তুরস্কে পা রাখার পর প্রায় তিন মাস পেরিয়ে গেছে। ইরাসমাস প্লাস এক্সচেঞ্জ স্টাডি প্রোগ্রামের আওতায় এক সেমিস্টার সম্পন্ন করার জন্য কুতাহইয়া ডুমলুপিনার বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি। দেখতে দেখতে সে এক সেমিস্টারও প্রায় শেষের দিকে। অন্যদিকে রোজার সময়ও ঘনিয়ে এসেছে।
মেন্টর হিসেবে তাই আয়তেনকে খুব বেশি কাছে পাওয়ার সুযোগ হয়নি, তবে একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে তার সঙ্গে প্রায়ই ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হতো। সারা দিনের ক্লান্তি শেষে সন্ধ্যায় সে আমার ডরমিটরির নিচে অপেক্ষা করত, এরপর তাকে নিয়ে কুতাহইয়ার বিভিন্ন স্থানে একসঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম, কফি শপে বসে আড্ডা দিতাম। আয়তেন খুব ভালো গিটার বাজাত।
আমাদের অনেকের মধ্যে একটি প্রশ্ন প্রায়শ ঘুরপাক খায়, ছেলে আর মেয়ে কি পরস্পর পরস্পরের ভালো বন্ধু হতে পারে, প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক ছাড়া। আমার উত্তর, অবশ্যই পারে, তুরস্কে আয়তেন ছিল আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের একজন। যখনই তার সঙ্গে আমার দেখা হতো, সে আমাকে জড়িয়ে ধরত এবং আমার বাঁ গালে দুবার এবং ডান গালে একবার চুমু আঁকত। আমিও একইভাবে তাকে জড়িয়ে ধরতাম এবং তার দুই গালে চুমু দিতাম। একটা বিষয় নিয়ে খুনসুটি হতো অবশ্য, আমি ছেলে হওয়ার পরও আমার কাছে লম্বা চুল ভালো লাগে বেশি। অন্যদিকে আয়তেন মেয়ে হওয়ার পরও সে বেশির ভাগ সময়ই ছেলেদের মতো ছোট চুল রাখতে পছন্দ করত। চুলের বিষয়টি নিয়ে প্রায়ই তর্ক হতো, যদিও ঠাট্টার ছলে সে তর্কের অবসান হয়ে যেত।
আয়তেনের পৈতৃক নিবাস ছিল আনতালিয়াতে। তুরস্ক থেকে চলে যাওয়ার আগে আয়তেন আমাকে অন্তত একবারের জন্য হলেও আনতালিয়া ভ্রমণের পরামর্শ দিয়েছিল। তার বাসায় যাওয়ার জন্যও আমন্ত্রণ জানিয়েছিল কিন্তু সময়ের অভাবে সেটি আর হয়ে ওঠেনি।
ন্যাভিগেশনের জন্য তুরস্কে গুগল ম্যাপের পরিবর্তে মুভ ইট ব্যবহার করা হয় বেশি। আনতালিয়ার সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডে পা রাখার পর তাই মুভ ইট ব্যবহার করে চলে যাই নির্ধারিত হোটেলে।
অবকাশ যাপনের কেন্দ্র হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ আনতালিয়ায় জড়ো হন। ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত এ শহরের সুখ্যাতি বিভিন্ন সমুদ্রসৈকতের জন্য। বিশেষত রাশিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের কাছে আনতালিয়া একটি জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল। আনতালিয়া থেকে জাহাজযোগে সরাসরি দ্বীপরাষ্ট্র সাইপ্রাসে ভ্রমণ করা যায়। গ্রীষ্মকালে তুরস্ক, আজারবাইজানসহ আশপাশের দেশগুলো থেকে অনেকে আনতালিয়ায় পাড়ি জমান, বিশেষত গ্রীষ্মকালীন চাকরির জন্য ব্যাপকসংখ্যক তরুণ ও তরুণী আনতালিয়ার হোটেল, রিসোর্ট ও পার্টি সেন্টারগুলোর মুখাপেক্ষী থাকে।
১৩৪৫ থেকে ১৩৫০ সালের মধ্যে কোনো এক সময় মরক্কোর বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা আনতালিয়া পরিদর্শনে আসেন। আনতালিয়াকে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শহরগুলোর একটি হিসেবে আখ্যা দেন। অ্যাপ্রিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের শুকনা ফল উৎপাদনে সে সময় আনতালিয়ার খ্যাতি ছিল বিশ্বব্যাপী। সেলজুকদের শাসনামলে আনতালিয়ায় ইসলামের বিস্তৃতি ঘটে, সেলজুকদের হাত ধরে শহরটির নামকরণ করা হয় ‘আনতালিয়া’।
আনতালিয়ার মূল শহরের প্রাণকেন্দ্র মুরাতপাশায় ইভলি মিনারে নামে একটি মসজিদ রয়েছে। বর্তমানে এটি অবশ্য একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। মসজিদটি নির্মাণ করা হয় ১২৩০ সালে। সেলজুক রাজবংশের স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন হিসেবে মসজিদটি আজও দণ্ডায়মান। ১৩৯১ সালে আনতালিয়া অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
ঐতিহাসিকভাবে আনতালিয়া শহরটি আনাতোলিয়ার এক ক্ষুদ্র অংশ ছিল। এশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত আনাতোলিয়া নামের অঞ্চলটি হচ্ছে একটি উপদ্বীপ। তুরস্কের মোট আয়তন প্রায় ৩ লাখ ২ হাজার ৪৫৫ বর্গমাইল, যেখানে আনাতোলিয়ার মোট আয়তন প্রায় ২ লাখ ৯১ হাজার ৭৭৩ বর্গমাইল। তবে তুরস্কের স্থানীয় অধিবাসীরা আনাতোলিয়া নামটির সঙ্গে পরিচিত নয়, তারা আনাতোলিয়ার পরিবর্তে আনাদুলু শব্দটি ব্যবহার করে। আনাতোলিয়া উত্তরে কৃষ্ণসাগর, পূর্বে আর্মেনিয়ান উচ্চভূমি, দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর এবং পশ্চিমে এজিয়ান সাগর দ্বারা সংযুক্ত। প্রাচীনকালে গ্রিকরা আনাতোলিয়াকে ‘মিকরা এশিয়া’ নামে সম্বোধন করত। মিকরা এশিয়া থেকেই এশিয়া মাইনর শব্দটির উৎপত্তি।
আনাতোলিয়কে মুক্ত করার মাধ্যমে জন্ম হয় আধুনিক তুরস্কের। কয়েক শতাব্দী আগে অটোমান সাম্রাজ্যের শুরুটাও হয়েছিল এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। ১৯২৩ সালে লুজার্ন চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগপর্যন্ত আনাতোলিয়া অঞ্চলে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গ্রিকদের বসবাস ছিল। লুজার্ন চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর এদের সবাইকে গ্রিসে চলে যেতে হয়। বিপরীতক্রমে গ্রিসে বসবাস করা তুর্কি জাতিগোষ্ঠীর মানুষকেও এ চুক্তির মধ্য দিয়ে তুরস্কে নিয়ে আসা হয়। গত শতাব্দীর তৃতীয় দশকে এটা ছিল বিরাট মানব বিনিময়। প্রায় ১৫ লাখ লোক এ পরিকল্পনায় বাস্তুচ্যুত হয়েছিল।
২০১৫ সালে জি-২০ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল আনতালিয়া শহরে, তৎকালীন সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং বর্তমান সময়ের রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন।
ফেসবুকের কল্যাণে আমার সঙ্গে আগে থেকেই এক ‘স্বদেশি ভাই’য়ের পরিচয় হয়েছিল। তাঁর নাম নুরুল্লাহ মোহাম্মদ এবং তিনি আনতালিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করছিলেন আর্কিটেকচারের ওপর। আমি আনতালিয়ায় বেড়াতে আসব, এ কথা শুনে আগে থেকেই তিনি এক দিন বরাদ্দ রেখেছিলেন আমার জন্য, তাঁর সঙ্গে আনতালিয়া ঘুরে দেখা।
সত্যি কথা বলতে গেলে আমাকে আনতালিয়া তেমন একটা আকর্ষণ করেনি। যদিও আনতালিয়া সম্পূর্ণরূপে পর্যটননির্ভর একটি শহর, এ শহরের অবকাঠামো যে খুব বেশি পরিকল্পিত, তেমনটা বলার সুযোগ নেই। রাস্তাঘাটও তেমন একটা পরিচ্ছন্ন নয়। শহরের অট্টালিকাগুলোকেও আমার কাছে কিছুটা পুরোনো মনে হয়েছে। আনতালিয়ায় আসার পর তাই ক্ষণিকের জন্য আমার মনে হচ্ছিল আমি ঢাকায় এসেছি।
আনতালিয়া তুরস্কের সবচেয়ে সেক্যুলার অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি, আনতালিয়ার স্থানীয় অধিবাসীরাও ধর্মীয় অনুশাসন পালনে তেমন একটা অভ্যস্ত নয়। তুরস্কের অন্যান্য শহরের মতো ইজমির, আনতালিয়া, ইশকেশেহির, এদরিনে, চানাক্কালে, মার্সিন—এসব শহরে হরহামেশা খুব একটা মসজিদের দেখা মেলে না। জোহরের নামাজ আদায়ের জন্য যখন মসজিদে যাই, তেমন একটা মুসল্লিও খুঁজে পাইনি।
বিভিন্ন ধরনের সমুদ্রসৈকতের জন্য আনতালিয়া সমগ্র তুরস্কের মধ্যে অন্যতম প্রধান পর্যটনকেন্দ্র। ভূমধ্যসাগরের গাঢ় নীল জলরাশি এখানকার সি বিচগুলোর প্রাণ। আনতালিয়ায় আসা পর্যটকদের বেশির ভাগই কোনিয়ালটি এবং লারা—এ দুই সি বিচে পাড়ি জমান। আনতালিয়ার মূল শহরের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত মুরাতপাশার গা ঘেঁষেই কোনিয়ালটির অবস্থান। ভূমধ্যসাগরের গাঢ় নীল জলরাশি এবং তাউরুস পর্বতমালার সমন্বিত রূপ কোনিয়ালটিকে অপরূপ সৌন্দর্যে সাজিয়ে তুলেছে।
লারা বিচের অবস্থান অবশ্য শহর থেকে একটু বাইরে। কোনিয়ালটির মতো লারা তেমন একটা রূপবতী নয়। আনতালিয়াতে বেড়াতে আসার পর আমার মাথায় একটি বিষয় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল, পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকতের মালিক বাংলাদেশ। প্রায় ৯৩ মাইল দীর্ঘ এ সমুদ্রসৈকতের বেশির ভাগ অংশ বালি দ্বারা পরিপূর্ণ। অথচ আনতালিয়ার সি বিচগুলোর বেশির ভাগ পাথুরে, বালির অংশ অনেকটা কম। ছোট ছোট নুড়িপাথরের জন্য অনেক সময় হাঁটতে কষ্ট হয়ে যায়, তারপরও আনতালিয়াতে পর্যটকের অভাব হয় না কখনো।
আনতালিয়ার ওল্ড টাউনকে ‘কালেচি’ নামে অভিহিত করা হয়। বিভিন্ন সময় আনতালিয়া শাসন করা বিভিন্ন সাম্রাজ্যের শাসকদের স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় এ কালেচিতে। রোমান শাসনামলে নির্মিত তোরণ হেড্রিয়ান গেট, হিদিরলিক টাওয়ারসহ সেলজুক রাজবংশের শাসনামলে নির্মিত ইভলি মিনারে মসজিদ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার অবস্থান এখানে। কালেচি থেকে কোনিয়ালটির সি বিচের দিকে চোখ বাড়ালে এক অসাধারণ সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট সৌন্দর্য এখানে যেন একই বিন্দুতে মিলিত হয়।
কোনিয়ালটি ছাড়াও আনতালিয়ার আরও একটি স্পট আমাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করেছে। সেটি হচ্ছে ডুডেন ওয়াটার ফল। আনতালিয়ার মূল শহর থেকে সাড়ে সাত মাইল উত্তর পশ্চিমে এ ওয়াটার ফলের অবস্থান। ডুডেন ওয়াটার ফল আপার এবং লোয়ার—এ দুই অংশে বিভক্ত, লোয়ার অংশটি সরাসরি ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী অংশের সঙ্গে মিশেছে। ডুডেন ওয়াটার ফলের আপার অংশটি একেবারে অনন্যসাধারণ।
ডুডেন ওয়াটার ফলের আপার অংশে আসার পর আমার মাথায় বারবার সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ঝর্ণা’ কবিতাটির এ লাইনগুলো মাথায় ঘুরছিল।
এই ছিল মোটামুটিভাবে আমার আনতালিয়া ভ্রমণের গল্প। তবে আয়তেনকে আমি ভুলিনি, সে-ও আমাকে ভোলেনি। তার সঙ্গে এখনো আমার মাঝেমধ্যে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ হয়। কুতাহইয়া ডুমলুপিনার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে সে স্নাতক শেষ করেছে। বর্তমানে আয়তেন তুরস্কের বিখ্যাত মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি তুর্কসেলে কাজ করছে, এখন সে ইস্তাম্বুলে থাকে। আমাকে সে প্রায়ই তুরস্কে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়, প্রতিবার চ্যাট শেষে সব সময় সে একটি কথা বলে আমার উদ্দেশে, ‘মাই হোম ইজ ওয়েলকামিং ইউ অলওয়েজ।’
লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া