নেত্রকোনার মাহবুব আলম কাজ করেন সিঙ্গাপুরের পেইন্টিং ঠিকাদারের সঙ্গে। একদিন কাজ শেষে ট্রেনে করে বাসায় ফেরার সময় টের পেলেন বাসা থেকে অনেকবার ফোন এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে জানতে পারেন বাড়িতে মা অসুস্থ। অস্থির মাহবুব ভাবলেন বাড়ি যাওয়া দরকার। কিন্তু ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। কোনো ট্রাভেল এজেন্টের অফিস খোলা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। বন্ধুরা তাঁকে ‘হোমটাউন’ অ্যাপ ইনস্টল করতে বললেন। বন্ধুদের পরামর্শে ট্রেনেই অ্যাপটি ডাউনলোড করে নিজের আইডি দিয়ে অ্যাকাউন্ট ভেরিফিকেশন করেন মাহবুব। তারপর টিকিট কাটার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখেন, পরদিন ভোরবেলায় ঢাকায় যাওয়া যাবে।
কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব! অবাক হয়ে মাহবুব হোমটাউনের হটলাইনে ফোন করেন এবং নিজ ভাষায় কথা বলতে পেরে সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যান। তখনই নিশ্চিন্তে অ্যাপে টিকিট কেটে পরদিনই নেত্রকোনায় অসুস্থ মায়ের কাছে পৌঁছে যান। ঘটনাটি ছয় মাস আগের। ‘মা এখন অনেক সুস্থ আছেন’—ফোনে প্রথম আলোকে বলেন মাহবুব। আরও জানালেন, মা প্রায়ই বলেন বাড়ি যেতে। মা এখন জেনে গেছেন চাইলেই হোমটাউনের সাহায্যে দ্রুত বাড়ি যাওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশি উদ্যোক্তা প্রকৌশলী রিদওয়ান হাফিজ তাঁর উদ্যোগ গো যায়ান (Go Zayan) এই অ্যাপ তৈরি করেছে। গো যায়ান দেশি স্টার্টআপগুলোর মধ্যে বেশ সফল। সাশ্রয়ী মূল্যে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক গন্তব্যে বিমানের টিকিট কাটা যায় গো যায়ান থেকে। বাংলাদেশ ছাড়িয়ে পাকিস্তানেও তাদের টিকিটিং সেবা চালু রয়েছে।
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার সাইফুল ইসলামের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। প্রায় ১০ বছর ধরে সিঙ্গাপুরে থাকা সাইফুল নিজের গ্রামে একটি জায়গা কেনার জন্য পছন্দ করে রেখেছেন।
কয়েক মাস আগে একদিন সকালে বাড়ি থেকে জানানো হলো, জমির মালিক রাজি হয়েছেন কিন্তু বায়নার টাকা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দিতে হবে। ‘আমি সঙ্গে সঙ্গে হোমটাউনের কথা ভেবেছি’—বলেন সাইফুল। ‘আমি নিয়মিত হোমটাউনের মাধ্যমে টাকা পাঠাই। কিন্তু একসঙ্গে এত বেশি টাকা পাঠাইনি। তাই একটু সংশয় থাকলেও হোমটাউনের মাধ্যমে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দিই। আমি পাঠানোর ১৫ মিনিটের মধ্যে জমির মালিককে বায়নার টাকা বুঝিয়ে দিয়েছে আমার পরিবার।’ কথাগুলো বলার সময় উচ্ছ্বসিত ছিলেন সাইফুল। জানালেন হোমটাউনের কারণে তাঁর একটি স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।
মাহবুব বা সাইফুলের মতো দেশের প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার প্রবাসী আছেন সিঙ্গাপুরে। তাঁদের জীবনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ—বাড়িতে যাওয়া-আসা ও সহজে টাকা পাঠানো—পাল্টে দিচ্ছে হোমটাউন অ্যাপ।
বাংলাদেশি উদ্যোক্তা প্রকৌশলী রিদওয়ান হাফিজ তাঁর উদ্যোগ গো যায়ান (Go Zayan) এই অ্যাপ তৈরি করেছে। গো যায়ান দেশি স্টার্টআপগুলোর মধ্যে বেশ সফল। সাশ্রয়ী মূল্যে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক গন্তব্যে বিমানের টিকিট কাটা যায় গো যায়ান থেকে। বাংলাদেশ ছাড়িয়ে পাকিস্তানেও তাদের টিকিটিং সেবা চালু রয়েছে।
প্রথম আলোর কার্যালয়ে বসে একদিন রিদওয়ান জানালেন, দেশের আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের ৬০ শতাংশের টিকিটই প্রবাসীরা কেনেন। কিন্তু ভাষার জটিলতা, অনলাইনে অনভ্যস্ততা, সময় স্বল্পতা এবং সর্বোপরি একশ্রেণির দালালের খপ্পরে পড়ে তাঁরা প্রায়ই ন্যায্য মূল্যে টিকিট কিনতে পারেন না। তাঁদের গবেষণায় দেখা গেছে, ৩২ শতাংশ অভিবাসী শ্রমিক টিকিট কাটার ক্ষেত্রে কমপক্ষে একবার প্রতারণার শিকার হয়েছেন এবং প্রায়ই তাঁরা বাজারমূল্যের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি পরিশোধ করেন টিকিটের জন্য।
আবার প্রায় সব প্রবাসীর স্মার্টফোন থাকলেও তাঁরা অনলাইন পেমেন্ট করতে চান না। কারণ, অভিবাসীদের কাছে এটি জটিল মনে হয়। ভাষার বাধা তো আছেই। এই দুই সমস্যার সমাধানের জন্য রিদওয়ান তৈরি করলেন ‘হোমটাউন অ্যাপ’।
মাহবুব বা সাইফুলের মতো দেশের প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার প্রবাসী আছেন সিঙ্গাপুরে। তাঁদের জীবনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ—বাড়িতে যাওয়া-আসা ও সহজে টাকা পাঠানো—পাল্টে দিচ্ছে হোমটাউন অ্যাপ।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে এটি চালু হয় শুধু সিঙ্গাপুর প্রবাসীদের জন্য। ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ইন্টারফেস, ব্যবহারকারীর চাহিদা বুঝে গাইড করা, যেন গন্তব্যের টিকিট কাটতে পারে। যেমন সিঙ্গাপুর থেকে কেউ টিকিট কাটতে চাইলে বোঝা যায়, তিনি দেশে যেতে চান। ফলে শুধু তারিখ জেনে তাকে টিকিটের অপশন দেখানো যায়। ব্যবহারকারীর পাসপোর্ট, ছবি ইত্যাদি হোমটাউন অ্যাকাউন্ট খোলার সময় নেওয়া হয়ে থাকে। এ জন্য টিকিট কাটার জন্য আর কোনো বাড়তি তথ্যের প্রয়োজন হয় না। আবার হোমটাউন অ্যাকাউন্ট ব্যবহারকারী সিঙ্গাপুরের ব্যাংক হিসাবের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ফলে টিকিট নিশ্চিত হয়ে ব্যবহারকারী ব্যাংকে লেনদেন করতে পারেন। এ জন্য সিঙ্গাপুরের আইন অনুসারে হোমটাউন অ্যাপ ব্যবহারকারীকে একটি কিউআর কোড দেয়। ব্যবহারকারী মুঠোফোনে সেটি সেইভ করেন এবং ব্যাংকের অ্যাপে সেটি আপলোড করলেই টিকিটের টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিশোধ হয়ে যায়। টিকিটও কাটা হয়ে যায়।
মাহবুব বলেন, ‘টিকিট কাটার পুরো কাজটি করতে সর্বোচ্চ তিন মিনিট সময় লাগে। সবচেয়ে বড় কথা কথা, আমাকে কোথাও যেতে হচ্ছে না। ঘরে বসেই আমি টিকিট পেয়ে যাচ্ছি।’ টিকিটের দাম সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে তিনি জেনেছেন, হোমটাউন তাঁকে ন্যায্য দামেই টিকিট দিয়েছে, বাড়তি টাকা নেয়নি।
রিদওয়ান বলছিলেন, গো যায়ান বাংলাদেশের পর পাকিস্তানে ব্যবসা সম্প্রসারণ করে। তারপর তাঁরা সিঙ্গাপুরের কথা ভাবেন। মার্কেট অ্যানালিসিস করার জন্য তাঁরা কোনো সংস্থাকে নিয়োগ দেননি।
রিদওয়ান ও তাঁর কর্মীরা সপ্তাহান্তে সিঙ্গাপুরের মোস্তফা মার্টের ওখানে যেতেন। সেখানে প্রতি শনি ও রোববার প্রবাসী বাংলাদেশিরা জড়ো হয়ে নিজেদের নানান বিষয়ে আলাপের পাশাপাশি বাড়িতে কত কম খরচে টাকা পাঠানো যায়, টিকিট কাটা যায়, কোন ফ্লাইটে একটু বেশি লাগেজ নেওয়া যায় ইত্যাদি আলোচনা করেন। ‘আমরা তাদের সমস্যাগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারি। ফলে টিকিটের সমস্যার সমাধান করাটা আমাদের জন্য সহজ ছিল। কেননা এটাই গো যায়ানের মূল কাজ। টিকিটিং দিয়ে আমরা হোমটাউনের যাত্রা শুরু করি’—বললেন রিদওয়ান।
অল্পদিনের মধ্যেই প্রবাসীরা তাঁদের বলতে থাকেন, টিকিট করার মতোই দেশে টাকা পাঠানোর একটা সহজ অ্যাপ তৈরি করা যায় কি না। কারণ, কম খরচে টাকা পাঠাতে হলে ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাতে হয় এবং সেটার জন্য কর্মদিবসে ব্যাংকে যেতে হয়। আবার মোবাইল ব্যাংকিংয়ে বেশি টাকা পাঠালে বাড়িতে সেই টাকা তুলতে বাড়তি খরচ হয়। যে কয়টা অ্যাপে টাকা পাঠানো যায়, সেগুলোর সার্ভিস চার্জও বেশি। আবার হুন্ডি করে টাকা পাঠালে নিরাপত্তার শঙ্কা থাকে এবং প্রণোদনাও পাওয়া যায় না। এসব ভেবে ‘হোমটাউন রেমিট্যান্স সেবা’ চালুর উদ্যোগ নেন রিদওয়ান।
তবে রিদওয়ানদের জন্য কাজটি সহজ ছিল না। কারণ, রেমিট্যান্স লেনদেনের জন্য সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশে অনেক আর্থিক নিয়ম মানতে হয়। বিশেষ করে হিসাবধারীর কেওয়াইসি (KYC), দেশে কোনো একটি ব্যাংকের সঙ্গে সিঙ্গাপুর থেকে ডিজিটালি টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করা, সেখান থেকে অন্য ব্যাংক বা মোবাইল আর্থিক সেবায় স্থানান্তরের সুযোগ থাকা ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হয়। অবশেষে সব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে ২০২৩ সালের নভেম্বরে হোমটাউন তাদের অ্যাপে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা যোগ করতে সক্ষম হয়।
সাইফুল বললেন, ‘এই অ্যাপের মাধ্যমে শুধু যে সহজে ঘরে বসে টাকা পাঠাতে পারছি তা নয়, বরং যত টাকা পাঠাই না কেন হোমটাউনের সার্ভিস চার্জ মাত্র তিন টাকা (সিঙ্গাপুর ডলার)। অন্য কোনো অ্যাপে টাকা পাঠালে টাকার পরিমাণ বাড়লে সার্ভিস চার্জও বেড়ে যায়।’
বর্তমানে সিঙ্গাপুর-বাংলাদেশ ফ্লাইটের ৩৮ শতাংশ বাজার শেয়ার এবং মাসে ৮ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স প্রসেসিং করে হোমটাউন। এ জন্য মার্কেটিংয়ের পেছনে তাদের কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি।
সিঙ্গাপুরে সফলতার পর হোমটাউন এখন মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবে সেবা সম্প্রসারণের জন্য কাজ করছে। এই বড় বাজারগুলোতে বিভিন্ন নিয়মাবলি, নগদ নির্ভরতা এবং বিস্তৃত কমিউনিটির মতো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে রিদওয়ান আশাবাদী, এখানেও তাঁরা সফল হতে পারবেন।