শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:১৯ অপরাহ্ন

হিমালয়ের ছোট্ট গ্রাম সালদাং

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

সুশিং লাদাং মনাস্ট্রিতে থাকার  ব্যবস্থা হয়েছে। কর্নালি জোনের ডোলপা জেলার সালদাং গ্রামের প্রধান ধর্মীয় গুরু নিংমাপা সুশিং লাদাংয়ের পারিবারিক মনাস্ট্রি এটি। বেলা সাড়ে ৩টা নাগাদ এসে পৌঁছেছি এই গ্রামে। এই গ্রামের আগে যে গ্রামটি পেয়েছিলাম, তার নাম বিজের। সেটাও দিন দুই আগের কথা। আজ ৫ হাজার মিটার কঠিন একটি পর্বতের পাশ অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। দূর থেকে নিচের দিকে যখন এই গ্রাম দেখতে পাই, ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল। চারপাশে ধূসর পাথুরে পর্বত। তার ভাঁজে ভাঁজে মেঘ জমে আছে। সেই মেঘের নিচে ছোট্ট গ্রাম। তার শস্যখেত দূর থেকে দেখে মনে হলো এক টুকরো সবুজের স্বর্গ!

গ্রামে ঢুকে প্রথমে একটি বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় চাইলাম। কিন্তু বাড়ির মালকিন রাজি হলেন না। পরে আরও একটি বাড়িতে গেলাম। সেখানেও থাকার সুযোগ হলো না। তবে বাড়ির মালিক একটি বাড়ি দেখিয়ে বললেন, ‘ওই বাড়ি আমাদের গ্রামের প্রধান লামার। সেখানে যাও। তিনিই থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন।’ আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে সেই বাড়ির উদ্দেশে পা বাড়ালাম। গ্রামের ভেতর দিয়ে কিছুটা নিচে নেমে এলাম। বাড়িতে ঢোকার দরজা খোলাই ছিল।

আমি বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই আট-দশ বছরের একটি ছেলে কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে এল, কিন্তু কিছু বলল না। আবার দৌড়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল। আমি বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে বড় কাউকে খুঁজছি। বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না। ঘরের ভেতর থেকে সেই ছেলের সঙ্গে এক বয়স্ক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। আমি তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম, তাশি দিলেক। তিনিও আমাকে তাশি দিলেক বলে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। বললাম, আমার নাম শাকিল, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমি একজন পর্বতারোহী, গ্রেট হিমালয় ট্রেইল অভিযান করছি। সেই হিলশা থেকে ট্রেকিং শুরু করেছি। আজকে আপনার গ্রামে একটু থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন? তিনি মুচকি হেসে বললেন, ‘অবশ্যই।

তুমি আমার বাড়িতেই থাকতে পারো, যদি তোমার সমস্যা না হয়।’ আমি আনন্দের সঙ্গে জানালাম, ‘না না, আমার কোনো সমস্যা নেই। আমাকে একটু থাকার জায়গা দিলেই হবে।’ আমাকে তিনি তাঁর ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন। এই গ্রামের ঘরগুলোর আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে অন্য সব গ্রাম থেকে। এখানে যেহেতু বড় বড় গাছ কিংবা পাথর নেই, তাই সেগুলোর ব্যবহার কম। এখানে নুড়িমিশ্রিত মাটি দিয়ে ঘরগুলো তৈরি। প্রতিটি বাড়িতে একটি করে বড় ঘর। এই একটি ঘরেই অনেক কক্ষ। প্রায় প্রতিটি ঘরই দোতলা।

নিচতলায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা হয়। আর ওপরের ঘরগুলোতে থাকার ব্যবস্থা। অনেক পুরোনো কাঠের দরজা ঠেলে ঘরের ভেতর ঢুকলাম। নানা জিনিসপত্র রাখা আছে চারপাশে। দেখে মনে হচ্ছে একটি গোডাউন। ওপরের কক্ষে যাওয়ার জন্য একটি গাছের গুঁড়ি রাখা আছে। এই গুঁড়ি সিঁড়ির মতো খাঁজকাটা। এই খাঁজকাটা গাছের গুঁড়ি ব্যবহার করে ওপরে উঠে এলাম।এখানে চারটা কক্ষ। একটা কক্ষে তিনি ও তাঁর স্ত্রী থাকেন। ছোট একটি কক্ষে তাঁর দুই নাতি থাকে। একটি বড় রান্নাঘর। আর সব থেকে বড় যে কক্ষ, সেটি হলো তাঁদের পারিবারিক উপাসনালয়। আমার থাকার ব্যবস্থা হলো এই উপাসনালয়ের ঘরটিতে। এই গ্রামের সবাই তিব্বতিয়ান। তারা তিব্বতিয়ান বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। বৌদ্ধ মনাস্ট্রির ভেতরে যেমন হয়, এটিও ঠিক তেমনই। কোনো কমতি নেই। আমাকে এখানে থাকতে দেওয়ায় খুব বেশি অবাক হইনি। এর আগেও এমন জায়গায় থাকার সুযোগ হয়েছে।

পুরো বিকেলটা কাটালাম গ্রামটি ঘুরে। গ্রামের একটি বাড়িতে বেশ কিছু মানুষের ভিড় দেখতে পেলাম। এগিয়ে গিয়ে দেখি একজন মৃত মানুষের সৎকারের জন্য ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে পালনীয় কাজগুলো করা হচ্ছে। পরদিন সকাল পর্যন্ত চলবে এই আনুষ্ঠানিকতা।

তারপর সকালে গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে পাহাড়ের ওপরে নিয়ে যাওয়া হবে মৃতদেহটি সৎকার করতে। এরা মৃতদেহকে কবর দেয় না কিংবা চিতায় দাহ করে না। এদের সৎকারের প্রথা অন্য রকম। মৃতদেহকে টুকরো টুকরো করে কেটে শকুন, চিলদের খেতে দেওয়া হয়!
তাদের এই প্রথার চর্চা করা হয় তিব্বত ও নেপাল-তিব্বত সীমান্তবর্তী কিছু এলাকায়।

এই প্রথাকে তিব্বতি ভাষায় ‘ঝাটর’ বলা হয়। ঝাটর অর্থ পাখিদের খাবার দেওয়া। সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে মৃতদেহটিকে প্রথমে পাহাড়ের ওপরে সৎকারের স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর লামা কয়েকজন সহযোগী নিয়ে সৎকারের উদ্দেশ্যে পূজা করতে থাকেন এবং সেখানে থাকা সন্ন্যাসীরা দেহটিকে টুকরো টুকরো করে কেটে খোলা আকাশের নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেন। তারপর সেখানে উড়ে আসে শকুনের মতো মাংসাশী পাখিরা। তারা এসে মৃতদেহটির মাংস খেয়ে ফেলে। শকুনেরা তো শুধু মাংস খেয়েই উড়ে যায়, থেকে যায় মৃতদেহের হাড়গুলো। সেগুলো এরপর হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে গুঁড়ো করে ফেলা হয়। হাড়ের চূর্ণ এরপর ময়দার সঙ্গে মিশিয়ে অন্য ছোট পাখিদের খাওয়ানো হয়। আকাশ থেকে উড়ে আসা প্রাণীদের সাহায্যে এই সৎকারের কাজ করা হয় বলেই এর নাম ‘ঝাটর’।

লামা সুশিং লাদা– এর সঙ্গে লেখক।

লামা সুশিং লাদা– এর সঙ্গে লেখক।

রাতে সুশিং লাদাং পরিবারের সঙ্গেই খাবার খাওয়া হলো। খাবারের তালিকায় ছিল ভাত, সুকুটি (শুকনো মাংস), রাই শাক, ডাল, আলু সেদ্ধ, মুলার চাটনি ও স্যুচিয়া বা তিব্বতি লবণ-চা। রাতে বেশ দীর্ঘ ও গভীর ঘুম হলো। এমন ঘুম অনেক দিন হয়নি। রাতেই ভেবে রেখেছিলাম, সেই মৃতদেহের সৎকার নিজের চোখে দেখব। তাই ভোরে ঘুম থেকে উঠেই বেরিয়ে পড়লাম মৃত ব্যক্তির বাড়ির দিকে। মৃতদেহটি নিয়ে সবাই বেরিয়ে পড়েছে। আমিও তাদের পেছনে হাঁটতে লাগলাম। সৎকারের জায়গায় পৌঁছাতে ঘণ্টাখানেক সময় লেগে গেল। এই প্রথম নিজের চোখে এ রকম একটি সৎকারপ্রথা দেখছি।

ইকরামুল হাসান শাকিল

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com