বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মেলিসা সুমিত্রা রায় ৩৪ বছর বয়সে ঘুরে ফেলেন জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত ১৯৩টি দেশ। ২০০৪ সালে আর্জেন্টিনা ভ্রমণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার পৃথিবী ভ্রমণ। তারপর কখনও সমুদ্রপথে, কখনও ব্যাকপ্যাক ট্যুরে, আবার কখনও একাই বেরিয়েছেন পৃথিবীর পথে।
এই স্বপ্ন জেগে দেখা
সেই এইটুকুন বয়স থেকে কতজন কত কিছুই না স্বপ্ন দেখে। আর একটু একটু করে বড় হতে হতে সেই স্বপ্ন ভুলে যেতে থাকে মানুষ। ভুলে যাই আমরাও। আর ঘুমের ঘোরেও নিজেকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখি। তারও হয় না বাস্তবায়ন। আর একটু পরিণত বয়সে এসে জেগে জেগে যে স্বপ্ন দেখি, একাগ্রচিত্তে সেই স্বপ্নের পথে হেঁটে যেতে পারলেই তা ধরা যায় অনায়াসে। আর অনেক স্বপ্নের থাকে না বাড়ি-ঘর। হুটহাট মনে আসন গেড়ে নেয়। মেলিসার পৃথিবী ভ্রমণের স্বপ্নটাও তেমনি। দিনের পর দিন এমন স্বপ্ন লালন করেননি তিনি। হুট করে এই স্বপ্ন তার মনে ঘোর লাগানো একটা আসন পেতে নেয়। তারপর সে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। বের হয় পৃথিবী ভ্রমণে।
ইতিহাসের পাতায় মেলিসা
জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র ১৯৩। এই ১৯৩টি দেশসহ মেলিসা ঘুরেছেন পর্যবেক্ষক আরও দুটি দেশ। সব মিলিয়ে ১৯৫ দেশ ঘুরে ইতিহাস গড়ে ফেলেছেন মেলিসা সুমিত্রা রায়। ভাগা ভাগা ভূ-পর্যটকদের সঙ্গে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম তুলে নিয়েছেন। তিনিই দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র নারী, যিনি ১৯৩টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ৩৪ বছর বয়সী মেলিসাকে রেকর্ডের কথা মনে করিয়ে দিতেই নিঃশব্দ একটা হাসি দিয়ে বলেন, ‘আসলে কখনও রেকর্ড করব বা ইতিহাসে নিজের নাম লিখাব- এমন পরিকল্পনা নিয়ে পৃথিবী ভ্রমণে বের হইনি। ভালো লাগা থেকেই এই পথে নামা…।’
আর্জেন্টিনা ঘোরার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার পৃথিবী ভ্রমণ। তাও ২০০৪ সালে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ঘুরতে গিয়েছিলেন আর্জেন্টিনা। তখনও স্বপ্ন মনে আসন গেড়েনি। তাই ঘুরে আসার পর চলে যায় তিন বছর। নিজের ব্যক্তিগত ব্যস্ততায় কেটে যায় সময়। ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একগাদা শিক্ষার্থীর সঙ্গে বিশাল এক জাহাজে কাটিয়ে দেন ১০০ দিন। ভাবা যায়! এত লম্বা জার্নির কথা? মূলত এ ভ্রমণটাই তাকে মায়া লাগিয়ে দেয় পৃথিবীর প্রতি। এই দীর্ঘ ভ্রমণ সারাজীবন মনে রাখবেন মেলিসা। তিনি বলেন, ‘সেই যাত্রায় ১২টি দেশ ঘুরেছিলাম। অসম্ভব ভালো লাগার দিন। এখনও মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা। এই ১০০ দিনের ভালো লাগাই আমাকে পৃথিবীর পথে পথে ঘোরার নেশা ধরিয়ে দিয়েছে।’
এক ব্যাগ নিয়ে ইউরোপ
এবারের বিরতি একটু অন্যরকম। মেলিসা আগের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তবে ব্যক্তিগত কাজের চেয়ে স্বপ্ন ধরার কাজেই যেন যত ব্যস্ততা। প্রতিনিয়ত তার কানে ডাক আসে নতুন নতুন দেশের। বেরিয়ে যেতে পা বাড়ান। কিন্তু বাধা দেয় অর্থ। এত টাকার জোগান দেবে কে? মেলিসা নেমে পড়েন কাজে। জোগাড়ও হয়ে যায় কিছু টাকা। স্নাতক শেষ করে এর মধ্যে সেই টাকায় একটা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। মানে ব্যাকপ্যাক ট্যুর দিয়ে ঘুরে ফেলেন ইউরোপ।
ভ্রমণে শোনেন বাবা হারানোর খবর
ইউরোপ ঘুরে এসে ফের মেলিসা মন দেন কাজে। চাকরি করে টাকা জমাতে থাকেন। সেই জমানো টাকায় ২০১৪ সালে ফের বেরিয়ে পড়েন। বিভিন্ন দেশ ঘুরে আসেন ভারতে। ভারত ভ্রমণে খুবই মর্মান্তিক খবর পান মেলিসা। আর তা হচ্ছে বাবা হারানোর খবর। আকাশের দেশে চলে যান মেলিসার বাবা সুভাষ চন্দ্র রায়। তার বাবার বাড়ি নেত্রকোনায়। তবে শৈশবে পড়াশোনা করতে বাবা এ ভারতেই গিয়েছিলেন। আর সেই ভারতে বসে বাবার মৃত্যুর খবর শোনেন মেলিসা। মেলিসা বলেন, ‘আমার বাবা পড়াশোনা করতে বাংলাদেশ থেকে ভারত গিয়েছিলেন। পড়াশোনা শেষে সেখানে আমার মা মিনতি রায়কে বিয়ে করে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রেই জন্ম হয় আমার। বাবা সবসময় আগলে রাখতেন। বাবার কাছ থেকেই বাংলা বলা শিখেছি।’ মেলিসার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
স্মৃতির খোঁজে নেত্রকোনায়
যুক্তরাষ্ট্রে ছুটে যান মেলিসা। চলে যায় বেশ কিছুদিন। বাবার শোক যেন তার পিছু ছাড়ে না। বাবার বলা গল্প আর বাবার শৈশবের দিন খুঁজে বেড়াতে মেলিসা মাকে নিয়ে চলে আসেন বাংলাদেশে। চাইলে আরও আগেই আসতে পারতেন। কিন্তু তার স্বপ্নের সঙ্গে জড়িয়ে রাখতে চান বাবাকে। জড়াতে চান বাবার প্রিয় বাংলাদেশকেও। মেলিসা বলেন, ‘আমার বিশ্বভ্রমণের শেষ কোথায় হবে- এই নিয়ে অনেক ভেবেছি আগে। কিন্তু বাবাকে হারানোর পর ঠিক করে নিয়েছি, আমার ভ্রমণের শেষ গন্তব্য হবে বাবার দেশ বাংলাদেশই।’ তাই তো এবার বাংলাদেশে এসে মেলিসা মাকে নিয়ে যান নেত্রকোনায়। সেখানে তাদের তেমন কোনো আত্মীয়স্বজন না থাকলেও খুঁজে পেয়েছেন বাবার বন্ধুদের। তাদের কাছে বাবার গল্প শুনেছেন। দু’দিন সেখানে থেকে বাবার বেড়ে ওঠা পথ-ঘাট দেখে প্রশান্তি খুঁজে বেড়িয়েছেন!
সিন্ধু সেচে মুক্তা আনি…
মেলিসার গুণের শেষ নেই। ভ্রমণে উপভোগ করেছেন বানজি জাম্প, স্কাই জাম্প ও স্কিইং। অ্যান্টার্কটিকায় থেকেছেন বরফের মধ্যে। সাগরে তিমি আর হাঙরের সঙ্গেও কেটেছেন সাঁতার। তিনি একজন দক্ষ স্কুবা ডাইভার। প্যাসিফিক আইল্যান্ডের সাগরতলে বিশেষ এক ডাকঘরে নেমে চিঠি পোস্ট করেছিলেন মায়ের কাছে। সেই চিঠি ঠিকঠাক পেয়েওছিলেন তার মা। ভ্রমণে মুখোমুখি হয়েছেন নানা সমস্যার। সব চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তিনি ঠিকই তার স্বপ্ন ছুঁয়েছেন বাবার দেশে এসে। প্রিয় লাল-সবুজেই যে তার স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়ে গিয়েছিলেন বাবা সুভাষ চন্দ্র রায়।