প্রথমে ফেসবুকে বন্ধুত্ব ও কথোপকথন, তারপর ভিডিও কলে ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতা; এরপর ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতার ভিডিও চিত্র সম্পাদনা করে নানাভাবে প্রতারণা এবং দীর্ঘমেয়াদে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া— ধারাবাহিক এ কর্মযজ্ঞ চালান একজন সুন্দরী নারী আর এর শিকার হন ধনাঢ্য ও খ্যাতনামা ব্যক্তিরা। ঘটনার প্রকৃতি বলে, এটা অনেকটা অতীতের ‘হানি ট্র্যাপ’-এর মতো। অতীতে গুপ্তচরবৃত্তির কাজে ‘হানি ট্র্যাপ’ (Honey Trap) বা সুন্দরী নারীদের দিয়ে ফাঁদ তৈরি করা হতো।
বিশ্বে এমন অপরাধের ঘটনা দিনদিন বেড়ে চলেছে। পাশের দেশ ভারতে এমন প্রতারণার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রা পেয়েছে এ অপরাধ। মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে ভারতীয় সুন্দরী তরুণীরা বাংলাদেশিদের এ ‘মধু ফাঁদে’ ফেলছেন। দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, স্বনামধন্য সাংবাদিক ও সরকারি কর্মকর্তারা এ ফাঁদে পা দিয়ে খুইয়েছেন লাখ লাখ টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে টাকার অঙ্ক কোটি ছুঁয়েছে।
যৌনতা বা শারীরিক সম্পর্কের প্রলোভন দেখিয়ে ‘হানি ট্র্যাপে’র মতো প্রতারণার ফাঁদে পা দেওয়া কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। কীভাবে তারা এ ফাঁদে পা রাখেন সে বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।
বাংলাদেশ পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ সম্প্রতি ভয়ংকর একটি তথ্য দিয়েছে। সেটি হলো- গত এক বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৭০টির মতো হানি ট্র্যাপের ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের এপ্রিল, মে ও জুন মাসে এমন ঘটনা ঘটেছে ৩০টির মতো। প্রতিটি ঘটনাই ঘটানো হয়েছে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য থেকে। চাতুর্যপূর্ণ এ ফাঁদে পা দিয়ে ২০ লাখ থেকে সর্বোচ্চ দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত খুইয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভারতীয় এক সুন্দরী তরুণীর পাতা ফাঁদে পা দিয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকা খুইয়েছেন দেশের স্বনামধন্য এক ব্যবসায়ী, যিনি ব্যবসার পাশাপাশি রাজনীতিও করেন। যৌন প্রলোভনের এমন ফাঁদে পা দিয়ে আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও আইনজীবী। এমনকি দেশের স্বনামধন্য সাংবাদিকের নামও রয়েছে এ তালিকায়। লোকলজ্জা এবং সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে কেউ এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না। মামলা করারও সাহস দেখাচ্ছেন না।
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধান এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্রতারণার ফাঁদটি পেতেছে মূলত ভারতীয় সাইবার অপরাধীদের একটি চক্র। এ চক্রে সে দেশের নারী-পুরুষ ও বাংলাদেশের এজেন্টসহ প্রায় ৫০০ সদস্য রয়েছেন। শুধু ভারতেই রয়েছে ১৫০ জনের মতো সদস্য। বাকিরা বাংলাদেশি, তারা ভারতীয়দের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন।
সাধারণত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিত্তশালী, ব্যবসায়ী, ভিআইপি ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনকে হানি ট্র্যাপে ফেলেন প্রতারকরা। মূলত তথ্য ও অর্থ হাতিয়ে নিতে এ পন্থা অবলম্বন করেন তারা। তবে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তথ্য নয়, মোটা অঙ্কের অর্থ পেতে সরকারি কর্মকর্তা, সেলিব্রিটি সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের ফাঁদে ফেলেন ভারতীয় তরুণীরা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, এ ফাঁদে সবচেয়ে বেশি পা দিয়েছেন সরকারি কর্তারা। তারা প্রত্যেকেই বিবাহিত। মোটা অঙ্কের অর্থ খোয়ালেও তারা মামলা করতে চান না। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাইবার ক্রাইম বিভাগে লিখিত অভিযোগ করে জানান। অনেকে আবার ব্যক্তিগতভাবে সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তাদের মৌখিকভাবে ব্ল্যাকমেইলের তথ্য জানান।
গত এক বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৭০টির মতো হানি ট্র্যাপের ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের এপ্রিল, মে ও জুন মাসে এমন ঘটনা ঘটেছে ৩০টির মতো। প্রতিটি ঘটনাই ঘটানো হয়েছে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য থেকে। চাতুর্যপূর্ণ এ ফাঁদে পা দিয়ে ২০ লাখ থেকে সর্বোচ্চ দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত খুইয়েছেন ভুক্তভোগীরা
এ বিষয়ে ডিএমপির সাইবার ক্রাইম বিভাগের এক বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ব্ল্যাকমেইলের শিকার হওয়ার পর ভুক্তভোগীরা ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে বিষয়টি সুরাহা করতে বলেন। অনেক উঁচু মহল থেকে ফোন করান। রেস্টুরেন্ট বা হোটেল লবির মতো নিরাপদ স্থানে আমাদের বিষয়গুলো জানান। তবে, তারা যেহেতু মামলা করতে চান না সে কারণে অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে ঘটনাগুলোর তদন্ত করতে হয়।
কাউন্টার টেররিজমের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘গত তিন মাসে সিটিটিসির কাছে কমপক্ষে ২০টির মতো হানি ট্র্যাপের ঘটনা এসেছে। এগুলোর মধ্যে দেশের উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষও রয়েছেন। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে চক্রগুলো বাংলাদেশি নাগরিকদের সহায়তায় এ সিন্ডিকেট পরিচালনা করে। তাদের সংখ্যা প্রায় ৫০০।’
সূত্র: ঢাকা পোস্ট