তার এক ছাত্র সোসিওলজির উপর অনলাইন কোর্স করার সময় ‘অস্ট্রেলিয়াতে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার’ এর উপর এক অ্যাসাইনমেন্ট করতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া কে দেশ হিসেবে উল্লেখের কারণে অ্যাসাইনমেন্টের ওই অংশে প্রফেসর তাকে শূন্য নম্বর দিয়েছিলেন। সেই ছাত্র পরে লাইব্রেরি থেকে রেফারেন্স দিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে দেশ হিসেবে বলার পরেও প্রফেসর অস্ট্রেলিয়াকে শুধু একটি মহাদেশ হিসেবেই তার মতামত ব্যক্ত করেন।
এই নিয়ে এই বছরের ফেব্রয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তুমুল সমালোচনার কারণে শেষ পর্যন্ত প্রফেসর চাকরিটাই হারান। তাই মাঝেমাঝেই আমি ইউটিউব এ যেয়ে আমার ভূগোল জ্ঞানকে একটু ঘষামাজা করে নেই। কারণ বলা তো যায় না কখন কোন দেশকে মহাদেশ আর মহাদেশকে দেশ বলে ফেলি!
তবে যাই হোক, অস্ট্রেলিয়া একটি দেশ এবং একটি মহাদেশ। হাজারো দ্বীপের দেশ অস্ট্রেলিয়া। জিও সায়েন্স অস্ট্রেলিয়ার তথ্য অনুযায়ী, সেখানে ৮২২২টি দ্বীপ রয়েছে। রাজধানী ক্যানবেরা হলেও সিডনি অস্ট্রেলিয়ার বৃহত্তম শহর। সিডনি অপেরা হাউস এবং পৃথিবীর বিখ্যাত প্রবাল প্রাচীর ‘গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের’ জন্য অস্ট্রেলিয়া বিখ্যাত।
বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে অস্ট্রেলিয়া প্রায় ৫২ গুণ বড়। কিন্তু জনসংখ্যা মাত্র আড়াই কোটি। প্রায় ৬০ হাজার বছর আগে থেকেই এখানে আদিবাসী জাতিগুলো প্রথম বসতি স্থাপন করে। অস্ট্রেলিয়ার সবাই বেশ সম্মানের সাথে আদিবাসীদের অবদান স্মরণ করে থাকে। অস্ট্রেলিয়ানরা অসি নামেও পরিচিত। এটি একটি উন্নত সমৃদ্ধশালী দেশ। এখানে মানুষের জীবনমান অনেক উন্নত। ক্রিকেট খেলার কারণেও সারা বিশ্বে অনেক জনপ্রিয়।
অভিবাসীদের জন্যও অস্ট্রেলিয়া একটি পছন্দের গন্তব্য। প্রতিবছর অনেক বাংলাদেশি অস্ট্রেলিয়াতে অভিবাসী হিসেবে আসেন। তবে যত দিন যাচ্ছে অভিবাসী হওয়ার প্রক্রিয়া ততই জটিল হচ্ছে। তবে অভিবাসী হিসেবে আসতে চাইলে এখনও অনেক পথ খোলা আছে। বিভিন্ন ধরনের যোগ্যতার জন্য ভিন্ন ভিন্ন ভিসার ব্যবস্থা আছে।
অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণপিপাসুদের জন্য একটি জনপ্রিয় দেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ এখানে বেড়াতে আসে। অস্ট্রেলিয়াতে ৬টি অঙ্গরাজ্য আছে : কুইন্সল্যান্ড, নিউ সাউথ ওয়েলস, সাউথ অস্ট্রেলিয়া, তাসমানিয়া, ভিক্টোরিয়া, ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া। আমার সব অঙ্গরাজ্য এখনো বেড়ানো হয়নি। আমি কুইন্সল্যান্ড আর নিউ সাউথওয়েলস ঘুরেছি। কিন্তু সব আকর্ষণীয় জায়গায় এখনো যাওয়া হয়নি। হয়তো ভবিষ্যতে যাব।
বিভিন্ন ভিসার পাশাপাশি ভ্রমণ ভিসায় অস্ট্রেলিয়াতে আসা যায়। মনে হতে পারে অস্ট্রেলিয়াতে আসা অনেক কঠিন। কিন্তু ভ্রমণের জন্য প্রতি বছর অস্ট্রেলিয়া অনেক ভিসা দেয়। অস্ট্রেলিয়ার অনুমোদিত ভিসা সেন্টারে গিয়ে তাদের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ও সঠিক কাগজপত্র জমা দেওয়ার মাধ্যমে আপনিও ভিসা পেতে পারেন। দরকার শুধু একটু ধৈর্য আর ইচ্ছা। একবার আবেদন করে দেখেনই না! আপনিও পেয়ে যেতে পারেন ভ্রমণ ভিসা। মনে রাখবেন, অস্ট্রেলিয়া হচ্ছে পর্যটক বান্ধব দেশ। যত লোক ভ্রমণ করবে, ততই তাদের আয়। তাই তারা চায় ভিসা দিতে।
যাই হোক, একেকটা অঙ্গরাজ্যের সৌন্দর্য্য একেক রকম। আগে থেকে পরিকল্পনা করে নিলে অল্প খরচেই আপনি অঙ্গরাজ্যগুলো ভ্রমণ করতে পারবেন। প্রায় সব অঙ্গরাজ্যেই বাংলাদেশিদের দেখা পাবেন। এখানকার বাংলাদেশিরা দেশ থেকে কেউ আসলে অনেক আপন করে নেয়। কারণ বাংলাদেশি অভিবাসীরা তো সবসময় তাদের পরিবারের মানুষদের অভাব বোধ করেন। তাই দেখা হয়ে গেলে কিংবা চিনতে পারলে কথা বলবেন। আপনারও ভালো লাগবে, তাদেরও লাগবে।
অস্ট্রেলিয়ার আইন খুব কঠিন এবং সবাইকে তা মেনে চলতে হয়। সেটা সবার জন্য সমান। কিছুদিন আগে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুলকে ২০১৭ সালে সিডনিতে পানিতে করে ডিঙিতে যাওয়ার সময় লাইফ জ্যাকেট না পড়ার জন্য ২৫০ ডলার জরিমানা দিতে হয়। তাই অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণের সময় একটু খেয়াল রাখতে হবে, যাতে নিয়মানুযায়ী সব করা হয়। তবে ভয়ের কিছু নেই।
যাই হোক, আজকে কুইন্সল্যান্ড এর বেড়ানোর অভিজ্ঞতার কথা বলবো। অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য হচ্ছে কুইন্সল্যান্ড। কুইন্সল্যান্ডের রাজধানীর নাম ব্রিসবেন। এই শহর ‘সান শাইন স্টেট’ নামেও পরিচিত। কুইন্সল্যান্ড এর লোকসংখ্যা ৫০ লাখের মত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি বলা চলে কুইন্সল্যান্ডকে। এখানে পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি যেমন ‘দ্য ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ড’ আছে। সারা বিশ্ব থেকে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করতে আসে কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই শহর জুড়ে বহুমুখী সংস্কৃতির চর্চা সারাবছর লেগেই থাকে। এই রাজ্যের আয়ের একটা বড় অংশ আসে বিদেশি ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ থেকে।
ব্রিসবেনের ‘সাউথ ব্যাঙ্ক’ হচ্ছে একটা জনপ্রিয় জায়গা। অনেককিছুর পাশাপাশি এখানে মানুষের বানানো সমুদ্র সৈকতের মতো জায়গা আছে যেখানে বাচ্চা থেকে শুরু করে বয়স্করা পর্যন্ত পানিতে নেমে সাঁতার কাটতে পারে। দেখলে বোঝাই যাবে না যে এটা একটা বানানো বিচ। একদম ফ্রি। তাছাড়া ব্রিসবেনে শত শত পার্ক আছে। আপনি যেখানেই যান না কেন পাশেই কোথাও না কোথাও পার্ক খুঁজে পাবেন। ইচ্ছামতো বিশ্রাম নিতে পারবেন।
বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন এবং বৃহৎ ‘কোয়ালা’ (একধরনের ভালুক) আশ্রয়স্থল ব্রিসবেনে অবস্থিত। এখানে আপনি অন্যান্য প্রাণী, যেমন ক্যাঙ্গারু দেখতে পারবেন। শহর থেকে খুব কাছেই এটি অবস্থিত। তাছাড়া মাউন্ট কোটথা থেকে ব্রিসবেন শহরের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করা যায়। আসলে অনেক জায়গা আছে বেড়ানোর। বেশির ভাগ জায়গায় আপনি বাসে করে বেড়াতে যেতে পারবেন। খরচও কম। সুন্দর এবং সংস্কৃতিমনা ব্রিসবেন আপনার ভালো লাগবেই।
ব্রিসবেনের যাতায়াত ব্যবস্থার কথা চিন্তা করলে মনটা ভালো হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর পর বাস পাওয়া যায়। বাস কখন যাবে তার সময় আগেই বলে দেওয়া আছে। নির্দিষ্ট সময়ে বাস আসবে। যখন যার সুবিধা যাবে। বাসে প্রতিবন্ধী, শিশু, বয়স্ক মানুষ, সন্তানসম্ভবা মায়েদের জন্য সব সময় সংরক্ষিত বসার আসন আছে। বাসগুলো এমনভাবে দাঁড়ায় যাতে যে কোনো প্রতিবন্ধী মানুষ সহজেই একা একা বাসে উঠতে পারেন। এ যেন এক অপূর্ব ভালোবাসা মানুষ মানুষের প্রতি। ব্রিসবেনের মানুষজন সাইকেল চালাতে পছন্দ করেন, নিয়মিত ব্যায়াম করে। ফুটপাতে হাঁটার নিরাপদ ব্যবস্থার পাশাপাশি সাইকেল চালানোর আলাদা ব্যবস্থা আছে। আমাদের বাংলাদেশে যদি এমন হতো ! ব্রিসবেন সিটির পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে ব্রিসবেন নদী। ব্রিসবেন নদীতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ফেরি চলে। ফেরিতে চলার সময় ব্রিসবেন এর সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়। আমি ফেরিতে করে যাই আর ভাবি কবে যে আমাদের বুড়িগঙ্গা নদীতে এইরকম ফেরি চলবে!
অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় সৈকতগুলো এই কুইন্সল্যান্ড এ অবস্থিত। যেমন, গোল্ড কোস্ট আর সান শাইন কোস্ট। কুইন্সল্যান্ড এ আসলে সবাই অন্যান্য জায়গার পাশাপাশি এই দুটো জায়গায় বেড়াতে যায়। দুটো জায়গা খুব সুন্দর।
উপকূলীয় শহর গোল্ড কোস্ট কুইন্সল্যান্ডের রাজধানী ব্রিসবেন থেকে ৬৬ কিলোমিটার দূরে। প্রায় ৬ লাখের বেশি মানুষেরবসবাস এ শহরে। মূলত সার্ফিং করার জন্য বিখ্যাত এই সৈকত। তাছাড়া বিভিন্ন থিম পার্ক যেমন ড্রিম ওয়ার্ল্ড, সি ওয়ার্ল্ডে বেড়ানোর সুযোগ তো রয়েছেই।
ব্রিসবেন থেকে ট্রেন ধরে খুব সহজ ও আরামে যাওয়া যায়। ট্রেন স্টেশনে গেলে টিকেট কাউন্টারের লোকজনই আপনাকে সব জানিয়ে দেবে কোথায় কী করতে হবে সেই সম্পর্কে। আমি টিকেট কাটার সময় আমাকে ছুটো সাদা কাগজে গাইড লাইন প্রিন্ট করে হাতে ধরিয়ে দেয় যাতে আমি বুঝতে পারি কোথায় থামবো, কোথায় ট্রেন পরিবর্তন করতে হবে।
প্রথমবার পরিবার নিয়ে যাচ্ছি বলে আমি তো খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম। কিন্তু এই ধরনের সেবা পেয়ে তো আমি মহা খুশি। আমার বিশ্বাস এইধরনের সেবার জন্যই আজ তারা অনেক উন্নত। তারপর পৌঁছালাম সেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য গোল্ড কোস্টের সার্ফারস প্যারাডাইসে। নীল সমুদ্র হাতছানি দিয়ে যেন সবাইকে ডাকছে। কি অপরূপ নীলের আবহ পানিতে! সমুদ্র আর নীল রং যেন দিগন্ত ছুঁয়েছে!
আরেকটা অসাধারণ জায়গা হচ্ছে সান শাইন কোস্ট। ব্রিসবেন শহর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে সান সাইন কোস্ট। এখানে প্রায় ৩ লাখ মানুষের বসবাস। কিংস বিচ হচ্ছে সবচেয়ে বিখ্যাত এখানে। অস্ট্রেলিয়াতে আসলে সবাই এখানে একবার হলেও ঘুরে যায়। আপনি এখানে এসে সার্ফিং করতে পারবেন, নীল পানিতে নিজেকে আনন্দে ভাসিয়ে দিতে পারবেন, তবে নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে! চাইলে তিমিদের সাথে সাঁতার কাটতে পারবেন বিভিন্ন কোম্পানির সহায়তায়।
এখানে ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা ওয়াশরুম আছে। পানি থেকে উঠে ভেজা কাপড় পরিবর্তন করে আবার অন্য কোথাও বেড়ানোর জন্য বেরিয়ে পড়তে পারেন। তবে পাশেই সুন্দর সাজানো পার্কে বসে কিছুক্ষণ কোস্টের দিকে না তাকালে মনে হয় চোখকে ঠকানো হবে। চাইলে পার্কে বসে কিছু একটা কিনে খেয়েও নিতে পারেন। সামুদ্রিক খাবারের বিশেষ দোকান আছে এখানে। একবার স্বাদ নিয়ে দেখতে পারেন।
ব্রিসবেন থেকে প্রায় ৬৪ কিলোমিটার দূরে সান সাইন কোস্টে গ্লাস হাউস লোক আউট । চাইলে গ্লাস হাউস ঘুরে বেড়াতে পারেন। গ্লাস হাউসের লুক আউট থেকে চতুর্দিকে শুধু সবুজ বনানী আর সুউচ্চ পর্বত দেখা যায়। আপনি চাইলে পর্বতমালার রাস্তা দিয়ে ঘুরে আসতে পারেন। আশে পাশেই অনেক ফলের চাষ হয়। যেমন আভাকাডো,আনারস ,স্ট্রবেরি, বাদাম ইত্যাদি। রাস্তার পাশ দিয়ে চলার সময় এগুলোর বাগান চোখে পড়ে ।
বেড়ানোর গল্প কখনো শেষ হয় না। আমারও অস্ট্রেলিয়ার সব রাজ্য এখনো বেড়ানো শেষ হয়নি, তাই বেড়ানোর গল্পও এখনই শেষ করা যাবে না। ভাবছি অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ভ্রমণ নিয়ে পরবর্তী লেখাটা লিখবো।