প্রশাসনের ২৯ সচিবের ৪৩ সন্তান বিদেশে বসবাস করছেন। এর মধ্যে ১৮ জন সচিবের ২৫ সন্তান বাস করছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বাকি ১৮ জন আছেন কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও ভারতে। এই ৪৩ জনের মধ্যে বেশির ভাগই পড়াশোনা করছেন। বাকিরা ব্যবসা বা চাকরি করছেন। একটি দায়িত্বশীল সংস্থার অনুসন্ধানে এসব তথ্য মিলেছে।
সূত্র বলেছে, গত মে মাসে নতুন মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ সচিব পদমর্যাদার ৮৬ জনের সন্তানদের কে কোথায় আছেন এবং কী করছেন, তা নিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়। অনুসন্ধানের পর ৮৬ সচিবের মধ্যে ২৯ জনের সন্তানদের বিদেশে থাকার তথ্য প্রতিবেদন আকারে তৈরি করা হয়। পর্যায়ক্রমে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সন্তানদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে বলে জানা যায়। ওই তালিকায় থাকছে দেশের ৮ বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশের ৮টি রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি), ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপার (এসপি)।
২৪ মে রাতে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে। এই নীতির আওতায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে হলে যেকোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা দেওয়ায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে বলে জানায় দেশটি। বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, সরকারপন্থী এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা নতুন এই ভিসা নীতির অন্তর্ভুক্ত হবেন।
জানতে চাইলে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান গতকাল বুধবার বলেন, ‘যাঁরা দেশের বাইরে গেছেন, তাঁরা আইন মেনেই গেছেন। এখন কোনো সচিব যদি নির্বাচনকেন্দ্রিক কার্যক্রমে আইনবিরোধী কিছু করেন, তাহলে তাঁরা ভিসা নীতির আওতায় সমস্যায় পড়তে পারেন। আর সেই কারণে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা তাঁদের সন্তানদেরও কিছু সমস্যা হতে পারে। তবে সচিব সরাসরি নির্বাচনী কাজ করেন না। তাঁরা আইন মেনে কাজ করলে কোনো সমস্যা দেখছি না। আর তাঁদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে বিদেশি কোনো শক্তি কিছু করতে অন্যায় কিছু করাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।’
ওই সংস্থার তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৮ জন সচিবের ২৫ সন্তান যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে পরিকল্পনা সচিব সত্যজিত কর্মকারের দুই মেয়ে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহর দুই মেয়ে, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান (সচিব) মো. ফয়জুল ইসলামের দুই ছেলে, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) মোসাম্মৎ নাসিমা বেগমের এক ছেলে, পাবর্ত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মশিউর রহমানের এক ছেলে, তথ্য ও সম্প্রচারসচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকারের এক মেয়ে ও এক ছেলে, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. কামাল হোসেনের এক মেয়ে, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিনের এক মেয়ে, সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেনের এক ছেলে, সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) সচিব হাসানুজ্জামান কল্লোলের এক ছেলে ও এক মেয়ে, সংস্কৃতিসচিব মো. খলিল আহম্মেদের এক ছেলে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদারের এক ছেলে ও এক মেয়ে (দুজনেই চাকরি করেন), মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মো. মাহমুদুল হোসাইন খানের এক ছেলে, পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের এক ছেলে এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিনের এক মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। এ ছাড়া মৎস্য ও প্রাণিসম্পদসচিব ড. নাহিদ রশীদের এক মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন।
পররাষ্ট্রসচিবের এক মেয়ে কানাডায় এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিবের এক ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছেন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদসচিবের এক মেয়ে ভারতে আছেন।
জানতে চাইলে গণপূর্তসচিব কাজী ওয়াসি উদ্দিন গতকাল বুধবার নিজ দপ্তরে বলেন, ‘আমাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে দেশের বাইরে আছে। তাঁরা পড়াশোনা করতে গেছে।’
সন্তানের বিষয়ে কথা বলতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মো. মাহমুদুল হোসাইন খানের ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোন করে বন্ধ পাওয়া যায়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহর ব্যবহৃত দুটি মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করলেও ধরেননি।
সংস্কৃতিসচিব মো. খলিল আহম্মেদ বলেন, ‘আমার ছেলে দুই বছর সাত মাস আগে স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকা গেছে। ছেলে মূলত পড়াশোনা করছে।’
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মশিউর রহমান বলেন, ‘আমার ছেলে এক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে গেছে।’
দায়িত্বশীল সংস্থার প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, কানাডায় বসবাস করছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খানের দুই ছেলে, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিব মো. আজিজুর রহমানের এক মেয়ে। যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন নৌপরিবহনসচিব মো. মোস্তফা কামালের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) আবদুল বাকীর এক ছেলে স্ত্রীসহ নিউজিল্যান্ডে এবং পরিকল্পনা কমিশনের আরেক সদস্য (সচিব) এ কে এম ফজলুল হকের এক ছেলে ফিনল্যান্ডে পড়াশোনা করছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এনএসডিএ) নির্বাহী চেয়ারম্যান (সচিব) নাসরীন আফরোজের এক ছেলে এবং পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিনের এক ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করছেন।
এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছেন রেলপথসচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীরের এক ছেলে, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন সচিব ড. ফারহিনা আহমেদের এক ছেলে ও এক মেয়ে এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদসচিব মো. মইনুল কবিরের এক মেয়ে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরিফা খানের এক ছেলে কানাডায় ও আরেক ছেলে পোল্যান্ডে বাস করছেন।
এ বিষয়ে জানতে মোবাইলে ফোন করা হলে নৌপরিবহনসচিব মো. মোস্তফা কামাল ধরেননি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খানের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
সূত্র : আজকের পত্রিকা