কূটনীতিক হিসেবে চাকরিজীবনে নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে বারবার আলোচনায় এসেছেন তিনি। কখনো নারীঘটিত বিষয়, আবার কখনো ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় তিন-তিনবার রাষ্ট্রদূত করার প্রস্তাব থেকে প্রত্যাখ্যাতও হয়েছেন। কিন্তু এবার আলোচনায় এসেছেন ভিন্ন একটি ঘটনা নিয়ে। হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে কমপক্ষে ৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা চিকিৎসার খরচ হিসাবে দেখিয়েছেন। আলোচিত এই কূটনীতিকের নাম মো. তৌহিদুল ইসলাম। বর্তমানে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনার পদে দায়িত্বরত আছেন তিনি।
বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডার ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তা এক যুগ ধরে যখন যেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন, সেখানেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দুজন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আস্থাভাজন হওয়ায় কোনো ধরনের জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হয়নি তাঁকে।
তৌহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে সর্বশেষ অভিযোগ উঠেছে অস্বাভাবিক চিকিৎসা ব্যয় দেখানো নিয়ে। সরকারি খাত থেকে টাকা নিয়ে নিজের চশমা মেরামত, দাঁতের চিকিৎসা, স্ত্রীর রূপচর্চা, স্পা খরচসহ নানাভাবে খরচ দেখিয়েছেন তিনি। অথচ ‘ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্ট্রাকশন ফর দ্য গাইডেন্স অব বাংলাদেশ মিশন অ্যাব্রোড’ ১১ অনুচ্ছেদে-২ (iv) এবং মেডিকেল অ্যাটেনডেন্স রুলস ১৯৫৮-এর ২ (i) অনুযায়ী, এসব খাতে টাকা খরচের সুযোগ নেই।
জানা যায়, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে যোগ দেন মো. তৌহিদুল ইসলাম। এর পর থেকে তিনি সর্বমোট ৫ কোটি ৪৭ লাখ ২৪ হাজার ৩০০ টাকা চিকিৎসা ব্যয় হিসেবে দেখিয়েছেন। সম্প্রতি সরকারি একটি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের এ কর্মকর্তা সিঙ্গাপুরে দায়িত্ব পালনকালে প্রতিবছর গড়ে ১ কোটি ৩৬ লাখ ৮১ হাজার ৭৫ টাকা চিকিৎসাবাবদ ব্যয় করেছেন। তাঁর চিকিৎসাবাবদ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ কোটি ৮৩ লাখ ৩৩ হাজার ২০০ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ কোটি ৯ লাখ ৯ হাজার ৮০০ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯০ লাখ ২৯ হাজার ৬০০ টাকা এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬৪ লাখ ৫১ হাজার ৭০০ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে বড় অঙ্কের খরচ দেখানো হয়েছে হাইকমিশনারের চোখের চিকিৎসা, চশমা পরিবর্তনের নামে। পাশাপাশি ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া রেডিয়াম গ্রুপ থেকে স্পার নামেও মোটা অঙ্কের টাকা সরকারি কোষাগার থেকে খরচ দেখানো হয়েছে। চিকিৎসার জন্য খরচে যে বিল-ভাউচার সংযুক্ত করেছেন, তা কম্পিউটার থেকে তৈরি করে প্রিন্ট করা বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এসব বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে হাইকমিশনার মো. তৌহিদুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যেসব টাকা খরচ করা হয়েছে, তা ভিআইপিদের জন্য। আমি কোনো টাকা খরচ করিনি। আর আগে যেসব অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়েছিল, তা থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, তৌহিদুল ইসলামকে নিয়ে সব সময় কিছুটা অস্বস্তিতে ছিল সরকার। এ কর্মকর্তাকে অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডসে পদায়ন করা হলে দেশ দুটি তাঁকে গ্রহণ করেনি। এরপর তাঁকে জেনেভায় রাষ্ট্রদূত করার প্রস্তাব দেওয়া হলে তৎকালীন সরকারপ্রধান পরপর তিনবার তা নাকচ করে দেন। তারপরও এই কূটনীতিককে আগলে রাখেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
২০২৩ সালের ২১ জানুয়ারি সিলেটে সুরমা নদীর চর খননকাজের উদ্বোধন শেষে তৌহিদুল ইসলামকে নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন এ কে আব্দুল মোমেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘কূটনীতিক হিসেবে তৌহিদুল ভেরি গুড অফিসার ও তুখোড় ছেলে। অযথা একটি দল তৌহিদুলের বিপক্ষে লেগেছে। তবে যত দিন মন্ত্রী আছি, তত দিন তৌহিদুলকে ডিফেন্ড করে যাব।’
চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বাসিন্দা তৌহিদুল বর্তমানেও এলাকাপ্রীতি কাজে লাগিয়ে নিজের অবস্থান বেশ শক্ত করেছেন বলে জানা গেছে। সিঙ্গাপুরে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে চাকরিতে আছেন কাউন্সেলর তৌফিকুর রহমান, হেড অব চ্যান্সেরি ও কাউন্সিলর পাসপোর্ট ওয়াসিমুল বারী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা (অ্যাকাউন্টস) ফিরোজ আহমদ এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান। তাঁদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন নিজস্ব সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, তিনি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে একজন পাসপোর্ট অফিসারকে দিয়ে ‘মাই পাসপোর্ট চ্যানেল’ নামে একটি ভিডিও চ্যানেলে কনটেন্ট আপলোড করিয়ে অর্থ আয় করেন, যা সরকারি কোষাগারে জমা হয় না।
এর আগে ২০১৩ সালে ইতালির মিলানে কনস্যুলার জেনারেল হিসেবে কর্মরত থাকাকালে মো. তৌহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে এক নারী সহকর্মীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ ওঠে।