কুমিল্লার মুরাদ নগরে সাধারণভাবে বেড়ে ওঠা এক কিশোরের নাম বিল্লাল হোসেন। যে সময়টাতে বিদেশের মাটিতে পা রাখাটা সাধারণ গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা ছেলেদের জন্য খুব একটা সহজ বিষয় ছিল না, সেই সময় অনেকটা জিদের বসেই বিদেশ বিভূঁয়ে পা রাখেন বিল্লাল হোসেন। অচেনা ভূখন্ডের অচেনা মানুষের ভিড়ে নিজেকে একজন সাধারণ কর্মগ্রহীতা থেকে অসাধারণ কর্মদাতা হিসেবে গড়ে তুলেন তিনি।
বিল্লাল হোসেন ১৯৯৭ সালে সাধারণ শ্রমিক হিসেবে পাড়ি দেন ‘লি কুয়ান ইউ’ এর দেশ সিঙ্গাপুরে। কর্ম শুরু করেন একজন সাধারণ শ্রমিক হিসেবে। তিনি দেশটিতে একটি থাই গ্লাস কোম্পানিতে সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজ নেন। এরপর নিজের কর্মদক্ষতা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন ধরণের অফিসিয়াল কাজে নিজেকে যুক্ত করেন। প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ অফিসিয়াল কাজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কোম্পানিটির কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে টেন্ডার তৈরী করা, কোটেশন তৈরী করাসহ নানাবিধ কাজে অবদান রাখতে শুরু করেন। কিন্তু একটা সময় এসে তিনি বুঝতে পারেন, প্রতিষ্ঠানটি তাঁর কাজের যথাযথ মূল্যায়ন করছেন না। বিল্লাল হোসেনের ভাষায় ‘আমি যেভাবে কাজ করছি কোম্পানিটি আমাকে সেভাবে পে করছেন না’। এরপর তিনি উপলব্ধি করেন, যে কাজ আমি আমার কোম্পানির জন্য করছি বা কারো জন্য করছি সে কাজ কেন আমার নিজের জন্য করছি না? পাশাপাশি তিনি চিন্তা করেন, কাজটি নিজে করতে গেলে তাঁর যে সাপোর্ট দরকার সেটা তিনি পাবেন কী না? তিনি দেখলেন তাঁর সে সাপোর্ট এবং মনোবল উভয়ই আছে।
সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পর ষষ্ঠ বছর শেষে সপ্তম বছর অর্থাৎ ২০০৩ সালে শেষে ২০০৪ সালে তিনি তাঁর নিজের ব্যবসা শুরু করেন। তিনি জানান- সে সময়ে একজন ঠিকাদার তাকে বলেন যে- তুমি যে ব্যবসা শুরু করেছো এখানে তুমি ২-১ বছর ভালো করলে এর মানে এই নয় যে- তুমি এখানে সফল হয়ে গেলে। তুমি যদি ২-৩ বছরের অধিক সময় এই ব্যবসায় ভালো করতে পারো তাহলে ধরে নিবে, তুমি এ ব্যবসায় সফল হবে। তাঁর এই কথাটা মাথায় রেখেই তিনি আস্তে আস্তে শুরু করেন। নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে তোলেন DS Hub Engineering & Trading Pvt. Ltd.
বিল্লাল হোসেনের গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান DS Hub Engineering & Trading Pvt. Ltd. এ বর্তমানে শতাধিক কর্মচারী ও কর্মকর্তা রয়েছে। যাদের মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত এবং তিনি যে দেশে সাধারণ শ্রমিক হিসেবে পা রেখেছিলেন সে দেশটিরও বেশ কিছু শ্রমিক তার অধীনে কাজ করছেন। বিল্লাল হোসেন জানান, বাংলাদেশিদের মধ্য থেকে ২ জন ইঞ্জিনিয়ার, ১ ম্যানেজার, ১০ জন সুপারভাইজারসহ বেশ কিছু মিক্সড্ ওয়ার্কার রয়েছেন। তিনি আরও জানান- বিদেশের মাটিতে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়া যেমন গর্বের, তেমনি বিদেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারাটাও গর্বের। আমার সবচেয়ে বেশি আনন্দ লাগে বিদেশের মাটিতে দেশের মানুষদের কাজের সুযোগ দিতে পারা। এছাড়া তিনি জানান- আমি যদি বিদেশের মাটিতে না গিয়ে দেশে অবস্থান করতাম, তাহলে আমি যে জায়গায় কাজ করতাম সেখানে একজন অন্য ভাই কিন্তু কাজের সুযোগ পেতো না। এ দিক দিয়ে চিন্তা করলে যারা বিদেশে যান তারা কিন্তু দেশে রেমিটেন্স প্রেরণ করেন এবং অন্যদের কাজের সুযোগ করে দেন।
বিদেশের মাটিতে থাকলেও বিল্লাল হোসেনের চিন্তুা যেন দেশ এবং গ্রামকে নিয়ে। এবারও দেশে এসেছেন ৩০ লক্ষাধিক টাকার বাজেট নিয়ে। গ্রামের একটি মহিলা মাদ্রাসা নির্মাণের জন্য পুরো টাকাটা তিনি ব্যয় করবেন বলে জানান। জায়গা কেনা ও বিল্ডিং নির্মাণ, মসজিদ মাদ্রাসা, ঈদগাহ্ ও কবরস্থান সংস্কারের কাজও করবেন বলে জানান তিনি। ২৫ বছর ধরে বিদেশে থাকলেও গ্রামের মাটিকে তিনি ভুলে যাননি। অনেক সময় অনেক ব্যক্তি সাহায্যের জন্য তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি আরো খুশি হন এই ভেবে যে- ‘মানুষটা সাহায্য চেয়েছেন বলেই তিনি সাহায্য করার সুযোগ পেয়েছেন’।
এছাড়া বিল্লাল হোসেন যুক্ত আছেন সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি কমিউনিটির সাথে। সেখানেও তিনি বিদেশে থাকা বাংলাদেশিদের জন্য কাজ করে চলেছেন। ব্যবসায়িক সংগঠন সিঙ্গাপুর-বাংলাদেশ বিজনেস চেম্বার (বিডি চেম্বার) এর সাথে কাজ করছেন তিনি। সিঙ্গাপুর বাংলাদেশ সোসাইটির আজীবন সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। সিঙ্গাপুর বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির সক্রিয় একজন সদস্য হিসেবে ভূমিকাও পালন করছেন।
তিনি জানান- এসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উদ্যোগে সিঙ্গাপুরে থাকা বাংলাদেশিদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছি। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, আমি যে বিল্ডিংয়ে থাকি সে বিল্ডিংয়ের নিচের অংশটুকু টাঙ্গাইলের এক বাংলাদেশি ভাই পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন। তার সাথে কথা বলে জানতে পারি, তিনি ১০ লক্ষাধিক টাকা খরচ করে সিঙ্গাপুরে এসেছেন। তখন আমি তাকে বলি, আপনার আনুসাঙ্গিক খরচ বাদ দিয়ে এ পরিমাণ টাকা সঞ্চয় করতে এক থেকে দেড় বছর লেগে যাবে। এ জন্য আমি তাকে লো লোবি স্কিল টেস্ট এ অংশ গ্রহণের এবং সেখানে গিয়ে আমার রেফারেন্স দিয়ে যোগাযোগ করবার পরামর্শ দেই। এতে তার সেখানকার মোট খরচ ১২০০ ডলার থেকে কম হলেও ২০০ ডলার কম নিবে। ফলশ্রুতিতে উক্ত ব্যক্তি সেখানে যোগাযোগ করে সফলকাম হন।
সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য দেশে যারা কাজের উদ্দেশ্যে যেতে চান, তাদেরকে পরামর্শ স্বরূপ বিল্লাল হোসনে বলেন- যারা বিদেশে বা যেকোন দেশেই হোক না কেন, তারা যেন তড়িঘড়ি করে না যান। সময় নিয়ে সংশ্লিষ্ট কাজের উপর ভালো মানের প্রশিক্ষণ নিয়ে তারপর প্রবাসে গেলে তিনি তার কাঙ্খিত স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন।
বিল্লাল হোসেন সিঙ্গাপুরের সীমান্ত সংলগ্ন মালয়েশিয়ার জোহরবারুতে একটি বাড়ি কিনেছেন। সেখানেই তিনি তার স্ত্রী এবং ২ সন্তান নিয়ে বসবাস করেন। এতে তার সিঙ্গাপুরে কাজ-কর্ম করতে সুবিধা হয়। যেহেতু তিনি সিঙ্গাপুরের ওয়ার্ক পারমিটধারী একজন ব্যবসায়ী, সেহেতু তার বাসা এবং কর্মস্থলে আসা-যাওয়ায় কোন অসুবিধা হয় না। এছাড়াও অতি সম্প্রতি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে একটি বাড়ি ক্রয় করে তুরস্কের নাগরিকত্ব লাভ করেছেন তিনি।