সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে পর্যটনের জন্য প্রতি বছর অনেকে পাড়ি জমালেও, এখানে যে ‘মাতৃগর্ভ’ ভাড়া করার খোঁজেও কেউ কেউ আসেন সেটি অনেকেরই অজানা।
বছর তিনেক আগে আমফান ঝড়ে বিধ্বস্ত সুন্দরবনের গোসাবা থেকে আরও খানিকটা ভেতরে এক প্রত্যন্ত গ্রামে ত্রাণ সামগ্রী বিলি করতে গিয়ে কলকাতার সুমন্ত দে এবং তাঁর সঙ্গীদের কিন্তু সেরকম অভিজ্ঞতাই হয়েছিল ।
সুমন্ত দে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “আমরা সুন্দরবনের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে ত্রাণ সামগ্রী দিতে গিয়েছিলাম। আমফানের পর সেখানকার পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ, তবে আমরা তার জন্য কিছুটা হলেও প্রস্তুত ছিলাম।”
যার জন্য তাঁরা প্রস্তুত ছিলেন না, তা হল ওই গ্রামে একাধিক সারোগেট মায়ের উপস্থিতি।
“বছর ২৫-৩০ এর বেশ কয়েকজন মহিলার সঙ্গে আলাপ হল, যারা সন্তানসম্ভবা। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, তাঁরা সারোগেট মা, অন্যের সন্তান গর্ভে ধারণ করেছেন।“
“বলা বাহুল্য, এদের প্রত্যেকেই ভীষণ দরিদ্র। কেউ দেনা জর্জরিত জীবন থেকে থেকে রেহাই পেতে, কেউ বা অন্য কোনও পারিবারিক কারণে, সারোগেট মা হতে রাজি হয়েছেন অর্থের বিনিময়ে”, বলছিলেন মি. দে।
এর মাঝে, বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হয়েছে। ২০২২ সালে দেশে সারোগেসি সংক্রান্ত আইনকানুনের বেশ কিছু রদবদলও হয়েছে। কিন্তু মি দে বা তাঁর সঙ্গীদের স্মৃতি থেকে ওই মায়েদের কথা মুছে যায়নি।
“জন্মের পর, ভূমিষ্ঠ সন্তানকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়া সব চাইতে কঠিন কাজের মধ্যে একটা”, বলছিলেন মি. দে।
এ বছর কলকাতায় তাঁদের পাড়ার দুর্গাপুজো, শ্যামবাজার পল্লীসঙ্ঘের দুর্গামণ্ডপে দুর্গা প্রতিমার হাতে অস্ত্র নেই, মা রয়েছেন ছাপোষা শাড়িতে।
আর মণ্ডপ জুড়ে রয়েছেন এদেশের সেই সব মায়েরা যারা তাঁদের গর্ভ ‘ভাড়া’ দিয়েছেন, তাঁদের কথা। মণ্ডপের দেওয়াল জুড়ে সেই সব মায়েদের কথাই ফুটে উঠেছে।
কলকাতার শ্যামবাজার পল্লীসঙ্ঘের এবারের থিম ‘সন্ধিতে’ মাতৃত্বের সেই ভিন্ন ভাবনাই প্রকাশ পেয়েছে।
বাণিজ্যিকভাবে সারোগেসি ভারতে নিষিদ্ধ। অর্থাৎ পয়সার বিনিময়ে সন্তান ধারণের জন্য গর্ভ ভাড়া দেওয়া আইনবিরুদ্ধ।
“এদেশে এবিষয়ে কড়া আইন রয়েছে যার মূল লক্ষ্য হল, বাণিজ্যিক সারোগেসি এবং এ সংক্রান্ত সমস্ত রকমের অনিয়ম বন্ধ করা,” বলছিলেন বন্ধ্যাত্ব ও প্রজনন বিশেষজ্ঞ মাধব চন্দ্র দাস।
বিদেশি দম্পতি, প্রবাসী ভারতীয়, একক বাবা-মা, অবিবাহিত কিন্তু একসঙ্গে থাকেন এমন দম্পতি, সমকামী যুগল – এমন অনেকেই সারোগেসির জন্য এতদিন ভারতকে বেছে নিতেন। সেই চল রুখতে, কড়া আইন পাশ করা হয়েছে এদেশে।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ ২00৫ সালে সারোগেসি সংক্রান্ত বিষয়ে একটি নির্দেশিকা জারি করেছিল। এরপর ২০১0 সালে, সরকার সহায়ক প্রজনন প্রযুক্তি (নিয়ন্ত্রণ) বিলে আরও কিছু নিষেধাজ্ঞার উল্লেখ করে।
‘দি অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাক্টিভ টেকনোলজি অ্যান্ড সারোগেসি অ্যাক্ট’, যা ওই দুটির উপর ভিত্তি করে তৈরি, তা ভারতে কার্যকর হয়েছে ২৫শে জানুয়ারি ২০২২ থেকে।
এই আইন বলছে এ দেশে সারোগেট মা হতে পারেন সন্তানের পিতা-মাতার খুব নিকট কোনও আত্মীয়, যার বয়স ২৫-৩৫ এর মধ্যে। গর্ভদাত্রী মা একবারের বেশি সারোগেট সন্তান ধারণ করতে পারবেন না।
সারোগেট মায়ের চিকিৎসার খরচ বহন করতে পারেন যে নিঃসন্তান দম্পতি পিতা-মাতা হতে চান। তা ছাড়া আর কোনও টাকাপয়সার আদান প্রদান হতে পারবে না।
শুধু তাই নয়, আইন লঙ্ঘন করে, মানে অর্থের বিনিময়ে সারোগাসির ক্ষেত্রে সর্বাধিক ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা ও ১০ বছরের জেল পর্যন্ত হতে পারে।
আইনত নিষিদ্ধ হলেও অর্থের বিনিময়ে সারোগেট মা হয়েছেন, এমন বেশ কিছু ঘটনা কিন্তু ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উঠে এসেছে।
চলতি বছরের অগাস্ট মাসে কলকাতা পুলিশ অভিযান চালিয়ে একটি শিশুপাচার চক্রের হদিশ পায়, যারা অর্থের বিনিময়ে সারোগেট মা খুঁজে দেয়ার মতো কাজও করত।
সেই চক্রের মূল চাঁই, এজেন্ট, সাব-এজেন্ট সহ প্রায় ১০০ জনকে ওই অভিযানে আটক করে পুলিশ।
অভিযান চলাকালীন দক্ষিণ কলকাতার একটি নামকরা আইভিএফ ক্লিনিকের খোঁজও মেলে, যারা ওই চক্রের সঙ্গে যুক্ত।
সে সময় কলকাতা পুলিশ সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিল, মমতা পাত্র নামে এক মহিলাকে তাঁরা গ্রেফতার করেছে, যিনি নিজে অর্থের বিনিময়ে সারোগেট মা হয়েছিলেন।
দক্ষিণ কলকাতার ওই আইভিএফ ক্লিনিকের সঙ্গে মিস পাত্রের যোগাযোগ ছিল বলেও পুলিসের তরফে সে সময় সংবাদমাধ্যমকে জানানো হয়েছিল।
শুধু তাই নয়, তিনি এজেন্ট মারফত আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মহিলাদের পয়সার বিনিময়ে গর্ভধারণের জন্য প্রস্তাব দিয়ে যোগাযোগ করতেন বলেও জানানো হয়েছিল।
কলকাতা পুলিশ তখন বলেছিল, ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে এজেন্টরা আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মহিলাদের গর্ভধারণের জন্য রাজি করান।
শিশুর জন্মের পরে, চার বা পাঁচ লক্ষ টাকার বিনিময়ে সদ্যোজাতকে দম্পতিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
এই টাকার কিছু অংশ গর্ভদাত্রী মা পেলেও বেশির ভাগটা এজেন্ট, সাব এজেন্ট ও এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত মূল অপরাধীদের হাতে চলে যায়।
“পুরো বিষয়টিই যারা সন্তান চাইছেন তাঁদের আর্থিক ক্ষমতার উপর নির্ভর করে।”
“অনেক ক্ষেত্রে এই দেওয়া নেওয়ার অঙ্কটা ছয়-সাত লক্ষ বা তার বেশিও হয়,” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলকাতার এক চিকিৎসক বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন।
বছর তিরিশের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মহিলা বিবিসিকে জানিয়েছেন, তিনি এই প্রথম বার সারোগেট মা হতে চলেছেন। এই মুহূর্তে তিনি সন্তানসম্ভবা।
দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার সেই মহিলা বলেন, “আমি পরিচিত এক মহিলা মারফত এ বিষয়ে জানতে পারি। আমি সন্তানসম্ভবা, কয়েক মাসের মধ্যেই বাচ্চার জন্ম হবে। আমার নিজের ছোট একটি ছেলে রয়েছে।”
তিনি যে দম্পতির জন্য গর্ভধারণ করেছেন, বেশ কয়েকবার চেষ্টার পরেও তাঁরা আইভিএফ পদ্ধতির মাধ্যমে সন্তানধারণ করতে পারেননি।
এর পাশাপাশি সুন্দরবনের গোসাবা অঞ্চলের ২৮ বছর বয়সী অপর একজন মহিলা জানান, সারোগেট মা হতে রাজি হওয়ার পেছনে কারণ হল স্বামীর চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে তিনি ও তাঁর পরিবার ঋণে জর্জরিত।
নিতান্ত নিরুপায় হয়ে নেহাত পয়সার জন্যই সারোগেট মা হতে তিনি রাজি হয়েছেন।
কলকাতার বিশেষজ্ঞ সীমা লাল ‘অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাকক্টিভ টেকনোলজি’ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে গবেষণা করেছেন।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “সন্তানহীন দম্পতিদের, বিশেষত মহিলাদের, নিজস্ব মানসিক যন্ত্রণার পাশাপাশি নানান কটুক্তির শিকার হতে হয়। এই কারণে অনেকেই আজকাল আইভিএফ পদ্ধতিসহ বিভিন্ন অ্যা্সিসটেড রিপ্রোডাকক্টিভ টেকনোলজির সাহায্য নিচ্ছেন।”
“আমি কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, এঁদের প্রায় কেউই সন্তান দত্তক নেওয়ার পক্ষপাতী নন। তার পেছনেও সামাজিক কারণ রয়েছে। ২০২৩ দাঁড়িয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেকটা উন্নত হয়েছে, কিন্তু বন্ধ্যাত্ব, বিশেষত পুরুষদের বন্ধ্যাত্ব নিয়ে কথা বলতে চান না বেশির ভাগ মানুষ।”
“যেদিন থেকে আমরা সেটা নিয়ে কথা বলতে শুরু করব আর সন্তানহীনতা সংক্রান্ত অনেক জটিলতার সমাধান হয়ে যাবে,” বলছিলেন ড: লাল।
সন্তানহীন মায়েদের লড়াইয়ের কথা জানালেন বছর চুয়াল্লিশের রুমা চৌধুরী।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানাচ্ছিলেন, “সন্তানহীনতার জ্বালা দুর্বিষহ। আমার বিয়ের ১৭ বছর পরেও আমার সন্তান নেই, এ নিয়ে কটাক্ষ কম শুনতে হয়নি।“
“পরিবার-পরিজন থেকে শুরু করে, প্রতিবেশী, সকলের কটাক্ষ আমাকে সহ্য করতে হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত আইভিএফ পদ্ধতিতে মা হওয়ার খরচ বহন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি ধীরে ধীরে বাস্তবটা মেনে নিয়েছি।”
অন্যদিকে, প্রসব পরবর্তী সময়ে মায়ের মানসিক টানাপড়েনের কথা প্রসঙ্গে সীমা লাল তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে জানান, “মায়ের সঙ্গে সন্তানের যে যোগ, সেটা কিন্তু রয়েই যায়। তা তিনি সারোগেট মা-ই হোন বা বায়োলজিক্যাল মাদারই হোন!”
“আমি নিজে একজন মহিলা হিসেবে বুঝি তাদের এই আবেগটা!”
বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিমবঙ্গে আইভিএফ ট্রিটমেন্টের খরচ অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় কম।
মুম্বাই, দিল্লি, গুজরাটের মতো ভারতের অন্যান্য জায়গার তুলনায় এ রাজ্যে অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাকক্টিভ টেকনোলজির মাধ্যমে সন্তানধারণ তুলনামূলক ভাবে অনেক কম খরচেই হয়ে যায়।
যে কারণে, অনেক সন্তানহীন দম্পতি কলকাতাকে বেছে নিচ্ছেন।
অন্য দিকে এ রাজ্যের সমাজকর্মীরা মনে করেন, সারোগেট মা খুঁজে পেতে এ রাজ্যে আসা দম্পতিদের সংখ্যা যে বেড়েছে তার প্রধান কারণ এ রাজ্যের দারিদ্র।
আর্থিক সঙ্কট, ঋণ, পরিবারের কারও চিকিৎসার খরচ এমন নানা কারণে পশ্চিমবঙ্গের দরিদ্র মহিলারা অর্থের বিনিময়ে সারোগেট মা হওয়ায় সম্মতি দিয়ে থাকেন বলে তারা জানাচ্ছেন।
বিবিসি বাংলা