যদি আমি হীরার সন্ধান না করি, তাহলে আমার অসুস্থ লাগে। কথাটি বলছিলেন ভারতের মধ্যপ্রদেশের ৬৭ বছর বয়সি প্রকাশ শর্মা। তার কণ্ঠে তখন আবেগের সুর।
প্রকাশ শর্মার বাড়ি মধ্যপ্রদেশের পান্না জেলায়। তিনি হীরার খনির শ্রমিক। গত ৫০ বছর ধরে এ পেশায় রয়েছেন তিনি। তার কণ্ঠে আবেগের কারণ হয়তো এটাই।
ভারতের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর একটি পান্না। এ জেলার বেশিরভাগ বাসিন্দাই দরিদ্র। এখানকার আরও বড় বড় সমস্যার মধ্যে রয়েছে সুপেয় পানির অভাব, বেকারত্ব। এ জেলা বিখ্যাত এখানকার হীরার খনির জন্য।
এখানকার বেশিরভাগ খনি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হলেও রাজ্য সরকার প্রতি বছর নামমাত্র মূল্যে সম্ভাব্য খনি হিসেবে জমির ছোট ছোট অংশ লিজ দেয়। একসময় হীরার খনির কারণে পান্না জেলার ব্যাপক নামডাক থাকলেও বছরের পর বছর ধরে অতিরিক্ত খননে কারণে হীরার মজুদ কমে গেছে। তা সত্ত্বেও এখানকার শ্রমিকরা চোখে-মুখে আশা নিয়েই তাদের হীরা অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
শ্রমিকরা খনন করে যেসব হীরা পান, সেগুলো তাদের সংশ্লিষ্ট সরকারি অফিসে জমা দিতে হয়। এ অফিস হীরাগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি সেগুলো নিলামে বিক্রি করে।
খনিতে কাজের জন্য শ্রমিকদের ফি হিসেবে সরকারকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিতে হয়। সেই অর্থসহ অন্যান্য কর কেটে নিয়ে শ্রমিকদের যে পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয়, তা যৎসামান্য বললেই চলে। অর্থাৎ হীরার খনির মজুর হয়েও তাদের ভাগ্যে যেন কানাকড়ির বেশি জোটে না।
শর্মা জানান, ১৯৭৪ সালে স্কুলের পাঠ চুকিয়ে তিনি হীরার খনিতে কাজ শুরু করেন। তার বাবাও এখানে কাজ করতেন। হীরা অনুসন্ধানে তার বাবা বেশ দক্ষ ছিলেন। এ কারণে গ্রামে আলাদাভাবে তার নামও ছিল।
একদিন শর্মার বাবা ছয় ক্যারেটের হীরা খুঁজে পেয়েছিলেন। যা থেকে শর্মার মনেও হীরা খোঁজার প্রতি আগ্রহ জন্মে। শর্মা বলেন, ‘আমি কম বেতনের সরকারি চাকরি না করে বরং এ কাজটি চালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম।’
শর্মার মতোই হাজারও যুবক-বৃদ্ধ রয়েছেন, যারা দরিদ্রতার চক্র থেকে মুক্তির আশায় বছরের পর বছর ধরে হীরার খনিতে মজুরের কাজ করছেন। তাদের কেউ কেউ বংশ পরম্পরায় যুক্ত হয়েছেন এ কাজে।
প্রতিদিন ভোরে খনিতে শ্রমিকদের কাজ শুরু হয়। সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলে হীরা খোঁজার কাজ। কাজটিতে বেশ শারীরিক পরিশ্রম রয়েছে। কিন্তু, এ কাজ একটি সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় পান্নার মানুষের কাছে তাদের জীবনের অন্তর্নিহিত অংশে পরিণত হয়েছে।
৫৮ বছর বয়সী শ্রমিক শ্যামলাল জাতবের পরিবার দীর্ঘদিন ধরে এ পেশার সঙ্গে জড়িত। তার দাদা হীরার খনিতে কাজ করতেন। আর এখন তার ছেলে এ কাজ করছেন। পাশাপাশি পড়ালেখাও চালিয়ে যাচ্ছেন তার ছেলে।
শ্যামলাল জানান, তার দাদা বহু হীরা খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু তখন এসব হীরা বিক্রি খুব বেশি অর্থ পাওয়া যায়নি। অথচ এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন কিছু কিছু পাথর লাখ লাখ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে।
খনিতে কাজ করা সৌভাগ্যবান কয়েকজন শ্রমিকের মধ্যে রাজা নামের একজন রয়েছেন। গত জুলাই মাসে তিনি ১৯.২২ ক্যারেটের একটি বড় হীরা খুঁজে পান। ওই সময় তিনি ঋণে জর্জরিত ছিলেন। পরে সরকারি নিলামে তিনি প্রায় আট মিলিয়ন রুপিতে (৯৫ হাজার ১৭৮ মার্কিন ডলার) হীরাটি বিক্রি করেন।
হীরা শিল্পে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে ভারতের। ১৮ শতকে ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকায় হীরার খনির সন্ধানের আগ পর্যন্ত তিন হাজারেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের একমাত্র হীরার উৎস ছিল দেশটি।
রাজ্য সরকারের তত্ত্বাবধানে ন্যাশনাল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এনএমডিসি) পরিচালিত পান্নার মাঝগাঁও খনি হীরা উৎপাদনের একমাত্র সংগঠিত উৎস। এটি ১৯৬৮ সাল থেকে খনন কাজ পরিচালনা করছে এবং চলতি বছর পর্যন্ত ১.৩ মিলিয়ন ক্যারেটেরও বেশি হীরা উত্তোলন করতে সক্ষম হয়েছে।
যদিও পান্নাতে যে কেউ হীরা খননের কাজ করতে পারেন, তাও আবার নামমাত্র মূল্যে, তবে বেশিরভাগ খননকারীই হীরা বিক্রির ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ম-নীতির ধার ধারেন না।
জেলার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা বিবিসি হিন্দিকে জানান, অবৈধভাবে হীরা বিক্রির জন্য বড় একটি মার্কেট রয়েছে। তবে সেই মার্কেটে ঠিক কি পরিমাণ লেনদেন হয়, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কালোবাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, কর এড়াতে আর দ্রুত অর্থ পেতেই লোকেরা হীরা বিক্রির জন্য অবৈধ পথ বেছে নেয়।
তিনি বলেন, ‘যদি তারা সরকারি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, তাহলে কেবল নিলামে হীরা বিক্রি হওয়ার পরই তাদের অর্থ দেওয়া হয়। এতে কখনো কখনো কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।’
পান্নার খনি কর্মকর্তা রবি প্যাটেল বলেন, কর্তৃপক্ষ অবৈধ বিক্রি ঠেকাতে ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে যারা অবৈধ উপায়ে হীরা বিক্রি করছে, প্রকৃতপক্ষে তাদের শনাক্ত করা কঠিন।
সরকারি নিলামের জন্য জমা করা হীরার সংখ্যাও দিন দিন কমছে বলে স্বীকার করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ২০১৬ সালে সরকারি অফিসে যেখানে এক হাজার ১৩৩ টি হীরা এসেছিল, সেখানে গত বছর এসেছে মাত্র ২৩টি।
পান্নার হীরা পর্যবেক্ষণকারী কর্মকর্তা অনুপম সিং বলেন, খননে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার কারণে হীরার সংখ্যা কমেছে।
পান্না টাইগার রিজার্ভ এলাকায় ৫০টিরও বেশি বাঘ রয়েছে। বাঘের জনসংখ্যা সংরক্ষণের প্রচেষ্টা হিসেবে বন বিভাগ কিছু এলাকা সংরক্ষিত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যে কারণে সেসব এলাকায় হীরার জন্য সন্ধান চালানো যাচ্ছে না।
২০২০ সালে হীরার খনিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন প্রকাশ মজুমদার। তিনি একবার ২.৯ মিলিয়ন রুপি মূল্যের হীরা খুঁজে পেয়েছিলেন। এরপর তার ভাগ্যেও পরিবর্তন আসে। পরিবারের জন্য তিনি একটি কংক্রিটের বাড়ি করেছেন। তিনি এখন গ্রামপ্রধান।
জীবনে আরও অনেক দূর এগোতে চান প্রকাশ মজুমদার। আর তাই হীরার খনিতে নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এখনও।