১৩৫ দেশে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা ওড়ানো ভ্রমণপ্রেমী নাজমুন নাহার।
পৃথিবীর পথে পথে বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা নিয়ে ঘুরে বেড়ান নাজমুন নাহার। ইতোমধ্যে ১৩৫টি দেশ ঘোরা হয়ে গেছে তার। এর সুবাদে লক্ষ্মীপুরের গঙ্গাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করা এই নারীর নামের পাশে যুক্ত হয়েছে ‘ফ্ল্যাগ গার্ল’ পরিচয়।
ছোটবেলা থেকেই নাজমুন নাহার সাহসী ও দুরন্ত। শৈশব থেকেই তার কৌতূহলী মন ঘরে বসে থাকতো না। চেয়ার-টেবিলের পরিবর্তে তিনি পড়তে বসতেন আলো-বাতাস আর প্রকৃতির সান্নিধ্যে। বাবার কাছে থেকে গল্প শুনতেন পৃথিবী নামক এই গ্রহের। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনার সময় দেশের ৪২টি জেলায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। মূলত তখন থেকেই বিশ্বভ্রমণের নেশা পেয়ে বসে এই পর্যটককে।
২০০০ সালে প্রথমবার বিদেশ ভ্রমণের অভিযাত্রা শুরু হয় নাজমুন নাহারের। বাংলাদেশ গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশনের হাত ধরে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। গত ১৯ বছরে ১৩৫টি দেশে বাংলাদেশের পতাকা ছড়িয়ে দেওয়ায় ২০১৯ সালে বাংলাদেশ গার্ল গাইড অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে তাকে সম্মাননা দেওয়া হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষে নাজমুন নাহার বৃত্তি নিয়ে ২০০৬ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান সুইডেনে। লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করতেন এবং উপার্জিত অর্থ নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ, জর্জিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের দেশ ভ্রমণে। খরচ কমানোর জন্য বাসে বা ট্রেনে কিংবা পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতেন একদেশ থেকে অন্য দেশের সীমান্ত। এভাবেই বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত।
খালি চোখে নাজমুন নাহারের অভিযাত্রা খুব সহজ ও মসৃণ মনে হলেও মূলত তা ছিল রুদ্ধশ্বাসে ভরা আর ঝুঁকিপূর্ণ। এতোটা পথ পাড়ি দিতে নানান প্রতিকূলতা ও বিভিন্ন সময় মৃত্যুকে পর্যন্ত জয় করতে হয়েছে তাকে। কখনও কখনও উঁচু পাহাড় থেকে পড়তে পড়তে গাছের শিকল ধরে কোনোরকম বেঁচে গেছেন। এরপর মরিটানিয়ার বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে ভয়ঙ্কর ধুলিঝড়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। দুই টুকরো কাঁচা মাংস কিংবা একটি আলু খেয়ে কাটাতে হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছেন মাইলের পর মাইল। কখনও ৫৫ ডিগ্রি তাপমাত্রার তীব্র গরমে, আবার কখনও তুষার ঝড়ের বাধা পেরিয়ে এগিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আগেই পুরো পৃথিবীতে লাল সবুজ পতাকা নিয়ে ভ্রমণের জন্য নিরন্তর ছুটে চলেছেন নাজমুন নাহার। এটি পূর্ণ হলেই কিছু অর্জন করতে পেরেছেন বলে মনে হবে তার। এখন চোখে-মুখে লাল সবুজ পতাকা হাতে বিশ্বজয়ের সেই আনন্দমাখা অভিব্যক্তি। তার বিশ্বাস– ‘পৃথিবী হচ্ছে একটি বইয়ের মতো, এর পাতা উল্টিয়ে নানান অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়।’
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নানান শ্রেণির মানুষের সুখ-দুঃখের গল্প শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছে নাজমুন নাহারের। বিশেষ করে পূর্ব আফ্রিকার ইথিওপিয়া, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, সুদান ও উগান্ডার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। তার কথায়, ‘পৃথিবীতে এখনও এমন কিছু দেশ আছে যেখানে মানুষকে খুব অল্প খেয়েপড়ে বেঁচে থাকতে হয়। বিদেশি কোনও পর্যটক দেখলেই তারা দূর থেকে ছুটে আসে খাবার কিংবা কাপড়ের আশায়। এমনও হয় যে, একটুকরো রুটি খেয়েই দিন পার করে দিতে হচ্ছে।’
২০১৮ সালে জাম্বিয়া সরকারের গভর্নরের কাছ থেকে ‘ফ্ল্যাগ গার্ল’ খেতাব পেয়েছেন নাজমুন নাহার। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে শ্রী চিন্ময় ওয়াননেস হার্ট সেন্টারের এসপিরেশন গ্রাউন্ডে তাকে দেওয়া হয় পিস টর্চ অ্যাওয়ার্ড ও ডটার অব দ্য আর্থ উপাধি। এছাড়া তার ঝুলিতে আছে নিউইয়র্কে ৩৩তম ফোবানা সম্মেলনে পাওয়া মিস আর্থ কুইন অ্যাওয়ার্ডসহ অনেক পুরস্কার।
বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প নিয়ে কিছুটা হতাশ নাজমুন নাহার। তিনি মনে করেন, এতো মনোরম প্রাকৃতিক ও সম্ভাবনাময় দেশ হওয়ার পরও সদিচ্ছা আর আন্তরিকতার অভাবে পর্যটন খাতে এগোতে পারছে না বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নতা ও পর্যটকদের নিরাপত্তার দিকে জোর দেওয়ার পরামর্শ তার।