দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের হার গত ১৩ বছরে আট গুণ বেড়েছে। ২০১০ সালে স্নাতক-স্নাতকোত্তর পাশ বেকার ছিল মোট বেকারের ৪ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৫০ শতাংশ। এদিকে এক বছরের ব্যবধানে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪ শতাংশ। ২০২২ সালে উচ্চশিক্ষিত বেকার ছিল মোট বেকার জনগোষ্ঠীর ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-সহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্র।
শিক্ষাবিদরা বলেন, ‘মূলত তিনটি কারণে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। চাকরির বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা রয়েছে। কর্মের সঙ্গে শিক্ষার সংযোগ নেই। চাকরির বাজারে যে চাহিদা রয়েছে, সেই রকম জনবল আমরা তৈরি করতে পারছি না। আবার প্রতি বছর যেসব শিক্ষিত মানুষ চাকরির বাজারে যুক্ত হচ্ছেন, তাদের উপযোগী চাকরি নেই। এছাড়া শিক্ষার মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। এই কারণে উচ্চশিক্ষা এখন আর কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। তরুণরা যত বেশি পড়ালেখা করছেন, তাদের তত বেশি বেকার থাকার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ চাকরি মিলছে না।’ উচ্চশিক্ষিত বেকারের হার কমাতে কারিগরি শিক্ষা আধুনিকায়ন করে শিক্ষার্থীর হার ৬০ শতাংশে উন্নীত করার তাগিদ দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের দুই জন অধ্যাপক বলেন, উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে মোট শিক্ষার্থীর ৭০ শতাংশের বেশি কারিগরিতে পড়ালেখা করছেন।এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১২ সালে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ২০২০ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষার্থী হবে ২০ শতাংশ। ২০২৪ সালে এসে বলা হচ্ছে ১৬ শতাংশ। তবে আন্তর্জাতিক কারিগরি শিক্ষার সংজ্ঞা অনুযায়ী এই হার মূলত ৯ শতাংশ।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বছরের যে সম্মান বা অনার্স কোর্স রয়েছে, তার মেয়াদ কমিয়ে তিন বছর করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। রবিবার ঢাকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ কথা জানান শিক্ষা উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী এম আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চার বছরের অনার্স কোর্সকে তিন বছরের কোর্স করা হবে। বাকি এক বছরে ডিপ্লোমা ও কারিগরির ওপর ব্যাপকভাবে শিক্ষা দেওয়া হবে। তারপর তাদের দুটো সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। একটা অনার্সের সার্টিফিকেট দেওয়া হবে; আরেকটা ডিপ্লোমার সার্টিফিকেট দেওয়া হবে, যে সার্টিফিকেটটা ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে সবার কাছে। তার অনার্স পড়ার যে ড্রিম তাও ঠিক থাকল, আর চাকরিও তারা পাবে, অনেক ভালো চাকরি। নতুন ব্যবস্থায় কর্মসংস্থানে বেগ পেতে হবে না বলে মনে করেন বিশেষ সহকারী আমিনুল ইসলাম। তার ভাষায়, ‘একটা অভিনব অসাধারণ সিদ্ধান্ত হতে যাচ্ছে।’
সম্প্রতি বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কৌশল প্রণয়ন ও পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণ বিষয়ক টাস্কফোর্সের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক যুগে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। প্রতি ১০০ জন বেকারের মধ্যে ২৮ জনই উচ্চশিক্ষিত। চাকরির বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পড়াশোনা না থাকাই এর অন্যতম কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দেশে স্নাতক পাশ করা জনসংখ্যার হার অনেকটা অপরিবর্তিত ছিল, যেমন ২০০০ সালে এই হার ছিল ৩ দশমিক ২ শতাংশ, যা ২০১০ সালে সামান্য বেড়ে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ হয়। তবে গত এক দশকে স্নাতক পাশ করা জনসংখ্যার এই হার নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। ২০২২ সালে স্নাতক পাশ জনসংখ্যার হার বেড়ে ৯ শতাংশে পৌঁছায়। কিন্তু স্নাতক পাশ জনসংখ্যা বাড়লেও তাদের জন্য চাকরির সুযোগ সেভাবে বাড়েনি। ফলে এই শ্রেণির বেকারত্ব বেড়েছে।
গত ২ ডিসেম্বর শ্রমশক্তি জরিপ-২০২৩-এর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিএস। সেই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে ১৫ বছর এবং তদূর্ধ্ব বয়সী বেকার জনসংখ্যা ২৪ লাখ ৬০ হাজার; অর্থাৎ ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ মানুষ বেকার। যারা কর্মক্ষম, কিন্তু গত এক বছরে চেষ্টা করেও কোনো কাজের সুযোগ পায়নি। এর মধ্যে উচ্চশিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেকার মাধ্যমিক পাশ করা শিক্ষার্থীরা। বেকারত্বের হার সবচেয়ে কম অশিক্ষিতদের মধ্যে; অর্থাৎ যারা পড়াশোনা করেনি, তাদের বেকারত্বের হার মাত্র ১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ; অর্থাৎ মানসম্মত শিক্ষার অভাবে দেশে বেকারত্বের হার বাড়ছে, বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অধিক হারে বাড়ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী, যারা কর্মক্ষম এবং কোনো কাজে নিয়োজিত নয়, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ খুঁজে বেড়ায় এবং ঐ সময়ে কাজের সুযোগ পেলে সে কাজ করতে বা যোগদানে প্রস্তুত থাকে, মূলত সেসব ব্যক্তিকে বেকার হিসেবে ধরা হয়। বিবিএসও এই সংজ্ঞা ব্যবহার করে বেকারের তথ্য নির্ণয় করেছে।