বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩২ পূর্বাহ্ন

সিকিম : স্বর্গের হাতছানি

  • আপডেট সময় সোমবার, ১৯ জুন, ২০২৩

নিজের আত্ম-বিশ্লেষণ করার জন্য যখন কোনো বিশেষণ খুঁজি তখন ‘সুযোগ সন্ধানী ‘ বিশেষণটা বেশি যৌক্তিক মনে হয়। নিজের ইচ্ছাগুলোকে অন্যের উপলক্ষের  সাথে গেঁথে দেয়ায় আমি বেশ পারদর্শী। আর তাই স্ত্রীর জন্মদিনের দিন তাকে সারপ্রাইজ এর নামে সিকিম ভ্রমণের একটা ট্যুর প্ল্যান হাতে দিয়ে দিলাম। নিজের ভ্রমণের বাসনাকে জন্মদিনের উপহার বলে চালিয়ে  দেয়া !

অক্টোবর এর প্রথম সপ্তাহে, ঢাকায় ৩০ ডিগ্রী ,শিলিগুড়িতে ৩৩ ডিগ্রী তাপমাত্রা আর ৪৮০ কিলোমিটার ভ্রমণের ক্লান্তি-প্রারম্ভিক আনন্দ কর্পূরের মতো উড়ে গেলো! সিকিমের শীতের কথা মাথায় রেখে ব্যাগ এ রাখা গরমের কাপড়গুলোকে তখন অনেক বেশি ভারী মনে হচ্ছিল!

শিলিগুড়ি থেকে যাত্রা শুরু হল গ্যাংটক-এর উদ্দেশ্যে-দূরত্ব আরও ১৪৫ কিলোমিটার। যাত্রার কিছুক্ষণ পর পাহাড়ি হাওয়ায় ‘উড়ে যাওয়া আনন্দের কর্পূরগুলো’ আবার ঘনীভূত হয়ে মনের মাঝে বসে গেলো। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ আর হঠাৎ করে ভিজিয়ে দিয়ে যাওয়া বৃষ্টির ঝাপটা-এমনি করে ৬ ঘণ্টার জার্নি শেষে গ্যাংটক, সিকিমের রাজধানী।

গ্যাংটক :

গ্যাংটক-এর সবচেয়ে ভালো লাগার জায়গা MG মার্ট। সিকিমের সহজ সরল মানুষগুলো নানান পণ্যের পসরা নিয়ে বসে আছে এখানে। পাহাড়ের গাঁ ঘেঁষে গড়ে ওঠা দোকানপাট, রাস্তা সবকিছুই অসম্ভব রকমের পরিষ্কার-পরিপাটি।

দ্বিতীয় দিনে যাওয়া হল গ্যাংটক থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে ছাঙ্গু লেক। প্রকৃতির নিস্তব্ধতা এতো সুন্দর হতে পারে এখানে না আসলে হয়তো জানা হত না। বলা হয়নি, তখন আমরা ১২,৩১৩ ফিট উপরে, বিধাতার কাছাকাছি ! এখন এটি লেক থাকলেও শীতকালে পুরোটাই বরফ হয়ে যায়। সেখান থেকে Roopway করে এক পাহাড়ের চূড়ায়, তাপমাত্রা ৬! উচ্চতা ও ঠাণ্ডা-এ দুইয়ের কারণে নিঃশাস নিতেই কষ্ট হচ্ছিল। ওই সময় ২০ রুপি দিয়ে খাওয়া চা ছিল আমার জীবনে খাওয়া সবচেয়ে কার্যকরী ওষুধ।

তৃতীয় দিনে যাওয়া হয় গ্যাংটক থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে লাচুং-এর উদ্দেশ্য। দূরত্ব ১১০ কিলোমিটার হলেও পাহাড়ি রাস্তার কারণে আরও বেশি মনে হবে; যেতেই পুরো ১ দিন চলে যায় !  যাত্রাপথে পড়বে হাজারো পাহাড়ি ঝরণা আর দুর্নিবার বিভব শক্তি নিয়ে নেমে আসা পানি পতনের শব্দ !

লাচুং :

প্রথম দর্শনেই ভালো লাগা, সেই ‘ভালোলাগা’ র  স্মৃতি রোমন্থন করে তাকে ভালোবেসে ফেলা- লাচুং শহরের প্রতি এইটাই আমার অনুভূতির সারসংক্ষেপ। শহরটিকে প্রযুক্তিপ্রেমীদের কাছে একটু অস্বস্তিকর মনে হতে পারে কারণ সেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। কিন্তু প্রকৃতিপ্রেমীরা এই শহরটিকে জাদুর শহর বলতে একটুও দ্বিধান্বিত হবে না।

পুরো শহরকে একটি নদী এঁকে-বেঁকে গেছে, নাম ‘লাচুং নদী’। নদীর স্রোতের শব্দ এতো শক্তিশালী হয় আমার ধারণা ছিল না! সেদিন ছিল পূর্ণিমা, সাথে স্রোতস্বিনী নদী হুংকার; অপার্থিব, সত্যি অপার্থিব ! নদীর ধার দিয়ে হাঁটছিলাম একটু সর্পিলভাবে। প্রতিটি পদক্ষেপ যেন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো নদীর কাছে ,আরও একটু কাছে ! সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮,২০০ ফুট উচ্চতায় এই নদীতে একবার পড়লে আর্তনাদ এর শব্দও শোনা যাবে না !

চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় সাদা জলরাশি হীরার মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছে। কেন জানি না এই অপার্থিব মুহূর্তে মৃত্যুকে খুব আরাধ্য মনে হচ্ছিলো! বিশ্ববিদ্যালয় থাকাকালীন ঝোঁকের মাথায় ফটোগ্রাফির এর ওপর একটা কোর্স করা হলেও ছবি তোলায় খুব আগ্রহ  কখনোই ছিল না। কিন্তু এই মুহূর্তে অনেকগুলো ছবি তোলা হল। এই অপার্থিব মুহূর্তগুলোকে আঁকড়ে ধরে রাখার এক ব্যর্থ প্রয়াস আরকি !

জীবনে ভালো কিছু করার জন্য উচ্চাভিলাষ দরকার, কিন্তু ভালো থাকার জন্য ঠোঁটের কোণে একটু হাসি যথেষ্ট। এমনি ‘হাসিমুখ’ এর একটা মানুষ ছিল আমাদের ট্যুর এর ড্রাইভার। ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তাহীন এই মানুষগুলো জীবনের কি পায়নি তা নিয়ে বিস্মৃতিতে নেই, বরং যা পেয়েছে তাই আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। তাকে সাথে নিয়ে শুরু হল চতুর্থ দিনের যাত্রা। গন্তব্য ইয়ামথাং ভ্যালি ও জিরো পয়েন্ট। লাচুং থেকে ৪-৫ ঘণ্টার জার্নি ইয়ামথাং ভ্যালি।

ইয়ামথাং ভ্যালি :

যাত্রাপথের প্রতি বাঁকে সু-উচ্চ পাহাড়গুলো একটাই ইঙ্গিত দেয়-সৃষ্টিকর্তাই শ্রেষ্ঠ শিল্পী। ৮,২০০ ফুট উঁচু শহরের উপর ৩,০০০ ফুট উচ্চতার এক একটি পর্বত দাঁড়িয়ে আছে নিরহংকারী হয়ে ! আর আমাদের ৫-৬ ফুট বিশালতা নিয়ে কত অহমিকা !

কোনোটির চূড়ায় বরফের আচ্ছাদন, আবার কোনোটির গাঁয়ে সবুজের প্রলেপ, কোনটি আবার ন্যাড়া হয়ে একটু  গোমড়া-মুখো ! তবে বিশালতার উপমায় উপমিত সবগুলো পাহাড়ই। কোন পাহাড় সূর্যকে আড়াল করতে ব্যস্ত, কোনোটি আবার সূর্যের আলোয় প্রতিফলন আর প্রতিসরণের সূত্র মেনে স্ব-মহিমায় উদ্ভাসিত। প্রতিটি পাহাড় তার নিজস্ব স্বকীয়তায় অনন্য। সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে প্রকৃতির কারুকার্যে নিরলসভাবে ব্যস্ত এই কারিগরগুলো !

ইয়ামথাং ভ্যালি-ফুলের সাম্রাজ্য হলেও অক্টোবর এর শুরুতে ফুলের সম্ভাষণ পেলাম না ! কিন্তু পুরো ভ্যালি অখণ্ড সবুজের গালিচা বিছিয়ে আছে। সাথে ৯০ ডিগ্রী কোণে দাঁড়িয়ে থাকা পাইন গাছ। ইয়ামথাং ভ্যালির প্রকৃতি ‘সবুজ রঙের’ কাছে ভীষণভাবে ঋণী ,কারণ পৃথিবীর সব সবুজ ধার করে সাজিয়েছে নিজেকে!

জিরো পয়েন্ট :

এরপর আগামী গন্তব্য- জিরো পয়েন্ট। শুরুতেই জানিয়ে রাখি, জিরো পয়েন্ট সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫,৩০০ ফুট উঁচুতে, যেখানে অক্সিজেন এর স্বল্পতা রয়েছে। তাই এতক্ষণের গল্পগুলো “আনন্দ ভ্রমণ” মনে হলেও এখন সেটা দু:সাহসিক অভিযান। তাই এই যাত্রায় যাদের শ্বাসকষ্ট আছে বা একটু বয়োবৃদ্ধ তাদের জন্য একদম সমীচীন নয়। এখানে যাওয়ার অনুমতি মেলে যদি প্রকৃতি শান্ত থাকে। পুরো জায়গা সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে কারণ সামনেই ভারত-চীন সীমান্ত।

জিরো পয়েন্ট- বৃক্ষহীন পাহাড়ের সমারোহ। কিছু পাহাড়ের চূড়ায় হালকা বরফের আচ্ছাদন, কিছু পাথর দিয়ে সাজিয়েছে নিজেকে। শীতকালে পুরোটাই শুভ্র বরফে মোড়া থাকে। নিঃশাস ভারী হয়ে আসছিলো, তবুও কোনো অদৃশ্য তাড়নায় একটা পাহাড়ে উঠার চেষ্টা করলাম, খানিকটা ওঠার পর ক্রমেই অক্সিজেন এর মাত্রা কমে  আসছিলো।

বাপ্পারাজ এর মুভির মতো কোনো ট্রাজেডি হওয়ার আগেই নেমে পড়লাম ! কিন্তু বৃক্ষহীন প্রান্তরে এতো বাতাস, সূর্যের সাথে করমর্দন করার দূরত্বে থাকার পরও কোনো ধরনের উষ্ণতা অনুভব করিনি ! প্রকৃতির সৌন্দর্য যেখানে হতবিহ্ববল করে দেয়, সেখানে তাপবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা অমূলক। এভাবেই কাটলো চতুর্থ দিনের যাত্রা।

পঞ্চম দিনে আমাদের ফেরার পালা, লাচুং থেকে গ্যাংটক, সেখান থেকে শিলিগুড়ি। পথে যেই সকল পাহাড় আর ঝরনা দেখে সম্মোহন ছিলাম, সেই অনুভূতির পূর্ণপ্রচার।

একটি কথা বলা হয়নি, শিলিগুড়িতে থাকাকালীন যেই ব্যাগগুলো ভারী মনে হচ্ছিলো, আমার সহধর্মিণীর কল্যাণে সেগুলো আরও ভারী হয়েছিল, সেই সাথে ভারী হয়েছে ভ্রমণ স্মৃতিগুলো! সবাই দোয়া করবেন, এই স্মৃতিগুলো রোমন্থন করেই দুজন একসাথে বুড়ো হতে পারি !

মো: আরাফাত রহমান

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com