নারীরা এখন আর্থিকভাবে সাবলম্বী, তারা শিক্ষিত, আত্মসচেতন। তাদের পায়ের নীচের মাটি এখন অনেক শক্ত। তারা কারো অন্যায় আচরণে আর নতজানু হয় না। হওয়া ঠিকও নয়। তাই মা-নানীদের মতো শত অন্যায়, অভাব অনটন দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে পুরো জীবন কাটিয়ে দিতে চায় না। যদি সংসারে বনিবনা না হয়. তাহলে তারা দ্রæত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ডিভোর্সের মত অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত হলেও এই কষ্টকর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তাই ঢাকায় গত বছরে ডিভোর্সের জন্য আবেদনপত্র জমা পড়ে ১৩ হাজার ২৮৮টি। এই বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন মূলত নারীদের দিক থেকেই পড়েছে বলে ঢাকার সংবাদপত্রে লেখা হয়েছে। প্রকাশিত খবরটি সংক্ষিপ্তাকারে এখানে প্রকাশিত হলোঃ
এক নারী ঢাকার মানবজমিনকে বলেন, বিয়ের দুই বছর পর থেকে সংসারে অশান্তি শুরু হয়। দুই পরিবার মিলেই আমাদের বিয়েটা হয়েছিল। বর্তমানে দুইজনই আমরা পড়াশোনা করছি। শ্বশুরবাড়িতে সবকিছু আছে কিন্তু তাদের সংসারে আর্থিক সংকট কাটে না। আমার শ্বশুর অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক। তিনি অসুস্থতার কারণে এখন বিশ্রামে থাকেন। আমার স্বামী খামখেয়ালিভাবে চলাচল করে। তারা দুই ভাই। সেও পড়াশোনা করে। এমন একটা পর্যায় চলে এসেছে যে জমানো টাকাও নেই, এদিকে তেমন কোনো বড় ইনকাম নেই।
সংসারে বড় হওয়ায় এই জিনিসগুলো আমার স্বামীর একটা মানসিক সমস্যা তৈরি করে ফেলেছে। সে এখন আমাকেও সহ্য করতে পারছে না। সারাদিন শুধু বলে চলে যাও, তোমাকে আমি ছেড়ে দিয়েছি। কিছু নিয়ে আমি যদি নরমালি কথা বলি সেটাও তার পছন্দ হয় না। বর্তমানে আমাদের মধ্যে বোঝাবুঝিটা একদম নেই। সবসময় কথায় কথায় ভুল বোঝাবুঝিটা থেকে যায়। সে আমাকে বলছে ডিভোর্স দিতে। আমিও ফাইনালি ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। কাগজপত্র সব রেডি। দু’জনার যে যার মতো মোবাইল ফোন হাতে রাতের দীর্ঘ সময় কাটে। অর্থ সংকট ছাড়া এর পেছনে ইন্টারনেট, ফেসবুকও কম দায়ী নয়। দুইজনে একই বেডে শুয়ে আছি অথচ ফোন হাতে নিয়ে। কখনো ফেসবুক, না হয় ইউটিউব, না হয় কানের মধ্যে হেডফোন দিয়ে গেম খেলছি বা গান শুনছি। আমার মনে হয় ফোন, ফেসবুক এসব যদি না থাকতো তখন সব কষ্ট ভুলে সম্পর্কের জায়গাটা ওই মুহূর্তগুলোতে সুন্দর হতে পারতো।
এই রকম হাজার হাজার নারী-পুরুষ এখন এভাবে নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হয়ে বুঝে বা না বুঝে তালাকের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে মোট ১৩ হাজার ২৮৮টি তালাকের আবেদন এসেছিল। এরমধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে তালাকের আবেদন সংখ্যা ৭ হাজার ৬৯৮টি। পক্ষান্তরে উত্তর সিটি করপোরেশনে ৫ হাজার ৫৯০টি তালাকের আবেদন পড়েছে। বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে প্রায় সব আবেদনেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হওয়ার কথা বলা হয়েছে। অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে পারিবারিক কলহ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, যৌতুক, মাদক সেবন করে নির্যাতন, প্রবাসী স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা, যৌন অক্ষমতা, সন্দেহ, উদাসীনতা, ব্যক্তিত্বের সংঘাতসহ নানা অভিযোগ। এদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস জরিপ অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে তালাকের হার বেড়ে প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৪টি হয়েছে। ২০২১ সালে এই হার ছিল প্রতি হাজারে ০ দশমিক ৭টি। এরমধ্যে গ্রামে তালাকের প্রবণতা বেশি বেড়েছে। গ্রামাঞ্চলে প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৫টি আর শহরে হাজারে একটি বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের এক তথ্যে দেখা গেছে, নারীরা তালাকের সংখ্যায় বেশি। সেই তুলনায় পুরুষরা বিচ্ছেদের বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন কম। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) হিসাবে দেখা গেছে, ২০১১ সাল থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় ১২ বছরে করপোরেশনের বিভিন্ন অঞ্চলে মোট ৫৮ হাজার ৩০টি তালাকের আবেদন পড়েছে। এরমধ্যে ৩৭ হাজার ৭৯২টি আবেদন করেছেন নারীরা। আর পুরুষরা করেছেন ১৮ হাজার ৬৬৪টি। অপর দিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) গত চার বছরে তালাকের সংখ্যা ২৭ হাজার ৬৪৮টি। ২০১৯ সালে মোট তালাক ৬ হাজার ৩৬০টি।
২০২০ সালে মোট তালাক ৬ হাজার ৩৪৫টি। এরমধ্যে নারী কর্তৃক ৪ হাজার ৪২৮টি এবং পুরুষ কর্তৃক ১ হাজার ৯১৭টি। জানুয়ারিতে ৫২৮টি, ফেব্রæয়ারিতে ৪৫২টি, মার্চে ৪৯২টি, মে মাসে ১১৩টি, জুন ৫৪১টি, জুলাই ৮৭৮টি, আগস্টে ৪৪৮টি, সেপ্টেম্বরে ৭৫৫টি, অক্টোবরে ৬৪২টি, নভেম্বরে ৬৫৪টি, ডিসেম্বরে ৮৪২টি। ২০২১ সালে মোট তালাকের সংখ্যা ৭ হাজার ২৪৫টি। এরমধ্যে নারী কর্তৃক ৫ হাজার ১৮৩টি এবং পুরুষ কর্তৃক ২ হাজার ৬২টি জানুয়ারিতে ৫২০টি, ফেব্রæয়ারিতে ৫২৫টি, মার্চে ৬৫৫টি, এপ্রিল ৬০২টি, মে মাসে ৩৬২টি, জুন ৮৬৬টি, জুলাই ২৯৪টি, আগস্টে ৭১২টি, সেপ্টেম্বর ৮১৪টি, অক্টোবরে ৩৬১টি, নভেম্বরে ৭৫৫টি, ডিসেম্বরে ৫৭৯টি।
২০২২ সালে মোট তালাক ৭ হাজার ৬৯৮টি। এরমধ্যে নারী র্কর্তৃক ৫ হাজার ৩৮৩টি এবং পুরুষ কর্তৃক ২ হাজার ৩১৫টি। চলতি বছরে জানুয়ারিতে ৭০০টি, ফেব্রæয়ারিতে ৫৩২টি, মার্চে ৬৫৩টি, এপ্রিলে ৪৮২টি, মে মাসে ৬৫১টি, জুন মাসে ৭০৭টি, জুলাই ৪২৭টি, আগস্টে ৮৩২টি, সেপ্টেম্বরে ৫৬৭টি, অক্টোবরে ৯৩৩টি, নভেম্বরে ৬৫৮টি, ডিসেম্বরে ৫৫৬টি। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত মোট তালাক ৩ হাজার ৫৩২টি এরমধ্যে নারী কর্তৃক ২ হাজার ৬২২টি এবং পুরুষ কর্তৃক ৯১০টি। এ বছরে জানুয়ারিতে ৬৫০টি, ফেব্রæয়ারিতে ৫৬৪টি, মার্চে ৪৭৬টি, এপ্রিলে ৪২৮টি, মে মাসে ৭০৬টি, জুনে ৭০৮টি।
দুই সিটিতে নারীদের করা আবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়া, ভরণ- পোষণ না দেয়া, স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধকরণ, কাবিন না হওয়া, স্বামীর মাদকাসক্তি, পুরুষত্বহীনতা, নির্যাতন, যৌতুক, মানসিক পীড়ন, পরকীয়া, আর্থিক সমস্যা ও ব্যক্তিত্বের সংঘাতের কথা বলা হয়েছে। আর পুরুষরা পরকীয়া, বেপরোয়া জীবনযাপন, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সন্তান না হওয়া, অবাধ্য হওয়া, টিকটকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবাধ বিচরণ করা, ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী না চলাসহ বিভিন্ন কারণের কথা উল্লেখ করছেন। (মানবজমিন)