শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫৮ অপরাহ্ন

হালাল হলিডে কী? কারা কোথায় করেন হালাল হলিডে

  • আপডেট সময় বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

“আমার রোদে যেতে ভাল লাগে, আমার ভিটামিন ডি পছন্দ এবং আমি সারা বছর তামাটে রঙটা ধরে রাখতে চাই। তাই আমি সত্যিই সেসব জায়গায় যেতে চাই যেখানে গোপনীয়তার ব্যবস্থা বা আমার ছুটি কাটানোর মতো ব্যবস্থা আছে,” বলছেন জেহরা রোজ।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক এই ইনফ্লুয়েন্সার যেমন সব জায়গায় ঘুরতে যেতে চান তেমনি আবার তার মুসলিম ধর্মবিশ্বাসের প্রতিও অনুগত থাকতে চান।

এ পর্যন্ত তিনি ৩০টিরও বেশি দেশে ‘হালাল হলিডে’ বা হালাল ছুটিতে গেছেন।

আরবি হালাল শব্দটির মানে হচ্ছে, ইসলামের অনুসারী হিসেবে যা যা ধর্মে অনুমোদিত আছে। আর হালাল হলিডে হচ্ছে এমন সব জায়গায় ছুটিতে যাওয়া যেখানে মুসলিমরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও চর্চার সাথে কোনও আপস না করেই ছুটি কাটাতে পারবেন।

এখন এই হালাল হলিডের জন্য ধর্ম পালনকারী মুসলিমদের কিছু বিষয় আলাদা করে বিবেচনায় নিতে হয়, যেগুলো পূরণ যেখানে হবে সেখানেই হয়ত যান বা ভবিষ্যতেও যাবেন।

গোপনীয়তা

বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় অনুসারীর সংখ্যা বিবেচনা করলে খ্রিস্টানদের পরেই মুসলমানদের অবস্থান। আর অনেক মুসলিম দেশেই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংখ্যা বাড়ছে।

পশ্চিম ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের মুসলিমদের তাদের বাবা-মায়ের তুলনায় বাড়তি আয়ের পরিমাণ বেশি থাকে। ফলে সেটি তারা ছুটির দিন বা অবসর কাটানোয় ব্যয় করতে চায়।

অনেক অ-মুসলিম দেশে হালাল খাবার খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টকর

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,অনেক অমুসলিম দেশে হালাল খাবার খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টকর

সেজন্যই তাই হালাল পর্যটনের বাজার দিন দিন বাড়ছে, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের বিজনেস ডেইলি প্রোগ্রামকে বলেন জেহরা রোজ।

“আমার কাছে সাধারণ ছুটির দিন আর হালাল ছুটির দিনের মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে, গোপনীয়তা রক্ষার ব্যবস্থা।”

এছাড়াও হালাল হলিডেতে মুসলিম নারীদের সুইমিং পুলে নামার ক্ষেত্রে প্রচলিত বিকিনির বদলে বুরকিনি পরে পাবলিক সুইমিং পুলে নামতে দেখা যায় অনেককে।

বুরকিনি মূলত মুসলিম নারীদের জন্য তৈরি সাঁতারের পোশাক। এই সুইমস্যুটে সারা শরীর ঢেকে রাখে শুধু মুখ এবং পায়ের পাতা দেখা যায়।

জেহরা রোজ আরো বলেন যে, বেড়াতে গিয়ে সহজেই হালাল খাবার পাওয়ার সুযোগও চান তিনি।

অন্য যেকোনও জিনিসের তুলনায় এই একটি বিষয় নিয়ে সারা পৃথিবীতেই বেশিরভাগ মুসলিম পর্যটক সচেতন থাকেন – সেটি হচ্ছে খাবার।

শুকরের মাংস এবং অ্যালকোহলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে ইসলাম ধর্মে।

হেসার বলেন, তুরস্কে হালাল ছুটির দিনের অনেক সুযোগ রয়েছে কিন্তু তিনি তার পরিবারের সাথে দেশের বাইরেও ঘুরতে যেতে চান

ছবির উৎস,HACER SUCUOGLU ADIGUZEL

ছবির ক্যাপশান,হেসার বলেন, তুরস্কে হালাল ছুটির দিনের অনেক সুযোগ রয়েছে কিন্তু তিনি তার পরিবারের সাথে দেশের বাইরেও ঘুরতে যেতে চান

হালাল খাবার

তিন সন্তানের মা ৩৬ বছর বয়সী হেসার সুকুগলু এডিগুজেল ইস্তাম্বুলের বাসিন্দা।

তুরস্কের ভেতর হালাল ছুটি কাটাতে তার কোনও সমস্যা হয় না। কিন্তু তারা যখন কোনও অমুসলিম দেশে ঘুরতে যাওয়ার চিন্তা করেন তখন তাদের অনেক বেশি গবেষণা আর পরিকল্পনা করতে হয়।

“সম্প্রতি আমরা মেসিডোনিয়ায় গিয়েছিলাম। সকালের নাস্তা আমরা হোটেলেই সেরেছি।

আর দুপুরের খাবারের জন্য আমরা সেখানকার ঐতিহ্যবাহী দোকানগুলোতে গিয়েছি যেখানে অ্যালকোহল ছাড়াই খাবার পরিবেশন করা হয়।”

তিনি দিনে পাঁচবার নামাজ পড়েন এবং ইসলামি মূল্যবোধ পালনের বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকেন।

“হালাল হোটেলগুলোতে জায়নামাজ তারাই সরবরাহ করে। সাধারণ হোটেলে থাকলে আমাকে সাথে করে জায়নামাজ নিয়ে যেতে হয়,” তিনি বলেন।

“আমি অল্প কাপড় পরিহিত মানুষ হোটেলে দেখতে চাই না। যেসব মানুষেরা আমাদের বিশ্বাস ও সংস্কৃতি অনুসরণ করে, আমি তাদের সাথে আমার সন্তানদের রাখতে চাই।

আমরা তাদের সৈকতে নিয়ে যাই না, যেখানে মানুষ নগ্ন হয়ে সূর্যস্নান করে।”

হেসার নারীদের অনলাইন উদ্যোক্তা আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।

তিনি মনে করেন, পর্যটন শিল্প এখনও হালাল ছুটির সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেনি।

হেসার চান তার সন্তানরা ছুটির দিন কাটাতে গেলেও যাতে মুসলিম মূল্যবোধ পালন করে এমন মানুষদের দেখে।

ছবির উৎস,HACER SUCUOGLU ADIGUZEL

ছবির ক্যাপশান,হেসার চান তার সন্তানরা ছুটির দিন কাটাতে গেলেও যাতে মুসলিম মূল্যবোধ পালন করে এমন মানুষদের দেখে।

বড় বাজার

গ্লোবাল মুসলিম ট্রাভেল ইনডেক্স বা বিশ্ব মুসলিম পর্যটন সূচক অনুযায়ী, ২০২২ সালে হালাল পর্যটনের বাজার ২২০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ছিল।

অনেক কোম্পানি হালাল পর্যটন নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করছে।

আবার অনেকে এটিকে একটি বিকল্প হিসেবে রাখছে।

পশ্চিমা ভোক্তা শ্রেণীকে লক্ষ্য করে গড়ে তোলা বিশেষ ধরণের হোটেলের জন্য সুপরিচিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপ।

এই দেশটিতে এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হালাল পর্যটক আসতে শুরু করেছে।

“মালদ্বীপ একটি মুসলিম দেশ, আর এ কারণে শুরু থেকেই এখানে মুসলিম বান্ধব পর্যটন ব্যবস্থা রয়েছে,” বলেন দেশটির পর্যটন মন্ত্রী ড. আব্দুল্লা মাসুম।

“আর এই খাতটি খুবই দ্রুত বাড়ছে,” বলেন তিনি।

ড. মাসুম বলেন যে ‘সম্প্রদায় ভিত্তিক’ বা স্থানীয় পর্যটকদের জন্য এখন এক চতুর্থাংশ হোটেলের বিছানা আলাদা করে রাখা হয়।

মালদ্বীপ মুসলিম পর্যটকদের আকর্ষণ করতে তাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার চেষ্টা করছে।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,মালদ্বীপ মুসলিম পর্যটকদের আকর্ষণ করতে তাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার চেষ্টা করছে।

আইন অনুযায়ী, সব হোটেলে কর্মীদের নামাজের জন্য একটি মসজিদ থাকা বাধ্যতামূলক।

ড. মাসুম বলেন যে আরো বেশি পর্যটকরা এখন এই মসজিদ ব্যবহার করেন।

“অনেক রিসোর্টে এখন কক্ষ বরাদ্দ, কক্ষের নকশা আর খাবার রান্নার ক্ষেত্রে মুসলিম বান্ধব পরিবেশ রয়েছে,” তিনি বলেন।

দেশটির অর্থনীতির এক-চতুর্থাংশের বেশি পর্যটন খাতের উপর নির্ভরশীল।

পরিবর্তন

২০২৩ সালের গ্লোবাল মুসলিম ট্রাভেল ইনডেক্সে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোই প্রথম দিকে রয়েছে যাতে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছে।

এই তালিকায় মাত্র দু’টি অমুসলিম দেশ রয়েছে। এরমধ্যে সিঙ্গাপুর ১১তম এবং যুক্তরাজ্য ২০তম স্থানে রয়েছে।

আঠারোশো নিরানব্বই সালে স্থাপিত লন্ডনের পাঁচ তারকা মানের ল্যান্ডমার্ক হোটেলে এখন হালাল মাংস পরিবেশন করা হয়।

হোটেলের কর্মীদের মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

“আমাদের অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়ের পাশাপাশি অ্যালকোহলমুক্ত পানীয়ও রয়েছে। বারে আপনি অ্যালকোহলমুক্ত ককটেল পানীয় পাবেন যা খুবই জনপ্রিয়,” বলেন ম্যাগডি রুস্তম যিনি হোটেলের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিভাগের পরিচালক।

“আমাদের দু’টি প্রবেশপথ রয়েছে। হোটেলের উত্তর দিকের প্রবেশপথটি সংরক্ষিত।”

এই হোটেলটির মতো লন্ডনের অনেক হোটেল মুসলিম পর্যটকদের আকর্ষণ করতে অনেক পরিবর্তন করছে।

ছবির উৎস,MAGDY RUSTUM

ছবির ক্যাপশান,এই হোটেলটির মতো লন্ডনের অনেক হোটেল মুসলিম পর্যটকদের আকর্ষণ করতে অনেক পরিবর্তন করছে।

“মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ পরিবার বিশেষ করে নারীরা জনসমক্ষে আসতে চান না। এ কারণে তারা উত্তর দিকের প্রবেশপথ ব্যবহার করেন।”

“এখানে একটি বিশেষ লিফটও রয়েছে যেটা সরাসরি তাদের কক্ষে নিয়ে যায় যাতে কেউ তাদেরকে দেখতে না পারে।”

হোটেলের বলরুমটি বিয়ের জন্য ব্যবহার করা যায় এবং ইসলামি রীতি অনুযায়ী এটিকে নারী ও পুরুষ অতিথিদের জন্য আলাদা অংশে বিভক্ত করার সুযোগ রয়েছে।

কিন্তু এসব পরিবর্তনের জন্য অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হয়- যা মেনে নিতে রাজি ইনফ্লুয়েন্সার জেহরা রোজ।

“আমি জানি যে, সাধারণ ছুটির তুলনায় গোপনীয়তা রক্ষা করে ছুটি কাটাতে বেশি অর্থ খরচ করতে হবে,” তিনি বলেন।

“যেসব রিসোর্টে অনেক মানুষের জন্য একটি পুল রয়েছে, যেখানে শুধু আপনার নিজের জন্য কোনও পুল বা বারান্দা নেই, সেখানে বুকিং করাটা বেশ সহজ।”

“সুতরাং হ্যাঁ, আমি বলবো যে, খরচের ক্ষেত্রে অবশ্যই একটি পার্থক্য রয়েছে।”

জেহরা ৩০টিরও বেশি দেশে হালাল হলিডে বা হালাল ছুটি কাটাতে গেছেন।

ছবির উৎস,ZAHRA ROSE

ছবির ক্যাপশান,জেহরা ৩০টিরও বেশি দেশে হালাল হলিডে বা হালাল ছুটি কাটাতে গেছেন।

বিবিসি

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com