রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৫৭ পূর্বাহ্ন

সাগরতলের আজব জগৎ

  • আপডেট সময় বুধবার, ১০ জুলাই, ২০২৪

আন্দামান সাগরের এদিকটায় পানি বেশ উষ্ণ, আরামদায়ক। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলকেলিতেও তাই ক্লান্তি আসে না। পানির ওপরে এক জগৎ, যেখানে রাজত্ব করছে মানুষ। আর নিচে আরেক জগৎ, যেখানে অক্সিজেনের স্বল্পতা মানুষকে ঠেকিয়ে রেখেছে শান্তিবিনাশী সিদ্ধান্ত গ্রহণে। নিচের রাজত্বে তাই সুনির্দিষ্ট কারও আস্ফালন নেই। নিজস্ব বাস্তুতন্ত্রে নিজেকে টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে সবাই ব্যস্ত। আমাদের মতো কিছু দুপেয়ে আগন্তুকের প্রমোদভ্রমণে বাগড়া দেওয়ার কোনো ইচ্ছাই এই জগতের বাসিন্দাদের নেই। প্রবালপ্রাচীরগুলোর সঙ্গে লাগোয়া সাদা বালুতে মুখ গুঁজে থাকা স্টার ফিশ কিংবা পান্না সবুজ পানি ভেদ করে নামা সূর্যালোকের স্পর্শ পাওয়া রংধনু মাছের ঝাঁককে সন্তর্পণে পাশ কাটিয়ে চলা কচ্ছপের সঙ্গে মোলাকাতের মজাই আলাদা।

নাকে–মুখে গুঁজে রাখা স্নর্কেলের সুবাদে যেহেতু পানির নিচে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে না, আবার চোখে লাগানো বিশেষ চশমার কারণে দূরের বস্তুও কাছে দেখা যাচ্ছে, তাই ডুবে ডুবে পসাইডনের (গ্রিক মিথোলজির সমুদ্রদেবতা) জগতে অনুপ্রবেশের অভিজ্ঞতা মন্দ নয়। এত দিন দার্জিলিং কিংবা পোখারার আকাশে প্যারাগ্লাইডিংয়ের অভিজ্ঞতা ছিল সেরা। তবে ফুকেটের স্নর্কেলিং সেটিকে নিশ্চিতভাবেই ছাড়িয়ে গেছে।

ব্যাংককের ডন মুয়েং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর
ব্যাংককের ডন মুয়েং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

থাইল্যান্ডের বৃহত্তম দ্বীপ ফুকেট। পাতায়ার পর এটি থাইল্যান্ডের বৃহত্তম পর্যটক আকর্ষণ কেন্দ্রও বটে। ব্যাংকক থেকে বাসে চড়ে কিংবা উড়োজাহাজে উড়ে, দুভাবেই যাওয়া যায়। উড়োজাহাজের ভাড়া খুব একটা বেশি নয়। অন্তত কো সামুইয়ের সঙ্গে তুলনা করলে অনেক সস্তা। রিটার্ন টিকিট ১২ হাজার টাকামাত্র। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিভিন্ন এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজ চলে ডন মুয়েং বিমানবন্দর থেকে। ঢাকা থেকেই এয়ার এশিয়ার টিকিট বুক করে এসেছি। একটু চিন্তা ছিল যে সুবর্ণভূমি বিমানবন্দর থেকে রওনা দিয়ে সময়মতো ডন মুয়েংয়ে পৌঁছাতে পারব কি না।

ফুকেটের উড়োজাহাজ প্রায় দুই ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়েছিল বলে বাড়তি দুশ্চিন্তা পোহাতে হয়নি। দেড় ঘণ্টার বিমানভ্রমণ শেষে ফুকেট বিমানবন্দর, সেখান থেকে আরও এক ঘণ্টা মাইক্রোবাসে চেপে হোটেলে পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। পেটে ইতিমধ্যেই ছুঁচোর কেত্তন শুরু হয়েছে। লাগেজগুলো রুমে রেখে স্ট্রিটফুড খেয়ে পেট ঠান্ডা করতে করতেই রাত ১১টা বেজে গেল। এর মাঝে অবশ্য একটা কাজের কাজ করে ফেলেছি। পরবর্তী দিনের জন্য ট্যুর প্যাকেজ কেনা হয়ে গেছে। ছয়জনের দল বলেই দুই হাজার বাথের প্যাকেজ অর্ধেক দামে পেয়ে গেলাম।

ফুকেটের সবজির বাজার

কো সামুইতে যেমন মানুষজন চোখে পড়ত না, ফুকেট এর ঠিক উল্টো। ২২২ বর্গমাইলের দ্বীপটিতে প্রায় ছয় লাখেরও বেশি মানুষ বাস করেন, যাঁদের চার ভাগের এক ভাগই স্থানীয় নন, সেটা থাইল্যান্ডের অন্য প্রদেশেরই হোক কিংবা মিয়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া থেকে আগত শ্রমিকেরাই হোন। এর মূল কারণ, পর্যটন এবং সেটির কল্যাণে পরিচালিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। পর্যটনের মৌসুমে তো দ্বীপের জনসংখ্যা এক মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। আবার গোটা থাইল্যান্ডে, যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা শতকরা মাত্র ৫ ভাগ, সেখানে ফুকেটে এর সংখ্যা ২০ ভাগ।

ফুকেটের সবজি বাজার
ফুকেটের সবজি বাজার

মালয় জাতির লোকজন দীর্ঘদিন ধরেই এখানে বাস করছেন, যাঁদের বড় একটি অংশ মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আগত। ২০০৪ সালের সুনামিতে দ্বীপটির প্রচুর ক্ষতি হয়, প্রায় আড়াই শ মানুষ মারা যান, যাঁদের মধ্যে অনেক বিদেশি পর্যটকও ছিলেন। কোভিডের সময়েও দ্বীপের মানুষজন ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। তবে পর্যটননির্ভর অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগেনি। ইউরোপিয়ানদের পাশাপাশি প্রচুর ভারতীয়েরও দেখা মেলে ফুকেটে। বাংলাদেশিরাও তাঁদের ঘোরাঘুরির লিস্টে ফুকেট কিংবা ক্রাবিকে রাখতে ভোলেন না সচরাচর। শহরে সে জন্যই গড়ে উঠেছে প্রচুর হোটেল। দ্বীপের পশ্চিম পাশে পাতং সৈকতের কাছাকাছি যে হোটেলটিতে আমরা উঠেছি, সেটির নাম সাওয়াদ্দি পাতং রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা। বেশ বড় হোটেলটিতে দুটি সুইমিংপুল আছে, অতিথিদের বেশির ভাগই ইউরোপীয়। তবে সার্ভিসের মান সন্তোষজনক নয়। অবশ্য সারা দিন থাকব বাইরে বাইরে বিধায় হোটেল নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না।

আমার ঘোরাঘুরির প্যাকেজ কিনেছি সি স্টার এজেন্সি থেকে। প্যাকেজে আছে সকালের নাশতা, আছে দুপুরের খাবার। আর স্পিডবোটে করে ঘুরিয়ে দেখাবে ‘ফি ফি ডন’ আর ‘ফি ফি লেহ’ আইল্যান্ড। এই দুটিসহ আরও বেশ কিছু ছোট দ্বীপকে একত্রে ‘ফি ফি আইল্যান্ড’ বলে, যেখানে বেশ কয়েকটি জায়গা আছে দেখার মতো। মায়া বে, লো সামা বে, মাংকি বিচ, ভাইকিং কেভ, পিলে লেগুন। সেই সঙ্গে আছে স্নর্কেলিং। রাতে একদম হোটেলে পৌঁছে দিয়ে তাঁদের দায়িত্ব শেষ।

মাংকি বিচের বাঁনরা সুযোগ পেলেই মোবাইল হাতে নিয়ে চম্পট দিবে
মাংকি বিচের বাঁনরা সুযোগ পেলেই মোবাইল হাতে নিয়ে চম্পট দিবে

সকাল আটটায় এজেন্সির গাড়ি হোটেলের সামনে হাজির। স্পিডবোট ছাড়বে এজেন্সির নিজস্ব জেটি থেকে। সেটি আবার দ্বীপের পূর্ব পাশে রয়েল ফুকেট মেরিনা নামের জায়গায়। হোটেল থেকে পৌঁছাতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। পৌঁছানোর পরই বুফে নাশতা আর ট্যুর গাইডের দিকনির্দেশনা–সংবলিত লেকচার উপভোগ করলাম। এবার যাত্রার পালা। প্রথমে যাব ফি ফি ডন আইল্যান্ড। ফুকেট থেকে কাছাকাছি হলেও দ্বীপটির অবস্থান ক্রাবি অঙ্গরাজ্যে।

স্পিডবোটে প্রায় ৩০ জনের মতো মানুষ। আমাদের ছাড়া অন্য সবাই ইউরোপীয়। অনেকেই ছোট সন্তান নিয়ে এসেছেন ঘুরতে। ব্যাপারটি আগেও খেয়াল করেছি। আমরা বাঙালি মা-বাবারা সন্তানদের ফার্মের মুরগি বানিয়ে রাখি। কোথাও যেতে দিতে চাই না। ঘুরতে নিয়ে গেলে ভয় পাই। অথচ পশ্চিমারা একদম দুধের শিশুকেও সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন। স্বাভাবিকভাবেই এসব শিশু দ্রুত ম্যাচিউর হয়।

স্পিডবোটে করে এগিয়ে চলা, ইউরোপীয়দের আধিক্য চোখে পড়ে
স্পিডবোটে করে এগিয়ে চলা, ইউরোপীয়দের আধিক্য চোখে পড়ে

আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ২২ বছর বয়সে বিশ্ব জয় করেছিলেন, সুলতান মেহমেত ২৪ বছর বয়সে কনস্ট্যান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) জয় করেছিলেন, আর আমরা ২৪ বছর বয়সে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিই। স্পোকেন ইংলিশের কোর্স করি আর ভাবি বিশ্ব জয় করে ফেলব। এখনো যদি কোথাও ভ্রমণে যাই, আম্মা টেনশনে শেষ হয়ে যান। ওদিকে পশ্চিমারা সন্তানদের আঠারো বছর বয়সে আলাদা করে দেয় যেন জীবনযুদ্ধে তারা নিজেদের পোক্ত করতে পারে। আঠারো বছর বয়সে সন্তানদের আলাদা করার পশ্চিমা নীতিতে আমি বিশ্বাসী না হলেও সন্তানদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পেছনে তাদের যে শিক্ষা ও প্রচেষ্টা, তাকে যথেষ্ট সম্মান করি।

মাংকি বিচের অবস্থান ফি ফি ডন আইল্যান্ডে। এখানকার পানি ঘন নীল বর্ণের না হলেও একদম নীলাভ কাচের মতো স্বচ্ছ। তীরের কাছ থেকে যত দূরে যাওয়া যায়, নীল বর্ণের আধিক্য তত বাড়ে। সেখানে পৌঁছে দেখি এলাহি কাণ্ড! এক জায়গায় কিছু বানর দেখা যাচ্ছে, আর মানুষজনের ভিড় সেখানেই। আমরা যেমন আছি, তেমনি অন্য এজেন্সির মাধ্যমে আগত পর্যটকেরাও উপস্থিত। বানরগুলোর ব্যাপারে অবশ্য গাইড আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন যেন খুব কাছে না যাই। সব সময় মানুষের দেখা পায় বলে বানরেরা মানুষকে একদম ভয় তো পায়ই না, উপরন্তু অনেক সময়েই সেলফিপ্রিয় পর্যটকদের হাতের মুঠোফোন নিয়ে চম্পট দেয়।

ফি ফি ডন আইল্যান্ডের পান্না সবুজ জল

২০০৪ সালের সুনামি দ্বীপটিতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। এক হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয় এবং দ্বীপের পুরো অবকাঠামোই ধসে যায়। যদিও সেসবের কোনো চিহ্ন এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে সুনামিতে মৃত ব্যক্তিদের স্মরণে তাঁদের স্বজনেরা এখানে একত্র হন। আট কিলোমিটার দীর্ঘ দ্বীপটির দুটি বড় অংশ এক জায়গায় এসে সরু পায়ে চলা পথ দিয়ে যুক্ত। দুই ধারে ইংরেজি ‘সি’ হরফাকৃতির সৈকত, যেটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আবাসিক হোটেল ও রেস্টুরেন্ট। এমনই এক রেস্টুরেন্টে আমাদের লাঞ্চ সারতে হবে। ‘আরিদা’ নামের রেস্টুরেন্টটি চালায় ইন্দোনেশীয় কিছু ব্যক্তি, যেটিতে প্রবেশের সময় বলে দেওয়া হয়েছে, সম্পূর্ণ হালাল রেস্টুরেন্টটিতে অ্যালকোহলের কোনো বন্দোবস্ত নেই। খাবারের স্বাদ অসাধারণ, বিশেষ করে স্যুপ। এক ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছে আমাদের। খাবারের পর বাকি সময়টুকু চারপাশ ঘুরে দেখার জন্য বরাদ্দ।

সৈকতে খেলা করছে শিশুরা
সৈকতে খেলা করছে শিশুরা

থাই সরকারের ওয়েবসাইটে ফি ফি ডন দ্বীপের সৈকতকে উল্লেখ করা হয়েছে পৃথিবীর সুন্দরতম সৈকত বলে। আসলেও কি তা–ই? সাদা বালু আর স্বচ্ছ কাচের মতো পান্না সবুজ জল, এই সৈকত নিঃসন্দেহে সুন্দর। তবে সুন্দরতম কি না, তা নিয়ে আমি সন্দিহান। হলেই–বা কী। ব্র্যান্ডিং করতে হয় তো এভাবেই। আমাদের কক্সবাজার সৈকতের সৌন্দর্য তো কম নয়। আমরা কি পেরেছি জাতীয়ভাবে সেটির ব্র্যান্ডিং করতে? কথায় বলে, প্রচারেই প্রসার। সেই প্রচারেই যদি ঘাটতি থাকে, তাহলে প্রসার ঘটবে কীভাবে? স্রেফ পর্যটনে যদি আমরা নজর দিতে পারতাম, তাহলে দেশের ডলার–সংকট কবেই কেটে যেত, যা কি না করে দেখিয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকার।

ফি ফি ডন থেকে আমাদের গন্তব্য ফি ফি লেহ দ্বীপ। দ্বীপের প্রথম আকর্ষণ ভাইকিং কেভ। এখানে এসে সত্যিই হতাশ হয়েছি। কারণ, ভাইকিং কেভে কারও প্রবেশাধিকার নেই, ৫০ মিটার দূর থেকে স্পিডবোটে বসে দেখতে হবে। এমনিতে গাইড সেই গপ্পো দিচ্ছিলেন। এই কেভে নাকি সুদূর অতীতে কিছু জলদস্যু জাহাজডুবির কারণে আটকে পড়েছিল। জীবন বাঁচানোর জন্য তাঁরা ভক্ষণ করেছিল পাখির বাসা আর সময় কাটানোর জন্য করেছিল আঁকাআঁকি। সেই আঁকাআঁকির মধ্যে ছিল বিভিন্ন জাহাজের ছবি। আবার হাতির ছবিও ছিল। উঁচু লাইমস্টোনের পাহাড়ের ভেতরকার গুহাটি তখন থেকেই ভাইকিং কেভ নামে পরিচিতি পায়।

খাই নাই দ্বীপের শুভ্র বালির সৈকত
খাই নাই দ্বীপের শুভ্র বালির সৈকত

আমার কাছে এটি নিছক গালগল্প বলে মনে হয়েছে। কারণ, জলদস্যুরা কোনো দেশীয় ছিল, তার কোনো উল্লেখ নেই। হাতির ছবি আঁকা থাইল্যান্ডের রীতি, আবার পাখির বাসা ভক্ষণ করা চৈনিক বৈশিষ্ট্য। অথচ ভাইকিং বলতে বোঝায় স্ক্যান্ডিনেভিয়ান আদিবাসীদের। কি ঠেকা পড়েছে আটলান্টিকের তীরবর্তী সেই অধিবাসীদের এই দূরপ্রাচ্যে এসে ডাকাতি করার? আবার গুহায় আটকে হাতির ছবিই–বা কেন আঁকবে, যে প্রাণীর দেখা কি না স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে পাওয়াই যায় না। আদতে এই গল্প ছড়ানো হয়েছে জায়গাটার প্রচার বাড়ানোর জন্য।

ভাইকিং কেভ থেকে পিলে লেগুনের দূরত্ব খুব বেশি নয়। জায়গাটি খুবই সুন্দর। চারপাশে উঁচু পাহাড়ের মাঝখানে নীল বর্ণ পানির আধার। একটা লং টেইল বোট ভাড়া নিয়ে আধা ঘণ্টার মতো ঘোরাঘুরি, পানিতে দাপাদাপি আর ফটোসেশন করা গেল। পানি এতটাই স্বচ্ছ যে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সারা দিন সাঁতার কাটলেও ক্লান্তি আসে না। ভেবেছিলাম স্নর্কেলিং এখানেই হবে। সে জন্য অবশ্য আমাদের নিয়ে গেল আরেকটু দূরে, লো সামা বে নামের স্থানে। সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। প্রয়োজনীয় গিয়ার পরিধানের পর পানিতে ডুব দিয়ে মনে হয়েছিল এক ভিন্ন জগতে চলে এসেছি। চোখের সামনে হাতছোঁয়া দূরত্বে ঘুরে বেড়াচ্ছে রংবেরঙের মাছের ঝাঁক। এক অবর্ণনীয় অনুভূতির অবগাহনে মন উৎফুল্ল হয়ে উঠল। জীবনে নানা অভিজ্ঞতাই হয়েছে। কিন্তু পানির নিচের এই আজব জগতের বাসিন্দাদের সান্নিধ্য উপভোগে মন এতটা প্রফুল্ল হয়েছে যে এর কোনো তুলনা নেই।

ভাইকিং কেভ, ভেতরে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা ছিল বিধায় দেখা হয়নি
ভাইকিং কেভ, ভেতরে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা ছিল বিধায় দেখা হয়নি

প্রথম দিকে স্নর্কেলিং গিয়ার পরতে বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। পেটের ভেতর সমুদ্রের নোনাজল প্রবেশ করে অস্বস্তির সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু একবার অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর আর সমস্যা হয়নি। প্রবালের আঘাতে পা কেটে যেতে পারে এই আশঙ্কায় অনেকেই পায়ে ফিন পরেছিল। সাঁতার কাটতে অসুবিধা হবে ভেবে সেটি গ্রহণ করিনি। আমার সঙ্গীদের মধ্যে মারজান আর আদিলই সাঁতার জানে, তাঁরা দুজন একটা বড় কাঠের পাটাতন জোগাড় করেছে। সাদি, মুমু আর রাদিয়াকে নিয়ে ওরা পাঁচজন সেই কাঠের পাটাতনে হাত রেখে মাথা পানিতে ডুবিয়ে নিচের দৃশ্যাবলি উপভোগ করছে। কিন্তু এতে পানির গভীরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমি তাই আলাদাভাবেই সাঁতরাচ্ছিলাম। বেশি গভীরে যাওয়ার কিছু ঝুঁকিও আছে। এই যেমন প্রবালে পা কেটে যেতে পারে, আবার কিছু বেয়াদব অক্টোপাস হামলাও করতে পারে। উত্তেজনার চোটে অবশ্য এত কিছু তখন মাথায় আসেনি।

ভালোয় ভালোয় স্নর্কেলিং শেষে স্পিডবোটে ওঠার পরপরই পায়ের মাংসপেশিতে প্রচণ্ড টান পড়েছিল। সাদি আবার চিকিৎসক। ব্যাখ্যা করল, দীর্ঘ সময় ধরে সমুদ্রের নোনাজলে থাকার কারণে অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় সোডিয়ামের মাত্রা বেড়ে গেছে পেশিতে। তাই টান ধরেছে। ভাগ্যিস সমুদ্রে থাকার সময় এই অবস্থা হয়নি। প্রচণ্ড ব্যথার জন্য তখন সাঁতরাতেও পারতাম না। লাইফ জ্যাকেট পরা ছিল বিধায় হয়তো ডুবে যেতাম না, কিন্তু কষ্ট তো ঠিকই হতো।

সমুদ্রের পানির রং এখানে ঘন নীল
সমুদ্রের পানির রং এখানে ঘন নীল

পুরো ফি ফি আইল্যান্ডের সব থেকে বিখ্যাত স্থান মায়া বে। এই সেই জায়গা, যেখানে শুটিং হয়েছে সুপারহিট হিন্দি সিনেমা ‘কাহো না পেয়ার হ্যায়’। এই সিনেমা যখন মুক্তি পায়, তখন আমি উচ্চমাধ্যমিকে পড়ি। একদিকে আমাদের বান্ধবীদের কমন ক্র্যাশ ছিল হৃতিক রোশন। অন্যদিকে আমিশা প্যাটেলের কিউটনেস নিয়েও ছেলেদের মধ্যে মুখরোচক আড্ডা চলত। আবার লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও অভিনীত হলিউড সিনেমা ‘দ্য বিচ’-এর শুটিংও হয়েছে এই ফি ফি আইল্যান্ডে। অভিযোগ আছে, ১৯৯৯ সালে ছবির শুটিংয়ের সময় মায়া সৈকতের অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছিল সৈকত সম্প্রসারণের জন্য। এই নিয়ে মামলাও হয় এবং থাইল্যান্ডের আদালত সিনেমার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্সকে দোষী সাব্যাস্ত করেন। জেমস বন্ডের দুটি সিনেমা ‘দ্য ম্যান উইথ দ্য গোল্ডেন গান (১৯৭৪)’ ও ‘টুমরো নেভার ডাইজ (১৯৯৭)’-এর শুটিংও এই ফি ফি আইল্যান্ডেই হয়েছে। প্রথম সিনেমাটির একটি অংশ যে দ্বীপে হয়েছিল, সেটির নামই হয়ে গেছে ‘জেমস বন্ড আইল্যান্ড’। ওইটা আবার আরেক প্যাকেজ ট্যুরের অংশ।

বোটগুলো সরাসরি মায়া বেতে যায় না। লো সামা বেতে একটা ভাসমান জেটিতে নামিয়ে দেয়, সেখান থেকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে পৌঁছাতে হয় মায়া সৈকতে।

২৫০ মিটার দীর্ঘ এবং ১৫ মিটার প্রস্থের সৈকতটির সৌন্দর্য বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে সৈকতের অদূরে অবস্থিত লাইমস্টোনের পাহাড়গুলো। একটা সময় এখানে বেশি পর্যটকের আনাগোনা শুরু হলে কর্তৃপক্ষ এখানে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে প্রায় চার বছরকাল এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সেই নিষেধাজ্ঞা উঠেছে আর আমরা ঘুরতে এলাম নভেম্বর মাসে। যে হারে আবারও পর্যটকদের ঢল নেমেছে, বলা যায় না কবে না আবারও নতুন করে নিষেধাজ্ঞা চলে আসে।

মায়া সৈকতে শাহরুখ খানের বিখ্যাত পোজে ছবি না তুললে পাপ হবে ভেবে সবাই দুই হাত প্রসারিত করে ছবি তুললাম। চ্যালেঞ্জ একটাই, এত বেশি মানুষের আনাগোনা যে ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড ফাঁকা পাওয়াটাই কঠিন। যেহেতু এখানে এক ঘণ্টার বেশি অবস্থানের নিয়ম নেই, তাই সবাই এ জায়গায় ভিড় করে থাকে।
বিখ্যাত মায়া সৈকতে ভিড়

আমাদের প্যাকেজ ট্যুরের সর্বশেষ অংশ খাই নাই আইল্যান্ডে ভ্রমণ। এটি আদতে একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দ্বীপ, যেখানে সাদা পাউডারের মতো বালুতে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা যায়। যদিও আমরা যখন গিয়েছি, তখন আকাশজুড়ে ছিল মেঘের ঘনঘটা আর দ্বীপে নামতে না নামতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়, তাই সূর্যাস্ত উপভোগের সুযোগ হয়নি। এই দ্বীপ থেকে ফুকেট মাত্র ১৫ মিনিটের পথ। দ্বীপে ইলেকট্রিসিটি নেই, বসতিও নেই; আছে কেবল কয়েকটা রেস্টুরেন্ট আর বার, যেগুলো সন্ধ্যার পরই বন্ধ হয়ে যায়। এমনই একটি বারে (ফিশারম্যানস বার) বসে ডাবের পানিতে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে ভাবছিলাম, দুনিয়া কত বিশাল আর সুন্দর; সেই তুলনায় আমাদের অস্তিত্ব তো ধূলিসম। অথচ আমরা এই ক্ষুদ্র আমাদের নিয়ে কত অহংকারে মত্ত থাকি।

বিখ্যাত মায়া সৈকতে লেখক
বিখ্যাত মায়া সৈকতে লেখক

আমার পায়ের নিচে সাগরের পানি নুড়িগুলোকে ভিজিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে চলে। মহাকালের আবর্তে এভাবে আমরা একদিন হারিয়ে যাব। এক প্রজন্ম পরই আমাদের নাম ও নিশানা হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে। যাওয়ার আগে পৃথিবীটাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কতটুকু সুন্দর করে রেখে যেতে পারছি, সেটাই হচ্ছে কথা। কবি সুকান্তের ভাষায় বলতে ইচ্ছা হয়, ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি/ নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com