাড়া দিতে পারিনি। সে যখন আমাকে স্পর্শ করতে যাচ্ছিল আমি তখন তাকে হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছি। আমি তাকে বললাম, ‘আমার ভেতরে বাজে অনুভূতি হচ্ছে। আমার বিবমিষা হচ্ছে।’ এরপর আমিও বমি করতে শুরু করলাম। আমরা দুজন মিলে ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার মানুয়েলকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে তার দেহ পরীক্ষা করতে লাগলেন। ফুলে ফেঁপে ওঠা তলপেট ধরে দেখলেন। ডাক্তার তার স্তনের বোঁটা টিপে দিতেই পানি জাতীয় তরল কিছু বেরিয়ে এল। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা ট্রান্সভেস্টাইট (যে পুরুষ নারীদের পোশাক পরে, অথবা যে নারী পুরুষের পোশাক পরে) কিনা। আমি বললাম, না আমরা সেধরনের কিছু নই, মানে তেমন অবস্থা এখনো আমাদের হয়নি। ডাক্তার মানুয়েলকে বললেন, ‘বাচ্চা ভালোই আছে। আসছে ডিসেম্বরে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে ডেলিভারি হবে। আপনি যদি আমাকে এক্সক্লুসিভ রিসার্চ রাইটস অনুমোদন করেন তাহলে আমি সেই অপারেশনের কোনো খরচ নেব না।’ আমি? আমি মানুয়েলের বাচ্চার মা হব? অথবা তার বাচ্চার বাবা হব? এটা হতেই পারে না। আমরা দুজনেই এর বিরুদ্ধে মত দিলাম। এই বিষয় নিয়ে কথা বলাতেও আমাদের আপত্তি ছিল। কারণ সত্যিই মানুয়েলের পেটে আমার বাচ্চা পয়দা হলে আমাদের নিয়ে লোকেরা হাসাহাসি করবে।

আমরা দুজনেই একমত হয়ে ডাক্তারকে গর্ভপাত করিয়ে দিতে বললাম। ডাক্তার বোঝালেন, গর্ভপাত ঘটাতে গেলে সেটি মানুয়েলর দিক থেকে আত্মহত্যার শামিল হবে। অন্যদিকে মানুয়েলের গর্ভের শিশুকে প্রকারান্তরে হত্যাই করা হবে। বেঁচে থাকব শুধু আমি। এই দুটি প্রাণহানি এবং তার জের ধরে যে অবস্থা তৈরি হবে তার জন্য আমাকেই দায়ী হতে হবে। আমরা ডাক্তারের কাছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে একটু সময় চাইলাম। এটা হলো কেন তা নিয়ে আমরা সবকিছু খুঁটে খুঁটে দেখছিলাম। আমাদের যৌনাঙ্গ, আমাদের যৌন আচরণ, যেসব ভিন্ন ভিন্ন ধরনের সেক্স পজিশনে আমরা মিলিত হয়েছিলাম, যেসব যৌন মিলনের কায়দা আমরা রপ্ত করতে চেয়েছিলাম, সব আমরা খুঁটে খুঁটে দেখছিলাম। কিন্তু এত গবেষণার পরও এমন কিছু পাওয়া গেল না যা দিয়ে এই পরিস্থিতির কারণ ব্যাখ্যা করা যায়। তাহলে কি এটা কারও ডাইনিবিদ্যার কারসাজি? হতে পারে। আমরা দুজনের কেউই ডাকিনীবিদ্যা বিশ্বাস না করলেও সে আশঙ্কা উড়িয়ে দিতে পারলাম না। আস্তে আস্তে সব যেন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে লাগল। মনে হলো : আমাদের মধ্যে দৃষ্টিবিনমিয়ের মাধ্যমে যে অপথালমিক অর্গাজম হয়েছিল তা আমাদের দুজনের চরম গোপনীয়তাকে দুজনের কাছে খোলাসা করে দিয়েছিল এবং কোনো এক ভয়ানক পিশাচ সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নারী-পুরুষের লৈঙ্গিক পার্থক্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটা ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থাকে ওলট পালট করে দিয়ে গেছে। গাদাগাদা অদ্ভুত ঘটনা ও প্রপঞ্চময়তা নিয়ে লেখা এক লাইব্রেরি বই পড়ার পর (কারও কোনো সাহায্য ছাড়াই তত দিনে আমরা এসব অদ্ভুত ঘটনার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছি) কোনো দিকদিশা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার নিলাম। ভেবে দেখলাম, আমাদের নিয়ে হাসাহাসি তো হবেই, সেই হাসাহাসিটা না হয় তারাই করুক যাদের কাছে আমরা সম্পূর্ণ অপরিচিত।

মানুয়েলকে সীমান্তের বাইরে নিয়ে যাচ্ছি। তা নিয়ে তার কোনো আপত্তি ছিল কিনা? সেদিকে খেয়াল করার সময়ই আমার ছিল না। সে আমার কাছ তখন বিরাট আপদ। কোনো কাজই তখন তার করার অবস্থা ছিল না কারণ তখন নয় মাসের বাচ্চা তার পেটে। আগে তার ওপর যদি আমি তিতিবিরক্ত হয়ে থাকি, তাহলে এখন সিম্পলি চাই, সে আমার জীবন থেকে চলে যাক। তাকে নিয়ে যখন গাড়িতে করে সীমান্তের বাইরে হাইওয়ে ধরে ছুটছিলাম, তখন বেশ কয়েকবার মন হয়ছিল, গাড়ির দরজা খুলে তাকে হাইওয়েতেই ফেলে চলে যাই। শেষমেশ আমরা একটা হাসপাতালে এসে পৌঁছালাম। হাসপাতালের দরজায় তাকে রেখে বললাম, এবার নিজের ব্যবস্থা নিজে করো। বলে চলে এসেছিলাম। কিন্তু পরের দিন হাসপাতালে ঠিকই দর্শনার্থীদের লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একেবারে অনীহা নিয়ে প্রসূতি ওয়ার্ডের দিকে গেলাম। সেখানে গিয়ে মানুয়েলকে, হ্যাঁ একটা মেয়ের সাথে সেক্স করে পেট বাঁধিয়ে ফেলা আজব পুরুষ মানুয়েলকে খুঁজলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য, কেউ মানুয়েলের কথা বলতে পারল না। তারা বলল, তারা আজ পর্যন্ত কোনো দিন কোনো অন্তঃসত্ত্বা পুরুষের চিকিৎসা করেনি। এমন উদ্ভট কথা তারা শোনেওনি। আমি এবার মানুয়েলকে হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করলাম। মর্গে, গোরস্থানে, হোটেলে, বোর্ডিং হাউসে, প্রাইভেট ক্লিনিকে, বারে-সবখানে তন্নতন্ন করে তাকে খুঁজতে লাগলাম। আমি তখন বেপরোয়া হয়ে তাকে খুঁজছি, আফটার অল, তার পেটে যে বাচ্চা, সেটা তো আমার। আমার সেই বাচ্চাটা নিশ্চয়ই ‘ওয়া ওয়া’ করা বিকট কান্না মাখা আওয়াজ করতে করতে এই দুনিয়ায় এসেছে। আমি হাসপাতালের লোকদের সাথে কথা বলার সময় টের পাচ্ছিলাম, আমার মুখে একটা গোঁফ উঠছে। তারপর দু-একটা দাঁড়িও উঠছে বলে মনে হতে লাগল। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার বাচ্চাটাকে কেউ চুরি করেছে। আমার মুখের সদ্য গজানো গোঁফ আর দাঁড়িকে বোঝার মতো মনে হচ্ছিল। বাতাসে দাঁড়ি যেন দুলছিল। সেই দুলুনির তালে তাল দিয়ে অপেরা গায়কের মতো ভারী গলায় আমি বলে যাচ্ছিলাম, ‘আহারে আমার বাচ্চাটা চুরি হয়ে গেছে রে’।

আমি যখন আমার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরলাম তখন আমার চেহারায় সন্তানহারা বাবার সব লক্ষ্মণ ফুটে উঠেছে। একটা ভয়ংকর একাকিত্ব আমাকে যেন গ্রাস করছিল। নিজেকে বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, কোথাও না কোথাও আমারই একটি অংশ নিয়ে কেউ একজন হেঁটে বেড়াচ্ছে। ইদানীং শেভ না করলে দাঁড়ির ভারে যেমন আমার মুখ ভারী হয়ে আসে, তেমনি একাকিত্বের গুরুভার আমার মনকে ভারী করে তুলেছে। সেই বোঝা হালকা করার জন্য এখন আমাকে রোজ দুবার করে শেভ করতে হচ্ছে।

বাংলা ট্রিবিউন

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Developed By ThemesBazar.Com