ছাত্র-জনতার দেশ কাঁপানো আন্দোলনে পতন হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের। আর এরপর থেকেই আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে বিভিন্ন মহলের কর্তা-ব্যক্তিদের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিভিন্ন তথ্য সামনে আসছে। স্বৈরশাসকের সময়কালে উপর মহলের কয়েকজন রাঘববোয়াল কলকাঠি নাড়তেন সব সেক্টরের। তাদের মধ্যে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী দুজন ছিলেন চট্টগ্রামের দুই আওয়ামী নেতা, সাবেক মন্ত্রী-এমপি ড. হাছান মাহমুদ এবং ফজলে করিম চৌধুরী জুনু। তারা দু’জনই হাসিনার ‘খাস লোক’ হিসেবে পরিচিত।
তাদের ক্ষমতার দাপট এতোটাই জোরালো ছিল যে চট্টগ্রামের রাউজান এলাকায় এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী এবং রাঙ্গুনিয়ায় ড. হাছান মাহমুদের কথায় ও ইশারায় প্রশাসন উঠতো-বসতো। যা হিন্দি মুভির মাফিয়া ডনকেও হার মানায়। হাসিনার পতনকালে ড. হাছান মাহমুদ ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ইতোপূর্বে হাসিনার দুই টার্মে ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী, বন ও পরিবেশ মন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
অন্যদিকে হাসিনার পতনকালে ও আগে ফজলে করিম চৌধুরী জুনু ছিলেন রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। দলীয়ভাবে ফজলে করিম চৌধুরী জুনু আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম উত্তর জেলা শাখার সহ-সভাপতি এবং ড. হাসান মাহমুদ দলের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, আগে ছিলেন কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ফজলে করিম জুনু এবং হাছান মাহমুদ উভয়েই হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের চলাফেরা ও দাপট এতোটাই বেশি ছিল যে এলাকায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো মতপ্রকাশ করার সাহস রাখতো না। ছিল না ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কোন মানুষের ঠাঁই। এখানেই শেষ নয়; এই দুই আওয়ামী নেতা ক্ষমতা ও পদ-পদবির চরম অপব্যবহার করে গড়ে তোলেন দুর্নীতির এক সাম্রাজ্য যেখানে তাদের ইচ্ছামতোই হতো সবকিছু। সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিদেশেও পাচার করেছেন বিপুল অঙ্কের অর্থ-সম্পদ। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে গড়ে তুলেছেন তাদের কালো টাকায় ব্যাবসা-বাণিজ্য।
চট্টগ্রামের রাউজান ও রাঙ্গুনিয়া আসন থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্ষমতার জোরে তিন মেয়াদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন যথাক্রমে এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী জুনু এবং ড. হাছান মাহমুদ। ২০০৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল। পুরো সময় জুড়ে রাউজান ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে রীতিমতো রামরাজত্ব কায়েম করেন ফজলে করিম চৌধুরী জুনু ও ড. হাছান মাহমুদ। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে ফজলে করিম চৌধুরী জুনু ও ড. হাছান মাহমুদের তাবৎ অবৈধ উপায়ে কাড়ি কাড়ি উপার্জিত অর্থ আরব আমিরাতের আজমাইনে পুঁজি বিনিয়োগ নোয়াপাড়ার প্রবাসী জসিম উদ্দিন (ওরফে সিএনজি জসিম)-এর মাধ্যমে।
জানা গেছে, ফজলে করিম চৌধুরী জুনু দেড় হাজার কোটি টাকা দুবাইসহ আমিরাতের বিভিন্ন শহরে আবাসন ও ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট খাতে পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন জুনুর পক্ষ থেকে সিএনজি জসিম। এর মধ্যে আজমাইন শহরের সউদি জার্মান হসপিটালের পেছনে চল্লিশ বিঘা জায়গা ক্রয় করেছেন সিএনজি জসিম। বিনিয়োগকৃত অর্থের পুরোটাই রাউজানের সাবেক সংসদ সদস্য ফজলে করিম চৌধুরী জুনুর।
দীর্ঘ ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই সিটিতে ব্যবসা করছেন ফটিকছড়ির প্রবাসী রফিক আহমেদ। তিনি জানান, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করে আবাসনখাতে বিনিয়োগ করেছেন ফজলে করিম চৌধুরী ও ড. হাছান মাহমুদ। রাউজানের সিএনজি জসিম এই দুই আওয়ামী লীগ নেতার পক্ষ হয়ে অবৈধ অর্থ আরব আমিরাতের আজমাইনে বিনিয়োগ করেছেন। এখন পর্যন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন পাচারকৃত বিপুল অঙ্কের অবৈধ অর্থের বিনিময়ে সৃজিত বিশাল মাপের ব্যবসা।
এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের ওমানে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সংগঠন ওমান-বাংলাদেশ এসোাসিয়েশনের কয়েকজন নেতা ফজলে করিম চৌধুরী জুনুর অর্থ বিনিয়োগ সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন। তারা জানান, ড. হাছান মাহমুদ ও ফজলে করিম চৌধুরী বিদেশে অর্থ পাচার করে বিনিয়োগের জন্য কয়েকজন প্রবাসী ব্যবসায়ীর সাহায্য নিয়েছেন। তারা প্রবাসে এক সময় শ্রমিকের কাজ করলেও এখন সবাই অবৈধ অর্থ বিনিয়োগ করে আলাদীনের চেরাগ পেয়ে গেছেন। খোঁজ নিয়ে আরো জানা যায়, অবৈধ অর্থ বিদেশে সরিয়ে নিতে সাহায্য করার প্রতিদান হিসেবে সিএনজি জসিমের ছেলে জোবায়েরকে সিআইপি (কমার্শিয়াল ইম্পর্ট্যান্ট পারসন) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে তদবির করেন ড. হাছান মাহমুদ।
গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সোনা চোরাচালানের বড় অংশই নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন ফজলে করিম জুনু ও হাছান মাহমুদ। হাছান মাহমুদের ভাই খালেদ মাহমুদ ও এরশাদ মাহমুদ চট্টগ্রাম মহানগরী এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্বর্ণ চোরাচালান ও হুন্ডি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন এমন তথ্য গোয়েন্দা শাখায় রয়েছে। ফজলে করিম চৌধুরীর হয়ে সোনা চোরাচালানের বিষয়টি দেখভাল করতেন তার ব্যক্তিগত সহকারী সুমন। সোনা চোরাচালানের রুট নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ছিলেন এমইএস কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক জিএস, নগর আওয়ামী লীগ নেতা আরশেদুল আলম বাচ্চু ও পটিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর ছেলে শারুনকে ব্যবহার করেছেন ড. হাছান মাহমুদ। দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন ফজলে করিম জুনু। ফজলে করিমের প্রত্যক্ষ মদদে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল এবং রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল দুর্নীতি ও অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়। হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সূত্র জানায়, গত ১৬ বছরে চট্টগ্রাম রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান কার্যালয়ের সব দরপত্র এবং ইজারা নিয়ন্ত্রণ করতেন নগর আওয়ামী লীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর ও আইয়ুব আলী। এই সিন্ডিকেটকে মূলত আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে টাকা ভাগাভাগি করতেন ফজলে করিম চৌধুরী জুনু।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরে থেকেই ফজলে করিম রেলের সংসদীয় কমিটিত সভাপতি হন। এই দীর্ঘ সময় রেলের কিছু কর্মকর্তার সহায়তায় তিনি নানা রকম অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। প্রতি রেলের পাওয়ার কারে ব্যবহারের জন্য যে সকল স্পেয়ার পার্টস লাগে তাক ডয়েজ স্পেয়ার পার্টস বলে। ফজলে বাংলাদেশে ডয়েজের ডিলার হন। রেলের যে কোন টেন্ডার তা উম্মুক্ত বা ইজিপি যাই হোক না কেন, সব টাতেই তার কাছ থেকে মালামাল নিতে হত। পিপিআর-২০০৮ লংঘন করে অনেক কর্মকর্তা ফজলে করিমের আস্থাভাজন হওয়ার জন্য তার ক কথামত টেন্ডারে শর্ত জুড়ে দিত।
কিছু দলবাজ আওয়ামী আশীর্বাদ পুষ্ট কর্মকর্তা টেন্ডারে এভাবে শর্ত দিত যে, দরপত্রে অংশগ্রহণকারী দরদাতাকে অবশ্যই বাংলাদেশে ডয়েজের স্থানীয় প্রতিনিধির নিকট হতে প্রদত্ত Authorization Letter Submit করতে হবে। যেহেতু কোন দরদাতাকে তারা Authorization letter দেয় না, ফলে একক দরদাতা হিসেবে ফজলে করিমের ফার্ম FAV অথবা NGGL প্রতিটি মালের দাম ৫/৬ গুন বেশি দরে কোট করত। অথচ একই মালের দাম ইন্ডিয়া বা চায়নায় এর চেয়ে অনেক কম। গত ১৫ বছরে ফজলে করিম এভাবে রেলের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে এবং রেলের কিছু সুবিধাভোগী কর্মকর্তা তাদের সহযোগী হয়ে কাজ করে তারাও এই দুর্নীতির অংশীদার হন।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ২০০৮ সালের পর চট্টগ্রামের রাজনীতিতে শীর্ষ প্রতাপশালী হিসেবে আবির্ভূত হন। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালীন জলবায়ু তহবিলের অর্থ লোপাট করে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিলেন ২০১৫ সালে। ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র, শিপ বিল্ডিং ও শিপ ব্রেকিং শিল্পের ছাড়পত্রের নামে শতকোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন তিনি। ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালে আওয়ামী সরকারের প্রথম মেয়াদে সীতাকুণ্ডের অধিকাংশ শিপব্রেকিং ইয়ার্ড নামে বেনামে দখলে নেন হাছান মাহমুদ ও তার সহযোগীরা। সীতাকুণ্ডের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান (পরবর্তীতে এমপি) মামুনের দখলবাজির গডফাদার হিসেবে কাজ করেছেন ড. হাছান মাহমুদ।
স্ত্রীর নামে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা খুলে জলবায়ু তহবিলের অর্থ আত্মসাৎ করেন ড. হাছান মাহমুদ। মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে ‘সোনার বাংলা’ নামে এনজিও খুলে তার চেয়ারম্যান হিসেবে নিজে ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজের স্ত্রীর নাম দেন। সেই প্রতিষ্ঠান কাজে লাগিয়ে জলবায়ু তহবিলের ২৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন ড. হাছান মাহমুদ। এ বিষয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করলে সেই প্রতিবেদনও ক্ষমতার জোরে সরিয়ে নেয়া হয়।
হাসিনা সরকারের প্রথম মেয়াদে পরিবেশ ফান্ডে (জলবায়ু) বাংলাদেশ ব্যাপক বিদেশি বাজেট বরাদ্দ পায়। ৯টি এনজিও’র মাধ্যমে এসব টাকা বিতরণ করা হয়েছিলো, যার প্রত্যেকটির চেয়ারম্যান ছিলেন ড. হাছান মাহমুদ নিজেই। জলবায়ু তহবিল, শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আত্মসাৎকৃত বিপুল বিদেশে অর্থ পাচার করেই ড. হাছান মাহমুদ বিদেশেই ব্যবসা চালাচ্ছেন। একইভাবে ফজলে করিম চৌধুরী জুনু রেলওয়ের দরপত্র, ইজারাসহ বিভিন্ন খাতে লুটপাটের বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার করে মধ্যপ্রাচ্যে ব্যবসার বিশাল এক জগৎ গড়ে তুলেছেন।