শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১২ পূর্বাহ্ন

স্বপ্নের দেশ সুইজারল্যান্ড

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১১ জুন, ২০২৪

সুইজারল্যান্ড অনেকের মতো আমারও স্বপ্নের দেশ।

ছোটবেলায় প্রথম যখন বিভিন্ন দেশের নাম পড়তে শিখি, তখন কেন যেন নিজের দেশের নামের পর সুইজারল্যান্ড নামটাই আমাকে বেশি আকৃষ্ট করতো। দেশটি নিয়ে মনে মনে কত স্বপ্ন দেখেছি, বন্ধুমহলে অনেক চাপাবাজিও করেছি।

যাহোক, স্বামীর চাকরীর সুবাদে বিভিন্ন দেশ ঘুরবার সুযোগ আমার হয়েছে।

আমার স্বামী সোলায়মান আশরাফী দানী লন্ডনে একটি নামকরা Oil Company তে কাজ করে। সে আমার সুইজরল্যান্ড সম্পর্কিত স্বপ্নের কথা জানত। একদিন বিকেলে অফিস থেকে হঠাৎ করে বাড়ি ফিরেই সে আমাকে বলল, তাড়াতাড়ি ব্যাগ গোছাও, আমরা কাল ভোরে সুইজারল্যান্ড যাচ্ছি। প্রথমে আমি বেশ অবাক হই।

আশ্চর্য! বলা নেই কওয়া নেই সকাল বেলা সুইজারল্যান্ড যাচ্ছি, এটা নিশ্চয়ই সে আমার সাথে মজা করছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝলাম-না, আমারা সত্যিই সুইজারল্যান্ড যাব এবং এটা ছিল আমার জন্য আমার স্বামীর পক্ষ থেকে একটা সারপ্রাইজ গিফ্ট।

আমি একটু ভাব দেখিয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দিলাম। এত তাড়াতাড়ি কিভাবে আমি ব্যাগ  গুছাব! তাও আবার ভোর সাতটায় ফ্লাইট (যদিও মনে মনে আনন্দে আত্মহারা) যাহোক খুব তাড়াতাড়ি আমি ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম এবং অন্যান্য আনুসাঙ্গিক যাবতীয় হাতের কাজও সেরে নিলাম।

আমাদের বাড়ি লন্ডনে বার্কিং এ। তাই আমরা রওনা হব লন্ডন সিটি এয়ারপোর্ট থেকে। পরেরদিন ২১ নভেম্বর ২০০৮ইং ভোর পাঁচটায় বার্কিং হতে রুট ৫ বাসে করে Plasto এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

২০ মি. এ Plasto স্টেশনে পৌঁছালাম। ওখান থেকে ট্রেনে করে আমরা লন্ডন সিটি এয়ার পোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। একটা স্টেশন পরই লন্ডন সিটি এয়ারপোর্ট। অর্থাৎ ৫ মি: এই আমরা পৌঁছে গেলাম।

লন্ডন সিটি এয়ারপোর্ট ছিল আমার জন্য এক দারুন বিষ্ময়ের স্থান। আমরা ট্রেন থেকে নেমে সিটি এয়ারপোর্টটা কোনদিকে খুঁজছিলাম। কারণ বাইরে কোন এয়ারপোর্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না। পরে একজনকে জিজ্ঞাসা করায়, সে বলল রেলস্টেশনের দুইতলায় যেতে। দোতলায় গিয়ে দেখি ওটা এয়ারপোর্ট।

এমন এয়ারপোর্ট আমি আগে কখনো দেখিনি। নিচতলায় রেলস্টেশন আর দোতলায় এয়ারপোর্ট। খুবই ছোট একটি এয়ারপোর্ট। আমরা এয়ারপোর্টের যাবতীয় Formalities শেষে সকাল সাতটায় এয়ার ফ্রান্সে করে জেনেভার উদ্দেশ্যে রওনা দেই।

এয়ার ফ্রান্স লেনটাও খুব ছোট (লোকাল প্লেনগুলো একটু ছোট হয়)। লন্ডন টাইম সকাল আটটায় এবং জেনেভা টাইম সকাল নয়টায় আমরা জেনেভা এয়ারপোর্ট পৌঁছি।

সেখানে আমাদের বন্ধু রীমা ও সুমন অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। জেনেভা এয়ারপোর্টটাও খুব সুন্দর। এটাও অনেকটা লন্ডন সিটি এয়ারপোর্টেরই মত। একদিকে রেলস্টেশন আরেকদিকে এয়ারপোর্ট। তবে লন্ডন সিটি এয়ারপোর্টের তুলনায় বেশ বড়।

এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েই আমরা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল, ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম আর ভাবছিলাম, আমি আমার স্বপ্নের দেশে দাঁড়িয়ে আছি। ভাবতেই খুব ভাল লাগছিল।

লন্ডন থেকে যাওয়াতে তেমন নতুন কিছুই লাগছিল না। সবকিছুই অনেকটা লন্ডনেরই মতো। তবে রাস্তাগুলো বেশ ছোট এবং চিপা লন্ডনের তুলনায়। কোনটা বাস লাইন, কোনটা ট্রেন লাইন আর কোনটা আইল্যান্ড বোঝা কঠিন। প্রথমেতো আমি আইল্যান্ড মনে করে ট্রেন লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম, আর রীমা তাড়াতাড়ি আমাকে সরিয়ে দেয়। তবে দেশটা খুবই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও সাজানো।

এখানকার লোকাল মানুষজনও বেশ আন্তরিক, ইংলিশের মত সব না। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে সমস্যা, তা হল এরা ইংলিশ বোঝে না বা বলতে চায় না। যার জন্য দেখা গেছে, আমাদের সাথে অনেকেই কথা বলতে এসেছে, কিন্তু আমাদের চুপ করে থাকতে হয়েছে। রিমা সুমন না থাকলে বিপদেই পড়তে হোত। দশ মি: অপেক্ষার পর ট্রেন আসল।

আমরা ট্রেনে চেপে প্রথমে রিমার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। দু’টা স্টেশন পরই রিমার বাসা। ট্রেনের মধ্যে কারও কোন কথা বুঝতে পারছিলাম না। বারবার একটা কথাই ঘোষণা হচ্ছিল “খোশীনা হো” আর ট্রেনের গেট খুলে যাচ্ছিল, আমরা বুঝলাম, এর অর্থ “Next Stopes”। দশ মি: এর মধ্যে আমরা রিনার বাসায় এসে পৌঁছলাম।

রিমা খাওয়া দাওয়ার এক বিশাল আয়োজন করে রেখেছিল। আমরা তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে  নাস্তার টেবিলে বসলাম। রিমার বাসা “লেক জেনেভার” খুব কাছে, পায়ে হাঁটা পথ। নাস্তা খেতে খেতে আমরা ঠিক করলাম প্রথমে আমরা আমাদের ভ্রমণ, লেক জেনেভা থেকে শুরু করব।

দানী আমাকে বললো তিনদিনের মধ্যে যতটুকু পারা যায় Short cut এ আমরা সুইজারল্যান্ড ঘুরে দেখব। সে যা বলে আমি তাতেই রাজী। সুইজারল্যান্ড এসেছি সে খুশীতেই আমি আহ্ল্লাদে আটখানা। আমাদের একমাত্র সন্তান তাসিন। ওর বয়স তখন এক বছর। এটা তার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। সেও ঈযধহমব এ এসে মহাখুশী। রিমার দুই বছরের খুব সুন্দর পুতুলের মতো মেয়ে আনিসা আপুকে পেয়ে সে খুব উচ্ছসিত।

তার সাথে সে খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নাস্তা শেষে আমাদের আর তর সইছিল না। কতক্ষণে শহরটা ঘুরে দেখব এ চিন্তায় আমি বিভোর। অবশেষে আমরা বেলা এগারোটায় বাসা হতে বের হলাম। নভেম্বর মাস হওয়াতে সুইজারল্যান্ডে তখন বরফ পড়ছে।

বাইরে সেদিন -১০°c তাপমাত্রা এবং টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। তারপরও তেমন খারাপ লাগছিল না হাঁটতে। পাঁচ মি: হেঁটেই আমরা ‘লেক জেনেভার তীরে পৌঁছে গেলাম। জেনেভা শহরের প্রাণ লেক জেনেভা।

সুইজারল্যান্ড পাহাড় ও পানি ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য পরিমন্ডিত ছোট্ট একটি দেশ। কিন্তু এটি ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র। এ দেশের শতকরা ৯৯% ভাগ মানুষই শিক্ষিত। দুর্নীতিমুক্ত একটি দেশ। এ দেশের ৬০% মানুষের ভাষা জার্মান, ২০% ফ্রান্স এবং বাকী ২০% অন্যান্য।

লেক জেনেভা সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে বড় ও অন্যতম লেক। দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ সুইজারল্যান্ডকে ঘিরে রেখেছে। লেকের পাড়ে অনেক বোট বাধা থাকে। Tourist রা ইচ্ছা করলে বোট ভাড়া করে লেকটা ঘুরে দেখতে পারে। লেকের এক পাশে বড় বড় পাথর যা আমাদেরকে আমাদের দেশের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের কথা মনে করিয়ে দেয়। সে সময় লেকে বড় বড় সাদা রাজহাঁস ভেসে বেড়াচ্ছিল।

চরপাশ পাহাড়ে ঘেরা।  যা সতি্যই মনোমুগ্ধকর। আমি আর দানী অনেক ফটোসেসন করলাম। বৃষ্টির জন্য তাসিনকে বেবিসিটার থেকে বের করিনি।

তারপর একটা বোট ভাড়া করে এক জায়গা হতে আরেক জায়গায়। জেনেভার মধে্যই মজা করে ঘুরলাম। সে এক অপূর্ব অনূভূতি! বোট রাইড শেষে বিকেলে আমরা বাড়ি ফিরলাম। আবার একটু চা, নাস্তা করে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম জেনেভার অফিসিয়াল Area টা একটু ঘুরে দেখতে। এখানে United Nation অবস্থিত। United Nation এর প্রধান শাখা অফিস জেনেভায় অবস্থিত। এটা UN (জাতিসংঘ) এর প্রধান কার্যালয়ের বাইরে সবচেয়ে বড় দায়িত্বশীল Station। একে ইউরোপের প্রাণ বলা হয়। এখানে কমপক্ষে ১৬০০ স্টাফ কাজ করে।

United Nation এর বাইরে সামনে চৌরাস্তার পাশে অর্থাৎ UN এর Gate এর ঠিক সামনে Land Mines ও Clusterbomb এর ব্যবহারের বিপক্ষে প্রতিবাদ স্বরূপ একটি পা ভাঙ্গা কাঠের চেয়ারের  স্মৃতিসৌধস্বরূপ ভাস্কর্য্য রয়েছে।

এটি সুইস শিল্পী “Daniel Berset” এর করা। এটা ৫.৫ টন কাঠের তৈরি এবং এর উচ্চতা বার মি: (৩৯ ফুট)। মূলত জেনেভা পরিদর্শনে আসা রাজনীতিবিদদেরকে তাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেয়াই এর উদ্দেশ্য। জেনেভার অফিসিয়াল এলাকা ঘুরতে ঘুরতে আমাদের প্রায় রাত নয় টা বেজে যায়।

তাই ঐ দিনের মতো আমাদের বেড়ানো শেষ করে আমরা বাড়ি ফিরে আসি। পরেরদিন জেনেভার বাইরে ঘুরতে যাওয়া আমাদের উদ্দেশে্য। অর্থাৎ, সুইজারল্যান্ডের আসল সৌন্দর্য পর্বত চূড়ায় আরোহন। তাই বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া খেয়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। পরেরদিন, ২২ শে নভেম্বর ভোর ছয় টার মধে্য আমরা ঘুম থেকে সবাই উঠে পরি এবং ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে সাতটা ত্রিশ এর মধে্য রেডি হয়ে স্টেশনের উদ্দেশে্য রওনা হলাম।

রিমার বাসা থেকে স্টেশন পাঁচ কি.মি এর পায়ে হাঁটা পথ। সুমন ভাই আমাদের জন্য আগে থেকেই দিনের Travel pass কিনে রেখেছিল। এখানে Tourest দের জন্য বিভিন্ন ধরণের লোভনীয় অফারে Travel pass পাওয়া যায়।

আমাদের জন্য ওরা সুইস Flexi pass কিনে রেখেছিল। এই পাশ দিয়ে আমরা ৫০% Discount এ যেকোন রেল সার্ভিস ব্যবহার করতে পারব।

জেনেভা স্টেশনের দুই নম্বর প্লাটফরম এ আমরা Zurich এর উদ্দেশে্য যাবার জন্য এসে পৌঁছালাম। আমাদের ট্রেন সকাল আটটায়। ঠিকসময়ে ট্রেন প্লাটফরমে পৌঁছাল। ট্রেনটিতে চড়া ছিল আমাদের জন্য আরেক চমক। পুরো ট্রেনটা ছিল Glass  এ ঘেরা। এর কোন জানালা নেই।

কারণ, যেহেতু পুরো ট্রেনটাই Glass, তাই এর কোন জানালার দরকার হয় না। ট্রেনের ভেতরটা খুবই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। এর একটা অংশে মিনি রেস্টুরেন্ট আছে। যেখানে যাত্রীরা গিয়ে তাদের Breakfast, lunch অথবা dinner সারতে পারে। রেস্টুরেন্টে Music বাজছে, কেউ চাইলে Candle light dinner ও করতে পারে।

ওখানে কেউ বুঝতেই পারবে না যে সে ট্রেনে বসে আছে। মনে হবে সতি্যই হয়তো কোন 5 star Hotel এ Diner করছে। ট্রেনে চেপে Zurich এর উদ্দেশে্য যাচ্ছি আর ভাবছি “এতদিন শুধু টিভির পর্দায় বিভিন্ন English Hindl Movie তে এসব ট্রেন দেখেছি। আর আজ আমি নিজেই বাস্তবে সেই ট্রেনে বসে আছি।

ট্রেন যখন চলতে শুরু করল তখন ট্রেন হতে সুইজারল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে আমরা সতি্যই বিমোহিত। আমরা সবাই গল্প থামিয়ে শুধু অবাক বিস্ময়ে এর সৌন্দর্য দেখছিলাম।

দানী আর সুমন ভাই ছবি তোলা আর Video করাতে ব্যস্ত হয়ে পরে। জেনেভা হতে Zurich যেতে হলে, Montrox এ গিয়ে ট্রেন Change করতে হয়। জেনেভা হতে Montrox যাবার পথের প্রাকৃতিক দৃশ্যটা অপূর্ব। দু’পাশ পাহাড়ে ঘেরা সামনে রেললাইন। বরফ পরে পাহাড়গুলো সাদা হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন সাদা চাদরে ঢেকে রেখেছে।

Vivey পর্যন্ত যাবার পর একপাশে সাদা পাহাড়। মাঝখানে রেললাইনের আরেক পাশে বিশাল লেক এবং লেকের চারপাশ সাদা পাহাড়ে ঘেরা। সাদা পাহাড়ের চূড়ায় সোনালী রোদের আলো পরে তা ঝিকমিক করছিল। সতি্যই এক অপূর্ব দৃশ্য। আমরা ঠিক দশটা ত্রিশ এ Montrox পৌঁছলাম।

Montrox এ নামার পরই হঠাৎ করেই তুষার পড়া শুরু হলো যার ফলে, সমস্ত ট্রেন বাস বন্ধ করে দেয়া হলো। তুষারপাতের কারণে পাহাড়ী রাস্তা প্রচন্ড পিচ্ছিল।

এজন্য ট্রেন বা বাস কোনটাই যাবে না। অগত্যা আর কি করা! আমরা Montrox স্টেশনের Waiting room এ বসে অপেক্ষা   করতে থাকলাম, কখন তুষারপাত বন্ধ হবে। এগারটা ত্রিশ এর দিকে তুষারপাত মোটামুটি কমে আসল। কিন্তু বাস বা ট্রেন তখনও ছাড়ল না। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ঐদিন আর Zurich এর উদ্দেশে্য কোন ট্রেন যাবে না। তবে একটার দিকে বাস Luzern পর্যন্ত যাবে।

শেষপর্যন্ত কি আর করা, আমরা একটার দিকে বাসে করে Luzern এর উদ্দেশে্য রওনা দিলাম। এই বাসের রাইডটা ছিল খুবই লোমহর্ষক ও exiting। বাস পাহাড়ী আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, আর আমরা বাস হতে খুব কাছ থেকে সাদা পাহাড় ̧লো দেখছিলাম। সে এক অপূর্ব অনুভূতি। বাস যখন পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে পাহাড়ের উপর উঠছিল, তখনকার অবস্থাটা সতি্যই খুব ভয়াবহ ছিল। কারণ রাস্তাগুলো ছিল খুবই সরু, রাস্তার পাশে কোন রেলিং নেই। হঠাৎ যদি বাস accident করে, বাঁচার কোন আশাই নেই। নিশ্চিত মৃত্যু।

দানী আর সুমন ভাই দোয়া পড়ছিল আর আমাদেরকে ঝাড়ফুক করছিল। মনে মনে খুবই ভয় পাচ্ছিলাম, তবে ভালও লাগছিল। এত কাছ থেকে কখনো এত উঁচু বরফে ঢাকা পাহাড় দেখতে পারবো স্বপ্নেও ভাবিনি। দেখাতো দুরের কথা। সুইজারল্যান্ডকে কেন প্রাকৃতিক নৈস্বর্গের দেশ বলা হয়, তা এখানে না আসলে কেউ বুঝতে পারবে না। সৃষ্টিকর্তার এক অপূর্ব সৃষ্টি। প্রায় দেড়ঘন্টা লাগল আমাদের Luzern পৌঁছাতে।

Luzern এ চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ।

বাস থেকে পা ফেলা মাত্র মনে হলো সাদা তুলার মধে্য পা ডুবে যাচ্ছে। অনেক Tourist রা ski করছিল। আমরা ফটো সেসনের জন্য রেডি। ওখানে Hotel Alps এ আমরা উঠলাম, একটু চা পান করবার জন্য। সেখানে সবাই বরফ পায়ে আসার কারণে সিঁড়িগুলো একটু পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল।

রীনা Washroom এ যাবার সময় ধপাশ করে সিঁড়িতে Slip কেটে পড়ে যায় এবং সুমন ভাই তাকে তুলতে গিয়ে নিজেও চিৎপটান হয়। এ নিয়ে আমরা খুব মজা করি। চা পান শেষে আমরা ফটোসেশন শুরু করে দিই। আমার ছেলে তাসিন প্রথম বরফ দেখে খুবই exited।

সে ভেবে পাচ্ছে না চারদিকে এত সাদা তুলায় ঢাকা কেন। সে বেবিসিটার থেকে নীচে নামার জন্য অস্থির। নীচে নামিয়ে দিতেই গুঁটি গুঁটি পায়ে সে হাঁটতে লাগল। সেও নীচে ধপাস করে পড়েই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল “ওমা এত ঠান্ডা কেন লাগল হাতে” তার বড় বড় চাহনিতে যেন এই প্রশ্নটাই ফুটে উঠছিল। আমাদের ফটোসেশন শেষে তাসিন লক্ষী ছেলের মতো বেবিসিটারে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়লো। আমরা জেনেভায় রওয়ানা দেবার জন্য প্রস্তুত হলাম। তবে এবার আর বাস না, আমরা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। অতঃপর বিকেল চারটা নাগাদ আমরা জেনেভার উদ্দেশে্য রওনা দিলাম।

বিকেল পাঁচটা ত্রিশ নাগাদ আমরা Montrox এসে পৌঁছলাম। Montrox এ এসে সেখানকার Shopping Mall এ ঢুকে কিছু টুকিটাকি কেনা কাটা শেষে ঠিক করলাম, আমরা Boat এ করে জেনেভা যাব। বোট যেখান থেকে ছাড়বে অর্থাৎ লেকের পাড়ে নামতে গিয়ে আমাদের জান বের হয়ে যাবার উপক্রম। বেশ খাড়া সিঁড়ি, আর অনেক নীচে নামতে হয়। তবুও কষ্ট করে নামলাম। কিন্তু এখানেও বিধিবাম। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়াতে, বোট বন্ধ হয়ে গেছে। অগত্যা লেকের পাড়ে কিছু ফটোসেশন করে আবার কষ্ট করে উপরে এসে ষ্টেশনের Waiting Room এ ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। এখানে স্টেশনে ঢুকতেই অনেক ফকির চোখে পড়ল। তবে তারা কেউ বাংলাদেশী ফকিরদের মতো না। তারা বেশ  স্মার্ট, ইন করে প্যান্ট শার্ট পড়া।

এক হাতে জ্বলন্ত সিগারেট আরেক হাতে গীউল বাজিয়ে গান গেয়ে ভিক্ষা করছে। ব্যাপারটা আমাকে বেশ মজা দিল। আগে টিভিতে বিভিন্ন মুভিতে দেখতাম এসব, আর হাসতাম। আজ নিজের চোখেই দেখলাম। ট্রেন চলে আসল। আমরা সেদিনকার মতো আমাদের সফর শেষ করে বাড়ির উদ্দেশে্য রওনা দিলাম। রাত আটটা ত্রিশ এর দিকে আমরা বাড়ি পৌঁছলাম। রীমা আগে থেকেই আমাদের Dinner রেডি করে ফ্রীজে রেখে দিয়েছিল। আমরা ঝটপট Fresh হয়ে মাইক্রোওভেনে রিমার রাঁধা Thai Food গরম করে খেয়ে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম।

কারণ পরেরদিন ভোরে উঠে আবার আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে। পরেরদিন ২৩ শে নভেম্বর সকালে ঝটপট ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে সকাল আট টার মধে্য আমরা বের হয়ে পড়লাম Zurich এর উদ্দেশে্য। আজকের আবহাওয়া বেশ ভাল। বাইরে বেশ রোদ উঠেছে গ্রীষ্মকালের মতো। আমরা প্রথমে Montrox গেলাম। Montrox থেকে ট্রেন বদলাতে হলো আমাদেরকে। Zurich পর্বত চূড়া। এটা প্রায় পাঁচ হাজার ফুট উঁচু। পর্বতচূড়ায় উঠার জন্য রেল লাইন  বিশেষভাবে তৈরি। এই রেললাইন স্বাভাবিক রেললাইনের মতো না। এর পাটাতন খাঁজ কাটা। যাতে ট্রেন পার্বতচূড়ায় উঠার সময় স্লিপ কেটে না যায়।

Zurich এর যাত্রাটা খুবই Exiting। ট্রেন যত উপরে উঠছে ততই চারদিক সাদা হচ্ছে। মাঝে মধে্য সাদার মাঝে সবুজ গাছ পালা। আবার কোথাও কোথাও শুধু বরফে ঢাকা। মাঝে মধে্য একটা দু’টা বাড়ি, তার ছাদ যেন বরফে ঢাকা গাছপালার মধে্য উঁকি দিচ্ছিল। পাহাড়ের পাদদেশে বরফ গলে ছোট ছোট জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়েছে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। চোখ ফেরানো যায় না। দেখতেই ইচ্ছে হয় বারবার। যত উপরে উঠতে থাকলাম শহরটা ততই ছোট হয়ে আসতে থাকল। Zurich পৌঁছাতে আমাদের প্রায় দুপুর হয়ে যায়। এখানে পৌঁছে আমরা একটু যার যার মতো ঘুরে দেখলাম। ফটোশেসন করলাম।

তারপর একটা ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টে বসে Lunch করলাম। দুপুর তিন টার মধে্য আমরা আবার সবাই জেনেভার  উদ্দেশে্য রওনা দিলাম। আমাদের বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত হয়ে গেল। পরেরদিন ২৪ শে নভেম্বর আমাদের লন্ডন ফেরার দিন।

তাই আমরা জেনেভায় পৌঁছে টুকটাক শপিং সেরে নিলাম সুইজারল্যান্ডের স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ। পরেরদিন ২৪ শে নভেম্বর আমাদের ফ্লাইট বেলা বারটায়। দশটার মধে্য আমাদেরকে এয়ারপোর্ট এ পৌঁছে যেতে হবে। রিমা-সুমন ভাই আমাদেরকে পৌঁছে দিল এয়ারপোর্ট পর্যন্ত। এয়ারপোর্ট পৌছে আমরা জানতে পারলাম আমাদের প্লেন পয়তাল্লিশ মি: Delay হবে। আমাদের হাতে প্রায় পৌঁনে তিন ঘন্টা সময় আছে। দানী বলল, এই সুযোগ আমরা জেনেভা এয়ারপোর্টের কিছু ছবি তুলবো। এরই মধে্য আমার চোখে পড়ে এয়ারপোর্টের একপাশে লেখা Free Shop।

আমার আবার Shopping Mall বা কোন Shop  দেখলে হুঁশ থাকে না। কিছু কিনি বা না কিনি সেখানে ঢুঁ মারা আমার স্বভাব। Free Shop দেখে আমার আর কোন হুঁশ নেই আমি দানীকে বললাম, চলো না একটু ঘুরে আসি। হাতে তো অনেক সময় আছে। দানী আবার Shopping Mall এ ঘোরা পছন্দ করে না।

সে বলল, না আমি আর তাসিন বরং এখানে বসি। তুমি দেখে আস। আমি সাথে সাথেই রাজী। আমি আমার পাসপোর্ট দানীর কাছে দিলাম যদি হঠাৎ হারিয়ে যায়। দোকানে ঢুকেই আমি আমার বোকামিটা টের পেলাম। আসলে ওটা ছিল Tax Free Shop। তাড়াহুড়ায় Tax টা আমার চোখে পড়েনি। দানী অবশ্য বলেছিল Free বলে কিছু নেই। যাহোক ও খেয়াল করেনি। দোকানে সবকিছু নামাল Tax Free কিন্তু আকাশ ছোঁয়া দাম সব কিছুর। আমি হতাশ হয়ে পাঁচ মিনিটে ঘোরা শেষ করে ফিরে আসার পথেই আমার চরম বোকামিটা আবার টের পেলাম। Free Shop দেখে উত্তেজনার বশে আমি খেয়ালই করিনি। এখানে Only Entrence, No Exit লেখা আছে। আমিতো মহা চিন্তায় পড়ে গেলাম। তাহলে কি হবে এখন আমার?

বের হব কিভাবে আমি। দোকানের Sales girl কে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কিভাবে বাইরে যেতে পারি? ও আমাকে বলল পাশে পুলিশ কন্টেধাল রুম আছে, তুমি ওখানে বলো। ওর কথামতো আমি গেলামও সেখানে। সেখানে গিয়ে দেখি একজন পুলিশ বসে আছে। সেও আবার ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমি কিভাবে বাইরে বের হতে পারি? আমি ভুল করে এ পথে এসেছি। সে ফোনে কথা বলতে বলতেই হাতের ইশারায় সামনে দেখিয়ে দিল। তার দেখান পথে গিয়ে আমি চারদিকে কোন রাস্তা পাচ্ছিলাম না। যেতে যেতে কিছুদূর যাবার পর মনে হলো আমি প্লেনে উঠে পড়ব হয়তো। আবার ফিরে আগের জায়গায় আসলাম। এবার ওখানকার এক স্টাফকে জিজ্ঞাসা করলাম।

সে সুইস ভাষায় কি বলল কিছুই বুঝলাম না। দাঁড়িয়েই থাকলাম। দানীকে দেখছি বাইরে বসে আছে। কিন্তু ও বসে আছে উল্টা দিকে। যার জন্য আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু সে আমাকে দেখতে পাচ্ছিল না। সঙ্গে মোবাইল ও নেই যে তাকে ফোন করব। আমার দাঁড়িয়ে থাকা দেখে সেই স্টাফ আমাকে সাহাযে্যর জন্য এগিয়ে আসল। কিন্তু ও ভাল ইংলিশ বোঝে ও না বলতেও পারে না। সে সম্ভবত আমার কথা ঠিক বুঝতে পারেনি। সে আমাকে বের হবার পথ দেখিয়ে দিল তার দেখান পথে গিয়ে আমি মহাবিপদে পড়লাম। আমি একটার পর একটা গেট পার হচ্ছি, আর সব গেট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে পার হতে হতে আমি ৩ তলায় উঠে গেলাম। কিন্তু দোতলায় নেমে আর বের হবার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

অনেকটা আলী বাবা ও চল্লিশ চোর গল্পের মতো। দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। এদিকে ঘড়িতে এগারটা বেজে গেছে। আমি ওখানে দাড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলাম ভয়ে। এর মধে্য আরেক পুলিশকে বললাম। সে আমাকে বলল ওখানেই থাকতে।

আমার Husband কে ঐ পথেই যেতে হবে। কিন্তু এগারোটা ত্রিশ বেজে যায় দানী আর আসে না। আমার তখন প্রায় অজ্ঞান হবার অবস্থা ভয়ে। এর মধে্য মাইকে শুনতে পেলাম, Announce হচ্ছে আমার নাম। আমার Husband আমার জন্য ফ্রেঞ্চ Side এ অপেক্ষা করছে। আমি তাড়াতাড়ি Enquary তে গিয়ে বললাম, আমি হারিয়ে গেছি।

ওরা আমাকে বলল ভয় পেও না নিচে পুলিশ বুথ আছে ওদের বলো, তোমার Husband এর কাছে পৌঁছে দিয়ে, তোমার পাসপোর্ট দেখবে। আমি নিচে পুলিশের কাছে গেলাম। গিয়ে যে পুলিশ আমাকে ওখানেই দাঁড় করিয়ে গিয়েছিল তাকে পেলাম। সেও আমাকে চিনতে পারল।

সে আমাকে জিজ্ঞেস করল আমার  কোথায় আমার জন্য অপেক্ষা করছে? তাকে বলতেই, সে আমাকে দানীর কাছে নিয়ে গেল এবং আমার পাসপোর্ট দেখল। সে দানীকে বললো আমি International side এ চলে গিয়েছিলাম। দানী আমাকে খুব বকা দিল। আমাকে বলল দৌড়াতে, কারণ পাঁচ মিনিটের মধে্য প্লেন ছাড়বে। আমরা সম্ভবত প্লেন গরংং করব। ঘোরাঘুরি করে পয়সাও সব শেষ। এখন যে জরিমানা দিয়ে টিকেট কাটবো, সেই উপায়ও নেই। যাহোক, প্রাণপনে ছুটতে থাকলাম। চেকিং এ পৌঁছাতেই ওরা বলল, এখনই প্লেন ছাড়বে। আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি। দানী ওদেরকে বলল, আমার হারিয়ে যাবার ব্যাপারটা। ওরা কি মনে করে আমাদের আর কোন চেক না করেই ছেড়ে দিল। দৌড়াতে দৌড়াতে প্লেনে গিয়ে বসলাম। বসা মাত্রই প্লেন ছেড়ে দিল। দানী রাগে আমার সাথে কথাই বলল না।

সে কানে ধরল আমার এই Shopping এর ভুত না নামলে সে আর আমাকে নিয়ে বিদেশে ঘুরতে যাবে না। আমিও তার কাছে Promise করলাম, Shop দেখলেই আমি আর যাব না। Plane এ খাবার দেবার পর, দানী খাবার খেয়ে, পেট ও মাথাঠান্ডা করলো। অতঃপর ঠিক লন্ডন টাইম দুপুর দুইটায়, আমরা লন্ডন সিটি এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছলাম। আমার স্বপ্নের দেশ সুইজারল্যান্ড ভ্রমণ থেকে, আমি এই শিক্ষাটাই পেলাম “এয়ারপোর্ট বা কোন অচেনা দেশে গিয়ে বেশি ঘোরাঘুরি থেকে বিরত থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।” আর একটি বিষয়ে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। সেটা হোল “বিদেশে ভ্রমণের সময় অবশ্যই নিজের পাসপোর্ট নিজের কাছে রাখা উচিৎ এবং মোবাইল ফোন সবসময় সংগে থাকবে।”

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com