লন্ডনের ভোরের বাতাসে বুকভরে শ্বাস নিতে-নিতে এসে পৌঁছলাম, মধ্য-লন্ডনের সদা-ব্যস্তময় কিংস-ক্রস রেলওয়ে স্টেশনে। প্ল্যাটফর্মে তখন অপেক্ষারত আদ্যন্ত লাল রঙের একটা ট্রেন, যার নাম অ্যাজুমা ভার্জিন। ট্রেন যখন ছাড়ল, তখন ঘড়ির কাঁটায় ঠিক সকাল সাতটা। আমাদের গন্তব্য স্বপ্নের দেশ স্কটল্যান্ডের রাজধানী শহর এডিনবরা।
লন্ডন শহরের ব্যস্ত জীবন ছাড়িয়ে অ্যাজুমা ভার্জিন এগিয়ে চলল পিটারবার্গ, ইয়র্ক, ডার্লিংটন পেরিয়ে গ্রাম্য প্রকৃতির বুক চিরে। টাইন নদী পার হতেই বাঁদিকে চোখে পড়ল একটা বড় শহর। কেউ যেন একই মাপের সারি-সারি ছোট-ছোট খেলনার বাড়ি অতি যত্ন করে বসিয়ে দিয়েছে। রেল লাইনের অপর প্রান্তে ডানদিকে সবুজ প্রান্তরের মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি-সারি অগুন্তি কারখানা। কোথাও কোনও তেল-কালি নেই। ট্রেন এসে পৌঁছেছে নিউ ক্যাসল্ আপন টাইন-এ।
টুইড নদী অতিক্রম করে ট্রেন ঢুকে পড়ল বারউইক আপন টুইড স্টেশনে। ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের বিভাজন রেখা টুইড নদী। সবুজ প্রান্তরের মাঝে-মাঝে ছোট-ছোট নগরী; আর তার পিছনে, ট্রেনের গতিপথের সঙ্গে সমানে এগিয়ে চলেছে, আদিগন্ত সামুদ্রিক সবুজ রং মাখানো নর্থ-সি। বেলা বারোটা নাগাদ ট্রেন এসে পৌঁছল আমাদের গন্তব্য স্টেশন, এডিনবরা ওয়েভারলি-তে।
ট্রেন থেকে নেমে, অন্তত চার ধাপ এস্ক্যালেটরের সাহায্যে উপরে উঠে, রাজপথের সামনে এসে দাঁড়াতেই, প্রথম বিস্ময় নীল আকাশের মাঝে সাদা মেঘের ভেলা থেকে, কিছুক্ষণের জন্য চোখেমুখে ইলশে-গুড়ির ঝাপটা। তাতে কারও কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই; শহর রয়েছে শহরের ব্যস্ততায়। এইভাবে প্রিন্সেস স্ট্রিটের উপরে দাঁড়িয়ে, নতুন প্রকৃতিকে কিছুক্ষণ অনুভব করার পরে, পিছনে বাঁদিকে তাকাতেই নজরে পড়ল এডিনবরা ক্যাসল ও স্কটিশ মনুমেন্ট-এর চূড়া। এডিনবরা ক্যাসল-হিলের পাদদেশ থেকে এডিনবরা শহরের প্রাণকেন্দ্র, প্রধান সড়ক রয়্যাল মাইল পশ্চিম থেকে ধীরে-ধীরে পূর্ব দিকে এগিয়ে গিয়ে একটু বাঁক খেয়ে হলিরুড প্যালেসের প্রান্তে গিয়ে থেমেছে। গথিক শৈলীর নিদর্শন গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে, স্কটল্যাণ্ডের সবচেয়ে বড় হোটেল হোটেল বালমোরাল। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের গ্রীষ্মকালীন আবাসস্থল। প্রতি গ্রীষ্মে যে এক সপ্তাহ এই রাজপ্রাসাদে অতিবাহিত করেন রানি। এই রাজপ্রাসাদের উত্তর পশ্চিম প্রান্তের গথিক নির্মাণ শৈলী প্রথম জর্জের সমকালীন, ষষ্ঠদশ শতকের। বাকি রাজপ্রাসাদ সপ্তদশ শতকের কীর্তি বহন করছে। কেবল মাত্র রাজপ্রাসাদের সম্মুখস্থ ফোয়ারাটি ভিক্টোরিয় যুগের সৃষ্টি।
স্কটল্যান্ডের রাজা প্রথম ডেভিড হলিরুড রাজপ্রাসাদের নীচের তলায়, ১১২৮ সালে যখন অগাস্টানিয় হলিরুড অ্যাবের পত্তন করেছিলেন, ঠিক তার প্রাক্কালে একটা পবিত্র ক্রস তিনি দর্শন করেছিলেন, যাকে স্কটিশ বা গেলিক ভাষায় বলা হয়, হলি রুড (Holy Rood)। হলিরুড প্যালেসের প্রবেশপত্র ক্রয় করে হিয়ারিং ইলেকট্রনিক টুর গাইডকে সঙ্গী করে, পশ্চিমপ্রান্তের দরজা দিয়ে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করলাম। রাজপ্রাসাদের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে শুরু করে, পূর্বমুখী পথে অগ্রসর হয়ে বামাবর্তে ঘুরে, পঞ্চম জেমস, ষষ্ঠ জেমস, মহারানি ভিক্টোরিয়া-সহ সকল রাজারানির বৈঠকখানা, শয্যাগৃহ, দরবারকক্ষ, সিংহাসনাদি দর্শন করতে-করতে এগিয়ে চললাম। সঙ্গী ‘ভ্রমণ-সঞ্চালক’ যন্ত্রটির বোতাম টিপলেই, সে জানিয়ে দিচ্ছে সম্মুখস্থ গৃহ, আসবাব-সামগ্রী, তৈলচিত্র, সিংহাসন, অস্ত্রশস্ত্রাদির যাবতীয় ইতিহাস। অবশেষে এসে পৌঁছলাম রাজপ্রাসাদের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের, পাঁচ শতাব্দী প্রাচীন এক সংকীর্ণ লোহার সিঁড়ি বেয়ে, প্রায় আশি-নব্বই ডিগ্রি খাঁড়া পথ অতিক্রম করে, রাজপ্রাসাদের তিনতলায় অবস্থিত ‘মেরি, কুইন অফ স্কটস’ নামে খ্যাত স্কটল্যান্ডের সর্বজনপ্রিয় মহারানি মেরির কক্ষে। সে এক রক্তাক্ত ইতিহাস কুইন অফ স্কটসের! শুনতে শুনতে হলিরুড প্যালেস পরিভ্রমণ সেরে, রাজপ্রাসাদের নিকটস্থ হলিরুড রোডের একটা পূর্ব-সংরক্ষিত গেস্ট-হাউসে এসে উঠলাম।
হলিরুড রোডের পথ-প্রান্তের একটা লোহার রেলিং-এর গায়ে ঝোলানো একটা বাক্সের উপর প্রোথিত বোতাম টিপতেই বাক্সটার ঢাকা খুলে গেল। বাক্সের ভিতর থেকে গেস্ট-হাউসের চাবি বের করে, কোথাও কোনও ব্যক্তির মধ্যস্থতা ছাড়াই গেস্ট-হাউসে প্রবেশ করাটা, আমার কাছে এক বিস্ময়ের বিস্ময় হয়ে রইল। গেস্ট-হাউসের কাচের রেলিং দিয়ে ঘেরা বারান্দায় বসে দৃষ্টি কাড়ল রোদ ঝলমলে পাহাড় আর্থার সিট। বহু মানুষ ধীরে-ধীরে পাহাড়ের পূর্ব-দিকের গা বেয়ে উপরে উঠছে, পাহাড়-চড়া শিখতে। আর্থার-সিট শব্দটা এসেছে গেলিক ভাষায় Ard-Na-Said শব্দ থেকে, যার অর্থ—Height of Arrows। এই শব্দটা ব্যবহৃত হয় ধনুর্ধরদের পাহাড়-চূড়া পর্যন্ত তির নিক্ষেপের প্রচেষ্টা ক্ষেত্র বোঝাতে। রাত যখন দশটা বাজে, তখন তীব্র রোদের ঠেলায় মনে হল যেন কলকাতার গ্রীষ্মের দুপুর দুটোর সময়ের সূর্যের তেজ। আর সঙ্গে ঠান্ডা ঝোড়ো বাতাস।
পরদিন সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠে, সারাদিনের মতো তৈরি হয়ে, রেডিমেড ব্রেকফাস্ট-এর বাক্স হাতে নিয়ে সপরিবারে বেরিয়ে পড়লাম স্কটল্যাণ্ডের উত্তরপ্রান্তের হাইল্যান্ডস, লক লোমন্ডস, লক ক্যাটরিন এবং হাইল্যাণ্ডসের ঘরের পশু হেয়ারি কু (Hairy Coo) দর্শনের উদ্দেশ্যে। গেলিক ভাষায় Cow-কে ‘কু’ বলে অভিহিত করা হয়। এডিনবরা শহরের প্রাণকেন্দ্র রয়্যাল মাইলের উপর থেকে বাস ছাড়ল সকাল সাতটায়। হংকং, জাপান, পর্তুগাল ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ থেকে আগত পর্যটকদের মাঝে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের যাত্রী হিসাবে উপস্থিত আমরা জনা-আটেক ভারতীয়।
এডিনবরা থেকে ছাড়ার পরে, আমাদের বাস প্রথমে এসে থামল ফলকির্কে। উদ্দেশ্য কেলপি দর্শন। সুবিস্তৃত সবুজ ক্ষেতের মাঝে ফোর্থ অ্যান্ড ক্লাইড ক্যানেলের সংযোগস্থলে ৯৮ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট দুটি অশ্বমুখ, পরস্পরের থেকে প্রায় ১০০ ফুট দূরত্বে অবস্থিত হওয়া সত্বেও, দূর থেকে দেখে মনে হয় দুটি যুক্ত অশ্বমুখ। এর স্রষ্টা স্থপতি অ্যাণ্ডি স্কট। স্কটিশরা বিশ্বাস করেন, এই ‘কেলপি’ হচ্ছে এক অশ্বদৈত্য বা মনস্টার। এর আবাসক্ষেত্র হচ্ছে যে কোনও লেক বা জলাশয়; বিশেষ ক’রে ‘লক্ নেস’-এ(Loch Ness-এ)। গেলিক ভাষায় Lake-কে Loch বলা হয়। কেলপি তার দৈত্যরূপ পরিবর্তন করে, নারীরূপে জলাশয়ের তীরে ঘুরতে আসা শিশুদের সঙ্গে প্রথমে বন্ধুত্ব পাতায়। পরে তাদেরকে পিঠে করে নিয়ে জলাশয়ের গভীরে গিয়ে তাদের ভক্ষণ করে। জনশ্রুতি, এই লোকগাথা স্কটিশ শিশুদের একাকী জলাশয়ের তীরে উপস্থিত হওয়ার থেকে সবসময় বিরত রাখে।
‘কেলপি’ দর্শন শেষে, স্কটল্যাণ্ডের আদিগন্ত বিস্তৃত বিন্যস্ত সবুজ তৃণভূমির মাঝ দিয়ে উঁচু নীচু পথ দিয়ে বাস এসে থামল স্টার্লিং ক্যাসলের সামনে। স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের সংযুক্তির পূর্বে, যেমন বহু স্কটিশ রাজপরিবারের আবাসগৃহ ছিল এই ক্যাসল। বহু স্কটিশ রাজা-রানির সিংহাসনে অভিষেক অনুষ্ঠানের সাক্ষীও। স্কটিশ বীর রবার্ট ব্রুসের মর্মর মূর্তি আজও এই বীরগাথার সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। তবে এই স্টার্লিং ক্যাসলকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তিন স্টুয়ার্ট বংশীয় স্কট রাজা – চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ জেমস। এই জেমস্ রাজারা নিজেদেরকে হারকিউলেসের সমান বলবান বলে মনে করতেন। আর তার প্রমাণ স্বরূপ ক্যাসল কক্ষে চিত্রায়িত হারকিউলেসের দ্বাদশ শ্রমদানের কাহিনিতে হারকিউলেসের পরিবর্তে নিজেদের অবয়ব চিত্রায়িত করেছেন।
এবার বাস এসে থামল ট্রসাক ন্যাশনাল পার্ক আর লক ক্যাটরিনের প্রবেশ পথের মুখে অবস্থিত ছোট গ্রাম অবরফুইল-এ। এই গ্রামের লোকসংখ্যা মাত্র হাজার খানেক। ছবির মতো সুন্দর লাল-সাদা রঙের সমদর্শন শ-দুয়েক দোতলা বাড়ি নিয়ে ব্যপ্ত এই অবরফুইল গ্রাম। এর ঝাঁ-চকচকে পথঘাট আমাদের দেশের যে কোনও শহরকেও লজ্জা দেয়। এখান থেকেই পায়ে-পায়ে হেয়ারি-কু, লক মেনটিথ দর্শন সেরে, ঘুরতে-ঘুরতে এসে পৌঁছলাম লক ক্যাটরিনের সামনে। লক ক্যাটরিন শব্দের উৎপত্তি ‘কিথেইর্নে’(Ceathairne) শব্দ থেকে। স্থানীয় গেলিক ভাষায় যার অর্থ হ’ল, গরু-চোর বা Cow-Lifter ।
স্কটিশ হাইল্যাণ্ড পরিভ্রমণ করে এডিনবরা ফেরার পথে আমাদের ভ্রমণ সঞ্চালক বাস দাঁড় করালেন ডিনস্টন ডিস্টিলারির সামনে। ওরা পাহাড়ি ‘টিথ’(Teith) নদীর অবিশ্রান্ত জলধারাকে কাজে লাগিয়ে, কীভাবে নিজেদের কৃষিক্ষেত্রে উৎপন্ন বার্লি ফারমেন্ট করে স্কচ প্রস্তুত করছে, তা ভ্রমণ সঞ্চালকের কাছ থেকে অবগত না হলে স্কটল্যান্ডে নামের স্মারক পানীয় ‘স্কচ’ প্রস্তুতিকরণের কঠোর নিয়মবিধি সংক্রান্ত জ্ঞানলাভ অধরাই থেকে যেত। বাস যখন এডিনবরা শহরে ফিরে এল, সূর্য তখন সবে মাঝ-আকাশ পার করছে। সময় তখন দিনের ছদ্মবেশে সন্ধে সাড়ে ছ’টা। এডিনবরা শহরের প্রাণকেন্দ্র রয়াল মাইলের উপরে এসে বাস থামতেই, আমাদের স্কটিশ হাইল্যান্ড পরিভ্রমণ শেষ হল। কিন্তু পূর্ব-নির্ধারিত ভ্রমণ-সূচি অনুসারে আমাদের জন্য তখন অপেক্ষা করছে ঘোস্ট বাস টুর।
এডিনবরা ক্যাসল্ থেকে পূর্বমুখী যে রয়াল মাইল সড়ক এগিয়ে চলেছে, সেই সদা ব্যস্ততাময় সড়কের দু-ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে ত্রয়োদশ, চতুর্দশ শতকের মস্ত-মস্ত সব বাড়ি। পরস্পরের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সংযুক্ত অবস্থায়, একে অপরের সঙ্গে গায়ে-গা লাগিয়ে। অধিকাংশ বাড়ির ঠিক মাঝখান দিয়ে গুহাপথের মতো সংকীর্ণ একটা পথ। সেই বাড়ির পিছন দিকে অগ্রসর হয়ে, গিয়ে মিশেছে বহু দূরের কোনও রাজপথের সঙ্গে। এই গলিগুলিকে স্থানীয় ভাষায় বলে ক্লোস। রয়াল মাইলের উপরে লন-মার্কেট অঞ্চলে ব্রডি’জ ক্লোস নামক এইরকম একটা ক্লোস-এর সামনে থেকে বাস ছাড়ল। রাত্রি তখন ঠিক সাড়ে-আট’টা।
সেন্ট গাইলস্ ক্যাথিড্রালের গা-দিয়ে যে হাই-স্ট্রিট এসে রয়াল মাইলকে দ্বিখণ্ডিত করেছে, সেই হাই-স্ট্রিটের উপর অবস্থিত মেরি কিং’স্ ক্লোস-এর সামনে এসে বাস থামল। এই ক্লোস নীচে নেমে গিয়েছে এডিনবরা ওয়েভারলি স্টেশনের দিকে। বর্তমানে যেখানে এডিনবরা স্টেশন দাঁড়িয়ে রয়েছে, ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে সেখানে ছিলো নর-লক নামে একটা লেক বা জলাশয়। তৎকালীন শহুরে মানুষ যদি কেউ জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা করতেন, স্কটল্যান্ডের তৎকালীন রাজারা তাদের থেকে নিজেদের পতন সংক্রান্ত বিপদ আশঙ্কা করে, ওই ব্যক্তিদেরকে ডাইনি বা উইচ আখ্যা দিয়ে, শাস্তিস্বরূপ ঐ নর-লক্-এর জলে ছুড়ে ফেলে দিতেন। তাদের সন্তানদেরও ওই একই শাস্তি প্রদান করতেন। পরবর্তীকালে শহরের পুলিশ প্রশাসনও রাজ-আদেশে ওই রয়াল মাইল অঞ্চলের নীচে ভল্ট তৈরি করে সাজাপ্রাপ্ত নগরবাসীকে বন্দি করে সেখানে ঠেলে ফেলে দিত।
ডাকিনীবিদ্যা চর্চার অভিযোগে ছাল ছাড়িয়ে, অত্যাচার করে ১৫৯২ সালে রাজ-আদেশে যে অ্যাগনেস স্যাম্পসনকে হলিরুড প্যালেসের অভ্যন্তরে মেরে ফেলা হয়েছিল, তাঁর আত্মা কীভাবে সেই রাজপ্রাসাদের কক্ষে-কক্ষে কেশবিহীন নগ্নাবস্থায় আর্তনাদ করে ঘুরে বেড়ায়; তার যেমন বিবরণ পাওয়া গেল, তেমনই ভ্রমণ সমাপ্তির মুহূর্তে ঘোস্ট বাস যখন রয়াল মাইল সড়কের উপরে ব্রডি’জ ক্লোস-এর সামনে এসে দাঁড়াল, তখনই টের পাওয়া গেল কীভাবে ডিকন ব্রডি’র আত্মার ক্রন্দন ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছে ব্রডি’জ ক্লোস-এর অভ্যন্তরে। রয়াল মাইলের ক্যাননগেট অঞ্চলে প্রকাশ্য রাজপথে ফাঁসিপ্রাপ্ত, এই ডিকন ব্রডি দিনের বেলায় ছিলেন এডিনবরা শহরের একজন অভিজাত মানুষ; আর রাতের অন্ধকারে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানির সুবাদে হয়ে উঠেছিলেন এক অপ্রতিরোধ্য দুষ্কৃতী। রবার্ট লুইস স্টিভেনসন লিখেছিলেন তার যুগান্তকারী উপন্যাস ‘স্ট্রেঞ্জ কেস অব্ ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গতে বেশ বেল হয়ে গেল। আমাদের লন্ডন ফেরার ট্রেন ছিল সেদিন বিকেলে। মধ্যাহ্নভোজ সেরে গেস্ট-হাউস ছেড়ে প্রথমে গেলাম, গেস্ট-হাউসের সামনের হলিরুড রোডের ওপারে রাস্তার ধারের রেলিং-এ ঝোলানো সেই বাক্সের নিকটে। বাক্সের উপরে প্রোথিত বোতাম টিপতেই বাক্স খুলে গেল। বাক্সের ভিতরে গেস্ট-হাউসের চাবি রেখে দিয়ে, বাক্স বন্ধ করে, বেরিয়ে পড়লাম এডিনবরা শহরের মুখ্য আকর্ষণ এডিনবরা ক্যাসল দেখতে। রয়াল মাইল সড়কের পশ্চিমপ্রান্তে সুউচ্চ পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত এডিনবরা ক্যাসল।
রয়াল মাইলের উপর থেকে আবার একটা ব্ল্যাক-ক্যাব ধরে, পৌঁছে গেলাম ‘ডিনবরা ওয়েভারলি রেলওয়ে স্টেশনে। পিছনে পড়ে রইল অভিজাত রয়াল মাইল, এডিনবরা ক্যাসল, হলিরুড প্যালেস, স্টার্লিং ক্যাসল্, হেয়ারি কু আর লক্ ক্যাটরিন। অ্যাজুমা ভার্জিনে সওয়ার হয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যেতে-যেতে, স্কটল্যান্ডের শেষ সীমা টুইড নদী পার হতেই মনটা একটা বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। পিছনে ফেলে আসা মোহময়ী, স্বপ্নসুন্দরী স্কটল্যান্ডের জন্য।