বলা হয়, শরীরিকভাবে বয়স বাড়লেও মনের বয়স সবার বাড়ে না। তাই বয়স যখন ৮০ পেরিয়েছে, তখনো ভ্রমণের নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন ব্রিটিশ টেলিভিশন অভিনেতা মাইকেল পেইলিন। পৃথিবীর কোনায় কোনায় ঘুরে বেড়ান তিনি। বয়স এখন ৮২। এই বয়সের বেশির ভাগ মানুষ অলস অবসর কাটান। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেষ বয়সটা কেটে যায়। তবে পেইলিন সময়ের নিয়ম মানেন না। দিন দিন তাঁর ভ্রমণের তৃষ্ণা বাড়ছে। সম্প্রতি তিনি জীবনের ১০০তম দেশ ভেনেজুয়েলা ভ্রমণ করে দেশে ফিরেছেন।
ভেনেজুয়েলার পথে
ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে শুরু করে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট সবাই ভেনেজুয়েলাকে ভ্রমণের জন্য বিপজ্জনক দেশের তালিকায় রেখেছে। খুন, ছিনতাই, ডাকাতি এমনকি অপহরণের মতো আশঙ্কা সেখানে প্রতিনিয়ত শোনা যায়। রাস্তা থেকে শুরু করে হোটেল পর্যন্ত পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। ঠিক এই কারণে ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে একধরনের আতঙ্ক কাজ করে ভ্রমণকারীদের মনে। তবু মাইকেল পেইলিন ঝুঁকি নিতে পিছপা হননি। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নিজের চোখে না দেখলে ভেনেজুয়েলার প্রকৃত চিত্র বোঝা যাবে না। তাই ক্যামেরা দল নিয়ে পা রাখেন লাতিন আমেরিকার এই বিতর্কিত দেশে। চ্যানেল ফাইভে সম্প্রচারিত হচ্ছে তাঁর নতুন ডকুমেন্টারি সিরিজ ‘মাইকেল পেইলিন ইন ভেনেজুয়েলা’। যেখানে দেশটির রাজনৈতিক টানাপোড়েন, মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রাম আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি তুলে ধরা হয়েছে পর্যটকের চোখে ভেনেজুয়েলাকে।
অতীতের স্মৃতি এবং বর্তমানের বিশৃঙ্খলা
একসময় ভেনেজুয়েলা ছিল পর্যটকদের স্বপ্নের দেশ। আন্দিজ পর্বতমালা থেকে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু জলপ্রপাত, আর ক্যারিবীয় উপকূল সবকিছু পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় ছিল। নব্বইয়ের দশকে ব্যাকপ্যাকারদের কাছে কারাকাস ছিল জনপ্রিয় গন্তব্য। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ও ভেনেজুয়েলার নিজস্ব এয়ারলাইনস ভিয়াসা তখন নিয়মিত ফ্লাইট চালাত। কিন্তু সাবেক প্রেসিডেন্ট শাভেজ ক্ষমতায় থাকার সময় অর্থনৈতিক অস্থিরতা শুরু হওয়ায় রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা বাড়তে থাকে। আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনসগুলো একে একে কারাকাস ছেড়ে যায়। শাভেজের মৃত্যুর পর নিকোলাস মাদুরো ক্ষমতায় এলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়।
ক্যামেরার সামনে বিপদ
ডকুমেন্টারির প্রথম পর্বে পেইলিন বলেন, ‘এখানে ভ্রমণ মানে অনেক ঝুঁকি।’ দ্বিতীয় পর্বে দেখা যায়, তাঁকে ও তাঁর টিমকে আটক করেছে ভেনেজুয়েলার গোয়েন্দা সংস্থা। সশস্ত্র প্রহরীরা চারপাশ ঘিরে রাখেন। এমন মুহূর্তে তাঁর কমেডিয়ান পরিচয় তাঁকে রক্ষা করে। প্রহরীরা ইউটিউবে মাইকেল পেইলিনের ভিডিও দেখে হাসিতে ফেটে পড়েন।
কেন থামছেন না
অনেকে ভাবতে পারেন, এই বয়সে এমন কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণ কেন? পেইলিনের উত্তর, ‘কাজের প্রতি ভালোবাসা, কৌতূহল আর পৃথিবীকে দেখার নেশা। প্রতিবারই আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। কারণ, এখনো ভ্রমণ করতে পারছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি সফর আমাকে আরও সতেজ করে তোলে। মানসিকভাবে উজ্জ্বল লাগে, শরীরও চাঙা হয়। পৃথিবীকে চোখের সামনে দেখা, এটা সবচেয়ে বড় তৃপ্তি। এতে আমি ক্লান্ত হই না। আরও শক্তি পাই। বেঁচে থাকার আনন্দ নিতে পারি।’
ভবিষ্যতের ইঙ্গিত
ভেনেজুয়েলায় কিছু ট্যুর কোম্পানি আবারও ভ্রমণের আয়োজন শুরু করেছে। যদিও সংখ্যায় তা খুব কম। তবে সাধারণ পর্যটকদের সেখানে যেতে অনেক সাহস লাগে। আর এই কারণে পেইলিনের এই সফর এত গুরুত্ব পাচ্ছে। তিনি যেন সবার জন্য ভেনেজুয়েলা ভ্রমণের পথ আরও সহজ করে দিচ্ছেন।
৮২ বছর বয়সেও থামেননি মাইকেল পেইলিন। শততম দেশ ভ্রমণ শেষে তিনি জানান, যত দিন মানুষ দেখতে চাইবে, তত দিন তিনি ভ্রমণ চালিয়ে যাবেন। ভ্রমণ তাঁর কাছে শুধু কাজ নয়, বরং জীবনকে নতুন করে দেখার এক জাদু। অনেকেই হয়তো ভেনেজুয়েলার মতো দেশে যেতে সাহস পাবে না। কিন্তু মাইকেল পেইলিন সেখানে গিয়ে স্থানীয় সৌন্দর্য মানুষের সামনে তুলে আনেন।
সূত্র: দ্য ইনডিপেনডেন্ট